যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া শব্দকোশ (অ – আ)

অউম (ওম): সংস্কৃত ভাষার একটি মূল শব্দ বা বীজ-ধ্বনি; যে রূপে ঈশ্বর সবকিছু সৃষ্টি ও রক্ষা করছেন, তারই প্রতীকস্বরূপ; বৈশ্বিক স্পন্দন। বেদোক্ত ওম-ই হল তিব্বতীয়দের পবিত্র শব্দ ‘হুম’, মুসলমানদের ‘আমিন’ এবং মিশরীয়, গ্রিক, রোমান, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ‘আমেন’। জগতের সকল মহান ধর্মেই উল্লিখিত আছে যে, যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, সে সবকিছুরই উদ্ভব হয়েছে ওম বা আমেন, ‘শব্দ’ বা পবিত্র-আত্মার বৈশ্বিক স্পন্দনশক্তি থেকে। “আদিতে ‘শব্দ’ ছিলেন, ‘শব্দ’ ঈশ্বরের সাথে সংযুক্ত ছিলেন, আর ‘শব্দই ঈশ্বর ছিলেন …. সব কিছুই তাঁর [‘শব্দ’ বা অউম] দ্বারা সৃষ্ট হয়েছিল; আর যা কিছুই সৃষ্টি হয়েছে তার কোনো কিছুই তাঁকে ছাড়া সৃষ্টি হয়নি” (জন ১:১,৩)। হিব্রু ভাষায় ‘আমেন’ কথার অর্থ হল ‘নিশ্চয়’, ‘বিশ্বস্ত’। “যিনি আমেন, যিনি বিশ্বস্ত ও সত্য সাক্ষ্যস্বরূপ, যিনি ঈশ্বরের সৃষ্টির আদি, তিনি এই কথা বলেন” (রিভিলেশন ৩:১৪)। একটি ক্রিয়াশীল যন্ত্রের কম্পনের ফলে যেমন শব্দ উৎপন্ন হয়, ঠিক তেমনই সর্বব্যাপী ওম শব্দ বিশ্বাসযোগ্যভাবে একটি বৈশ্বিক যন্ত্রের কার্যরত অবস্থাকেই প্রমাণ করে যা তার স্পন্দনশীল শক্তির দ্বারা সকল জীব এবং সৃষ্টির প্রতিটি কণাকে ধারণ করে রেখেছে। যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া পাঠমালার (দ্র) মাধ্যমে পরমহংস যোগানন্দ সেই সব ধ্যান প্রক্রিয়ার শিক্ষা দিয়েছেন যার অনুশীলনে ওম অথবা হোলি ঘোস্ট (পবিত্র আত্মা) রূপে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। অদৃশ্য দিব্য শক্তির (“সান্ত্বনাদাতা বা সেই পবিত্র আত্মা” – জন ১৪:২৬) সঙ্গে পরমানন্দময় যোগাযোগই প্রার্থনার প্রকৃত বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি।

অতিচেতন অবস্থা: আত্মার শুদ্ধ, স্বজ্ঞাযুক্ত, সর্বদর্শী, নিত্য আনন্দময় চেতনা। কখনও কখনও ধ্যানের বিভিন্ন পর্যায়ে ‘সমাধি’(দ্র) -র যে অভিজ্ঞতালাভ হয়, তাকেই সাধারণভাবে অতিচেতন অবস্থারূপে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। তবে বিশেষ করে এটি হল ‘সমাধি’-র প্রথম অবস্থা যখন সাধক অহংবোধকে অতিক্রম করে নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিরূপে গঠিত আত্মা বলে অনুভব করতে শেখে। অতঃপর সাধক কূটস্থ চৈতন্য ও ব্রহ্মচৈতন্যরূপ (দ্র) উচ্চতর পর্যায়ের অনুভূতি লাভ করে।

অতিচেতন মন: আত্মার সর্বদর্শী ক্ষমতা যা পরম সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধিতে সক্ষম; স্বজ্ঞা।

অবতার: দিব্য আবির্ভাব; সংস্কৃত শব্দ অবতার থেকে উদ্ভূত। অব অর্থে “নিম্নে” এবং তৃ অর্থে “যাওয়া” বোঝায়। যে সকল জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হওয়ার পরেও মানুষের মঙ্গলকামনায় ধরাতলে পুনরায় অবতীর্ণ হন, তাঁদেরই অবতার বলে।

অবিদ্যা: আক্ষরিক অর্থে ‘অজ্ঞতা’। মানুষের মধ্যে ‘মায়া’ বা বৈশ্বিক বিভ্রমের (দ্র) বহি:প্রকাশ। মানুষের নিজস্ব দিব্য সত্তা এবং জগতের একমাত্র সত্য অর্থাৎ পরমাত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে তার অজ্ঞতাকেই মূলত অবিদ্যা বলে।

অর্জুন: ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একজন উচ্চকোটির শিষ্য যাঁকে তিনি ভগবদগীতার (দ্র) অমরবাণী শুনিয়েছিলেন; হিন্দু ধর্মের বিখ্যাত মহাকাব্য মহাভারতে উল্লিখিত পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম এবং ওই মহাকাব্যের একজন প্রধান চরিত্র।

অশুভ: শয়তানের যে শক্তি জগতে ঈশ্বরের সর্বব্যাপিত্বকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রাখতে চায় এবং প্রকৃতি ও মানুষের জীবনে যা অসঙ্গতিরূপে প্রকাশিত হয়। আবার ব্যাপক অর্থে যা কিছু দিব্যবিধানের (ধর্ম দ্রষ্টব্য) পরিপন্থী এবং যার ফলে মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে তার অপরিহার্য একাত্মবোধের চেতনাকে হারিয়ে ফেলে এবং যা ঈশ্বরোপলব্ধি অর্জনে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়।

অহংকার: এই তত্ত্বই হল অহংকার (আক্ষরিক অর্থে ‘আমি করি’), এই অহং তত্ত্ব দ্বৈতবোধ বা ঈশ্বরের থেকে মানুষের আপাত ভিন্নতার মূল কারণ। অহংকার-ই মানুষকে মায়া(দ্র)-র প্রভাবে নিয়ে আসে যার দরুন কর্তা (অহং) ভ্রান্তিবশত কর্ম রূপে প্রতিভাত হয়; সৃষ্ট জীব নিজেকে স্রষ্ঠা রূপে মনে করতে থাকে। এই অহং চেতনাকে বিতাড়িত করে মানুষ তার প্রকৃত জীবন অর্থাৎ ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতায় দিব্য পরিচিতিতে জেগে ওঠে।

আত্মা (Soul): আত্মা হল মানুষের — এবং সমস্ত জীবিত প্রাণের — প্রকৃত ও অমর স্বরূপ; এটি কেবল অস্থায়ীভাবে কারণ দেহ, সূক্ষ্ম দেহ ও ভৌতিক দেহের আচ্ছাদনে আবৃত থাকে। আত্মার স্বরূপ হল আত্ম-চেতনা বা ঈশ্বরত্ব যা চিরস্থায়ী, চিরসচেতন, চিরনতুন আনন্দের (আনন্দানুভূতির) এক অক্লান্ত প্রকাশ।

আত্মা (Self): মানুষের দিব্যসত্তা বা আত্মা; মানুষের সাধারণ ব্যক্তিত্ব বা অহং থেকে ভিন্ন। আত্মা, পরমাত্মারই ব্যষ্টিরূপ, যার অপরিহার্য প্রকৃতি হল, নিত্য-বিদ্যমান, নিত্য-সচেতন, নিত্য-নতুন আনন্দ। মানুষের প্রেম, প্রজ্ঞা, শান্তি, সাহস, করুণা এবং অন্যান্য দিব্যগুণের অভ্যন্তরীণ উৎস হল আত্মা যা ধ্যানের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়।

আত্মোপলব্ধি: পরমহংস যোগানন্দ আত্মোপলব্ধির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন: আত্মোপলব্ধি হল দেহ, মন ও আত্মার দ্বারা এই জ্ঞান অর্জন করা যে, আমরা ঈশ্বরের সর্বব্যাপিত্বের সঙ্গে এক ও অভিন্ন; এর জন্য আমাদের প্রার্থনা করার প্রয়োজন নেই, আমরা যে সর্বদাই তাঁর নিকটে আছি শুধু তাই নয়, ঈশ্বরের সর্বব্যাপীত্ব হল আমাদেরও সর্বব্যাপীত্ব; এখন যেমন তাঁর এক অংশ হয়ে আছি, সেভাবেই আমরা চিরদিন থাকব। আমাদের একমাত্র যা করণীয়, তা হল আমাদের উপলব্ধির উন্নতিসাধন করা।

আধ্যাত্মিক নেত্র: ভ্রূদ্বয়ের মধ্যবর্তী কূটস্থ কেন্দ্রে (আজ্ঞা চক্র) অবস্থিত স্বজ্ঞা ও সর্বব্যাপী অনুভবের একক চক্ষু। গভীরভাবে ধ্যানমগ্ন সাধক দিব্যনেত্রকে একটি সোনালী বলয়রূপে প্রত্যক্ষ করেন যা একটি নীলাভ জ্যোতির্ময় গোলককে পরিবেষ্টন করে আছে। আর এই গোলকের কেন্দ্রে আছে পঞ্চকোণবিশিষ্ট এক শ্বেত নক্ষত্র। অতি ক্ষুদ্র আকারে এই আকৃতি ও বর্ণ হল যথাক্রমে স্পন্দমান সৃষ্ট জগতের এক সংক্ষিপ্ত রূপ (ওম, মহাপ্রকৃতি, হোলি ঘোস্ট বা পবিত্ৰাত্মা); নিখিল সৃষ্টির মাঝে পরিব্যাপ্ত ঈশ্বরীয় চৈতন্য (তৎ, কূটস্থ চৈতন্য, পুত্র) এবং সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে নিশ্চল নিষ্ক্রিয় পরমাত্মা (সৎ, ঈশ্বরের পিতৃ রূপ)। আধ্যাত্মিক নেত্র হল ঐশ্বরিক চেতনার চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রবেশের পথ।

জিশু খ্রিস্ট নিজেও এই দিব্যনেত্র সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন, “যখন তোমার চক্ষু একক হয়ে উঠবে, তখন তোমার সমগ্র দেহ জ্যোতিতে পরিপূর্ণ হবে…সুতরাং তোমার মধ্যে যে জ্যোতি রয়েছে তা যাতে তমিস্রায় আবৃত না হয়, তার জন্য যত্নশীল হও।” (ল্যুক ১১:৩৪-৩৫)।

আশ্রম: আধ্যাত্মিক সাধনার আশ্রয়স্থল; একটি মঠ।

এই শেয়ার করুন