পরমহংস যোগানন্দের ওয়ার্ডস অফ কসমিক চ্যান্টস-এর “মুখবন্ধ”

[বিভিন্ন সংস্কৃতির ভক্তিগীতির ঐতিহ্য শুধুমাত্র এগুলির অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ছাড়াও আধ্যাত্মিক শক্তির জন্যই এখন মান্যতা পেয়েছে। পরমহংস যোগানন্দ ভারতের প্রেমপূর্ণ ভক্তিগীতির তাৎপর্যময় রূপের সাথে পাশ্চাত্যের পরিচয় করানোর পথিকৃত ছিলেন। ১৯৩০-এর দশকে লিখিত ওয়ার্ডস অফ কসমিক চ্যান্টস বইয়ের ভূমিকায় মনকে শান্ত ও কেন্দ্রিত করে কিভাবে আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ ভক্তিগীতি ধ্যানের উদ্যোগে সহায়তা করে সেকথা তিনি বর্ণনা করেছেন:]

সাধারণত জনপ্রিয় গান আবেগ অথবা সাম্প্রতিক কৌতূহল থেকে উদ্বুদ্ধ হয়। তবে, প্রকৃত ঈশ্বরভক্তির গভীরতায় সৃষ্টি হয়ে অফুরন্ত আনন্দের মতো তাঁর কোনো সাড়া সজ্ঞানে না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিনিয়ত স্পষ্টরূপে বা মনে মনে গীত হলে তাকে আধ্যাত্মিক গীত বলে।

জ্বলন্ত দেশলাই কাঠির মতো এই গীতগুলি ভক্তির ভিত্তিপ্রস্তরে আঘাত দিলেই ঈশ্বর চেতনার আগুন জ্বলে ওঠে। সাধারণ গান ভেজা দেশলাইয়ের মতো, দৈব উপলব্ধির কোনো ফুলকিও সৃষ্টি করে না।

এই কসমিক চ্যান্টস বইয়ের প্রতিটি ভক্তিগীতি আধ্যাত্মিকতামণ্ডিত; অর্থাৎ বিভিন্ন সমাবেশে প্রতিটি গীত উচ্চস্বরে ও মনে মনে গাওয়া হয় যতক্ষণ না প্রকৃতভাবে ঈশ্বরের সাড়া পাওয়া যায়। তাই আশা করা হয়, বিভিন্ন গানের মতো শ্রবণ বা আবেগকে তুষ্ট করার জন্য না হয়ে প্রতিটি পাঠক প্রথাগতভাবে দৈবী সংযোগের জন্য এই হৃদয়-সিক্ত ভক্তিগীতিগুলি গাইবে।

মহাবিশ্বে শব্দ সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী শক্তি

মহাবিশ্বে শব্দ বা কম্পন এক অতি ক্ষমতাশালী শক্তি। আনন্দ পাওয়ার জন্য ছাড়াও, সংগীত ঈশ্বর-উপলব্ধির একটা পথ, এ এক স্বর্গীয় শিল্পকলা। ভক্তিগীতি গাইবার কালে উদ্ভূত কম্পনের সাথে মহাজাগতিক কম্পন বা শব্দের সমন্বয়সাধন হয়। “আদিতে শব্দ ছিল আর শব্দ ঈশ্বরের সাথেই ছিল, এবং শব্দই ঈশ্বর ছিল” (জন ১:১)।

সর্বোত্তম সুফল পেতে হলে এইসমস্ত গানের গায়কেরা একলা অথবা ঈশ্বরের প্রকৃত ভক্তদের সাথে ক্রমবর্ধিত ভক্তি ও অনুভূতি মিলিয়ে গাইবে। কথা ও সুর জেনে নেবার পর গভীর থেকে গভীরতর ভক্তির সাথে অবিচ্ছিন্ন মনোযোগ দিয়ে বার বার পুনরাবৃত্তি করবে, গায়কির আনন্দে অভিভূত হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত গানের শব্দের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে সচেষ্ট থাকতে হবে। এই আনন্দের অনুভূতিই প্রথম ঈশ্বর উপলব্ধি।

আন্তরিকতা, প্রত্যয়, শ্রদ্ধা ও স্বজ্ঞায় পূর্ণ শব্দ প্রচন্ড বিস্ফোরক অনুরণন বোমার মতো পাহাড়প্রমাণ বাধা সরিয়ে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

পাঁচটি অবস্থা হল: উচ্চস্বরে স্তব—মৃদুস্বরে স্তব—মানসিক স্তব—অবচেতনে স্তব—অতিচেতনে স্তব। চিন্তা ও কর্মের পটভূমিতে মনে অনায়াসে স্তবগুলির পুনরাবৃত্তি চলতে থাকলে অন্তঃস্থ চেতনার সাথে অবচেতন স্তব স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে।

অতিচেতন স্তব ওম-এর উপলব্ধিতে চালিত করে

অন্তঃস্থ স্তবের অনুরণন উপলব্ধিতে রূপান্তরিত হয়ে অতিচেতন, অবচেতন ও চেতন মনে প্রতিস্থাপিত হয়ে যাওয়াই অতিচেতন স্তব। কাল্পনিক অথবা বাহ্যিক শব্দের ওপর নয়, অকৃত্রিম মহাজাগতিক অনুরণন, অউম বা ওম-এর উপর অবিচ্ছিন্নভাবে মনঃসংযোগ ধরে রাখলে প্রকৃতভাবে অতিচেতন স্তবের সূচনা হয়।

বাইবেলের দশটি নির্দেশের একটি: “তুমি নিরর্থক তোমার প্রভু ঈশ্বরের নাম নেবে না।” পরমাত্মার ওপর সম্পূর্ণ মনোযোগ না দিয়ে অন্যমনস্কভাবে স্তব বা প্রার্থনার পুনরাবৃত্তি করলে, নিরর্থক ঈশ্বরের নাম নেওয়া হয়; নামের সর্বব্যাপী শক্তির সদ্ব্যবহার না করে আর ঈশ্বরের কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে নিষ্ফল হয়। এইরকম তোতাপাখির মতো আওড়ানো প্রার্থনায় ঈশ্বর সাড়া দেন না। ক্রমবর্ধমান বিচারবুদ্ধি ও ভক্তির সাথে ভক্তিগীতির পুনরাবৃত্তি করাই ঈশ্বরের নাম নেওয়া, নিরর্থক হয় না, কার্যকরী হয়।

এই আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ ভজন, কসমিক চ্যান্টস, যথাযথ ভক্তির সাথে গাইলে, ঈশ্বর-সান্নিধ্য আর পরমানন্দ খুঁজে পাবেন আর এর মাধ্যমে শরীর, মন ও আত্মার আরোগ্যলাভ হবে।

আনন্দই প্রমাণ করে ঈশ্বর ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়েছেন

গায়কের অন্তঃকরণে আনন্দের অনুভূতি ভেসে না আসা পর্যন্ত পুনরাবৃত্তির ক্রমবর্ধমান শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই প্রতিটি ভজন একবারই নয়, বারবার গাইতে হবে। এমন আনন্দের অনুভূতি হলে বুঝতে হবে গায়ককে ঈশ্বর সাড়া দিয়েছেন আর তার ভক্তি যথাযথ তালে আছে; ভজনে সম্প্রচারিত তার আকুতি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গভীর হয়েছে।

নির্জনে বা সমাবেশে যিনি অতি ভক্তিতে ভজন গান, পরবর্তীতে আবিষ্কার করেন তার অবচেতনে নিজে নিজেই এই ভজনগুলির পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে, জীবনযুদ্ধে নানা কাজের ঘনঘটার মধ্যেও এক অনিবর্চনীয় আনন্দ প্রবাহিত হচ্ছে।

ধীরে ধীরে অবচেতনে এই পুনরাবৃত্তি অতিচেতন উপলব্ধিতে বদল হয়ে প্রকৃত ঈশ্বরের জ্ঞান নিয়ে আসে। অবচেতন হয়ে অতিচেতন উপলব্ধি ঐশ্বরিক সান্নিধ্যে না পৌঁছোন পর্যন্ত গভীর থেকে গভীরতরভাবে স্তব করা প্রত্যেকের উচিত।

প্রতিদিন এই ভক্তিগীতি গাইবার জন্য কিছুটা সময় নির্দিষ্ট রাখা প্রতিটি ভক্তের উচিত। প্রথমে উচ্চস্বরে স্তব, তারপর ফিসফিস করে, শেষে মনে মনে। ঈশ্বরের নামে একত্রিত হওয়া একটি দল এই ভজনের কোনো একটি বেছে নিয়ে পিয়ানো বা অর্গান সহযোগে গাইবেন, তারপর আরও মৃদুস্বরে, তারপর কোনও সঙ্গত ছাড়াই ফিসফিস করে আর শেষে একদম মনে মনে। এইভাবে গভীর ঈশ্বর-অনুভব প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব।

para-ornament

আমেরিকার শ্রোতারা হৃদয়ের এই গান বুঝতে পারে

আত্মিক শক্তির সাথে সম্পৃক্ত সর্ব অন্তঃকরণে অধিগম্য গীতই আসল সংগীতবিদ্যা। বছরের পর বছর আমি আমেরিকান শ্রোতাদের সামনে উপস্থিত হয়ে বহুবার এই সত্যের প্রদর্শন করেছি। ১৯২৬-এর এপ্রিল মাসে নিউ ইয়র্কের কার্নেগী হলে আমার ধারাবাহিক বক্তৃতা দেবার সময়, কয়েকজন সংগীতবন্ধুকে আমার এই ভজনগুলির একটি গাইবার প্রস্তাব করেছিলাম, আগে কোনো মহড়া ছাড়াই, হলের সব শ্রোতাদের এতে যোগদান করতে বলেছিলাম। আমার বন্ধুরা আমেরিকান প্রকৃতির সাথে এই ভজনগুলি ভিনগ্রহী হবে ভেবেছিল।

আমি প্রতিবাদ করে বলি সংগীত ঈশ্বরের ওপর মানুষের ভক্তির এক বিশ্বজনীন ভাষা আর প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য সংগীতের সাথে পরিচিত হোক বা না হোক, সমস্ত গভীর ভাবপূর্ণ মানুষ ভজনের সময় আমার হৃদয়ের ঈশ্বর আকুলতা বুঝবে।

এক সন্ধ্যায় আমি “ও গড বিউটিফুল” ভজনটি গাইতে শুরু করলাম আর যারা এই ভজন আগে শোনেনি সেই শ্রোতাদেরও আহ্বান করি আমার সাথে গলা মেলাতে। এক ঘন্টা পঁচিশ মিনিট আনন্দঘন স্তুতির স্বর্গীয় পরিবেশে সমবেত শ্রোতা হাজার হাজার কণ্ঠে “ও গড বিউটিফুল” স্তব গাইল।

এমনকি আমি মঞ্চ ছেড়ে যাবার পরও শ্রোতারা বসে থেকে ভজনটি গাইতে থাকেন। পবিত্র স্তবপাঠের সময় দিব্য-অনুভূতি আর শরীর, মন ও আত্মার নিরাময় হয়েছিল বলে পরদিন অনেক নারী-পুরুষ সাক্ষ্য দেন এবং অন্যান্য সেবাকার্যে আবার এই ভজনের পুনরাবৃত্তির জন্য অসংখ্য অনুরোধ আসে।

কার্নেগি হল, দ্য মিউজিক টেম্পল অফ আমেরিকার এই অভিজ্ঞতা এবং অনেক মহতি গায়ক ও সংগীতজ্ঞদের জয়জয়কারের দৃশ্য আর প্রাচ্য ভজন সম্বন্ধে অজ্ঞ পশ্চিমীদের বোঝাপড়া, ভাবপূর্ণ সংগীতের বিশ্বজনীন চরিত্রের প্রতি এক স্বাভাবিক শ্রদ্ধার্ঘ ছিল।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শ্রোতাদের সঙ্গে ওই সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি প্রায় হাজারবার এই ভজনগুলি গেয়েছি আর ঈশ্বরের পবিত্র নামের প্রেমে গাওয়া ভক্তদের ওপর দৈবী অনুগ্রহ ঝরে পড়তে দেখেছি।

লস এঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া
ডিসেম্বর ৪, ১৯৩৮
পরমহংস যোগানন্দের ওয়ার্ডস অফ কসমিক চ্যান্টস থেকে উদ্ধৃত

para-ornament

আরও অনুসন্ধানের জন্য:

এই শেয়ার করুন