পরমহংস যোগানন্দ যেমনটি শিখিয়েছেন
১) প্রার্থনা
ধ্যানের দেহভঙ্গিতে স্থির হবার পর, আপন হৃদয় থেকে পরমাত্মার উদ্দেশ্যে আপনার ভক্তি জ্ঞাপন করে ও আপনার ধ্যানে তাঁর আশীর্বাদ কামনায় একটি প্রার্থনা করে আরম্ভ করুন।
২) সমস্ত চাপ মুক্ত করতে টানটান করুন ও শিথিল করুন
- শ্বাস নিন, সারা শরীর টানটান করুন ও হাতের মুঠি শক্ত করুন।
- সমস্ত অঙ্গ একসাথে শিথিল করার সাথে সাথে মুখ দিয়ে “হা, হা” করে দুবারে শ্বাস ত্যাগ করুন।
তিন থেকে ছয়বার এটির পুনরাবৃত্তি করুন। এবার শ্বাস-প্রশ্বাস ভুলে গিয়ে, সাধারণ অবস্থায় স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো একে স্ব-ভাবে আসতে ও যেতে দিন।
৩) কূটস্থে মনসংযোগ কেন্দ্রিভূত করুন
চোখের পাতা অর্ধনিমীলিত করে (অথবা পুরোপুরি বন্ধ করে, আপনার জন্য যেটি আরামদায়ক হয়), ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে একটা বিন্দু দিয়ে যেন বাইরে তাকাচ্ছেন এভাবে স্থিরদৃষ্টিতে মনসংযোগ কেন্দ্রিভূত করে ঊর্ধ্বাভিমুখি তাকান। (সাধারণত এই বিন্দুতে মনসংযোগ করতে গেলে অনেকেরই ভ্রু কুঁচকে যায়) স্বাভাবিক ক্ষমতার বাইরে গিয়ে চোখের ওপর অত্যাচার করবেন না, নিরুদ্বিগ্ন হয়ে ও শান্তভাবে মনসংযোগ করলে ঊর্ধ্বাভিমুখি স্থিরদৃষ্টি স্বাভাবিকভাবে আসে।
ভ্রুদ্বয়ের মধ্যবর্তীতে সম্পূর্ণ মনোযোগ স্থাপন করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। এটাই কূটস্থ বা খ্রিস্ট চেতনা কেন্দ্র, জিশুর বলা একক চোখের আসন: “চোখই শরীরের আলো: তাই যদি তোমার চোখ একক হয় তোমার সমগ্র শরীর আলোকপূর্ণ হয়ে যাবে” (ম্যাথু ৬:২২)।
ধ্যানের উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে, ভক্ত অনুভব করে তার চেতনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আধ্যাত্মিক চক্ষুতে নিবিষ্ট হয়ে গেছে, তার অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক ধীশক্তি অনুযায়ী পরমাত্মার সাথে এক দৈবি আনন্দঘন একত্ব উপলব্ধি করে।
আধ্যাত্মিক চক্ষু দর্শন করতে গভীর মনসংযোগ আর সমাহিতভাবের প্রয়োজন হয়: এক নীল বৃত্তকে ঘিরে সোনালি বলয়, তার কেন্দ্রে স্পন্দনরত শুভ্র পঞ্চমুখী তারা। এই আধ্যাত্মিক চক্ষু দর্শন হলে অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য আরও গভীর মনসংযোগ করে পরমাত্মার উদ্দেশ্যে ভক্তিপূর্ণ প্রার্থনা নিয়ে প্রবল প্রচেষ্টা করা উচিত। যোগদা সৎসঙ্গ-র মনসংযোগ ও ধ্যানের প্রক্রিয়ার [যোগদা সৎসঙ্গ পাঠমালা-য় শেখানো হয়] অবিচলিত অনুশীলনের ফলে স্বাভাবিকভাবে প্রয়োজনীয় প্রশান্তি ও মনসংযোগের গভীরতা বিকশিত হয়।
৪) আপনার নিজ হৃদয়ের ভাষায় ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে গভীরভাবে প্রার্থনা করুন
আপনার ধ্যান গভীরতর করার উপায়
(উদ্ধৃতাংশ) (৫:০৫ মিনিট)
আপনি আধ্যাত্মিক চক্ষুতে সে আলো দেখতে পান বা নাই পান, ভ্রুযুগলের মাঝে কূটস্থে মনসংযোগ করে পরমাত্মার ও তাঁর মহান ঋষিদের উদ্দেশ্যে গভীরভাবে প্রার্থনা করে যাওয়া উচিত। আপনার হৃদয়ের ভাষায় তাঁদের উপস্থিতি ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করুন।
যোগদা সৎসঙ্গ পাঠমালা বা পরমহংস যোগানন্দের হুইস্পারস ফ্রম ইটার্নিটি অথবা আধ্যাত্মিক ধ্যান থেকে একটা সংকল্প বা একটা প্রার্থনা দিয়ে আপনার নিজের ভক্তির আকুলতার সাথে আত্মশুদ্ধি একটা সুন্দর অভ্যাস।
পরমাত্মার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত ভ্রুদ্বয়ের মাঝের বিন্দুতে মনসংযোগ করে তাঁর কাছে নীরবে স্তব ও প্রার্থনা করুন যতক্ষণ না শান্তি, গভীর প্রশান্তি ও হৃদয়ে আনন্দ অনুভব করবেন।
পরমহংস যোগানন্দের প্রার্থনা
একটি সংকল্পের অনুশীলন
৫) নিত্য অনুশীলনই গূঢ় প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি
ধ্যানের সময়কাল অন্তত সকালে ত্রিশ মিনিট ও সন্ধ্যায় ত্রিশ মিনিট হওয়া উচিত। যত বেশি সময় ধ্যানে বসবেন, ধ্যানমগ্নতার প্রশান্তি যত অনুভব করবেন, ততই দ্রুত লয়ে আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতি করবেন। সারাদিনের কাজের মধ্যে ধ্যানে অনুভব করা প্রশান্তি বয়ে নিয়ে চলুন; এই প্রশান্তিই আপনার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্প্রীতি ও প্রসন্নতা আনতে সহায়তা করবে।
উল্লিখিত নির্দেশসমূহের নিত্য অনুশীলনের মাধ্যমে আপনি নিজেকে যোগদা সৎসঙ্গ পাঠমালায় দেওয়া মনসংযোগ ও ধ্যানের গূঢ় প্রক্রিয়ার অনুশীলনের জন্য তৈরি করতে পারেন। এই বিজ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়া ঈশ্বর উপস্থিতির অনন্ত মহাসাগরের আরও গভীরে নিমগ্ন হতে সক্ষম করবে। এই মুহূর্তেও আমরা সবাই সেই পরমাত্মার মহাসাগরেই আছি, তবুও শুধুমাত্র অবিচল, সমর্পিত বিজ্ঞানভিত্তিক ধ্যানের মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারি আমরা পরমাত্মার অনন্ত আনন্দ মহাসাগরের স্বতন্ত্র সত্ত্বার তরঙ্গ।
পরমহংস যোগানন্দের লেখনি থেকে:
“ভক্ত যথার্থ ধ্যানের ভঙ্গিতে মেরুদন্ড সোজা করে স্থির হয়ে বসবে, শরীর টানটান ও শিথিল করবে — কারণ শিথিলকরণে মাংসপেশি থেকে চেতনা মুক্ত হয়, ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশের এটা প্রথম কদম।
“কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে সারা শরীর টানটান আর প্রশ্বাসের সাথে সাথে শিথিলতা, এভাবে যথাযথ গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে যোগী শুরু করে। শারীরিক নিশ্চলতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত, প্রত্যেক প্রশ্বাসের সাথে মাংসপেশির টান ভাব ও শরীর নড়াচড়া ত্যাগ করো।
“অতঃপর, মনসংযোগ প্রক্রিয়ায় মন থেকে অস্থিরতা দূর হয়ে যায়। যথাযথ শারীরিক ও মানসিক নিশ্চলতায় যোগী পরমাত্মার সান্নিধ্যের অনির্বচনীয় শান্তি উপভোগ করে।
“শরীরে, প্রাণ হল মন্দির; মনে, জ্ঞান হল মন্দির; অন্তঃকরণে, শান্তি হল মন্দির। অন্তঃকরণের আরও গভীরে গেলে আরও বেশি শান্তির অনুভূতি হবে; এটাই অতিচেতনা।
“গভীর ধ্যানে ভক্তের শান্তির চৈতন্য প্রসারিত হয় আর এর সাথে সাথে এও উপলব্ধি করে তার চৈতন্য মহাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, সমস্ত প্রাণীকুল, সমস্ত সৃষ্টিতে এই শান্তি ছেয়ে যাচ্ছে আর সে মহাজাগতিক চেতনায় প্রবেশ করছে। ফুলের মধ্যে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে, পরিবেশে — সর্বত্র সে এই শান্তি উপলব্ধি করে। সে দেখে এই ধরণী ও বিশ্বচরাচর সেই শান্তির মহাসাগরে বুদবুদের মতো ভাসছে।”
— পরমহংস যোগানন্দ