ভয়, উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তাকে জয় করা

শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দের রচনা থেকে উদ্ধৃতি

Krishna and Arjuna blowing there conch shells

এক বীরের সাহস এবং বিজয়ীর হাসি নিয়ে জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যেকের এবং প্রতিটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হও।

তুমি ঈশ্বরের সন্তান। তোমার আবার ভয় কি?

বিফলতা এবং রোগের ভীতি সৃষ্টি হয় যখন চেতন মনে এইসব চিন্তা বারবার ঘুরপাক খেয়ে অবচেতন মনে এবং অবশেষে অতিচেতন মনে শেকড় গেড়ে বসে। তারপর অতিচেতন এবং অবচেতনভাবে প্রোথিত ভয়গুলি অঙ্কুরিত হতে শুরু করে এবং চেতন মনকে ভয়ের চারাগাছ দিয়ে ভরে দেয়। মূল ভয়টিকে নির্মূল করা যতটা সহজ ছিল, এই চারাগাছগুলিকে নষ্ট করা ততটা সহজ নয় এবং কালে কালে এরা তাদের বিষাক্ত এবং মারাত্মক ফল ধারণ করে…

প্রবল একাগ্রতায় সাহসিকতার সাহায্যে এবং তোমার চেতনাকে অন্তঃস্থিত ঈশ্বরের পরম শান্তিতে স্থানান্তরিত করে, এই চারাগাছগুলিকে ভেতর থেকে উপড়ে ফেলো।

তুমি যা কিছুতেই ভয় পাও না কেন, তার থেকে তোমার মন সরিয়ে নাও আর সেটা ভগবানের হাতে ছেড়ে দাও। তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখো। অনেক দুঃখকষ্ট কেবল দুশ্চিন্তার কারণেই আসে। যে পীড়া এখনও আসেনি তার জন্য এখন থেকেই কষ্ট পাও কেন? যেহেতু আমাদের বেশিরভাগ পীড়াই ভয়ের থেকে আসে, তাই যদি তুমি ভয় ত্যাগ কর তাহলে তুমি তৎক্ষণাৎ পীড়ামুক্ত হবে। তুমি মুহূর্তে আরোগ্যলাভ করবে। প্রতি রাতে ঘুমোবার আগে দৃঢ়তার সঙ্গে বলো – “পরমপিতা আমার সঙ্গে আছেন; আমি সুরক্ষিত।” মনে মনে নিজেকে পরমাত্মার উপস্থিতি দিয়ে ঘিরে রাখো… তুমি তাঁর অপূর্ব সুরক্ষা অনুভব করবে।

চেতনাকে ঈশ্বরের ওপর রাখলে তোমার কোনো ভয় থাকবে না; সাহস আর বিশ্বাসের সঙ্গে তখন প্রতিটি বাধা পেরোতে পারবে।

“ভয় হৃদয় থেকে আসে। যদি কখনও কোনো রোগ বা দুর্ঘটনার ভয়ে অভিভূত হয়ে পড়ো, তাহলে কয়েকবার ধীরে ধীরে, নিয়মিত গতিতে, গভীরভাবে শ্বাস নেবে আর প্রত্যেকবার শ্বাস ছাড়ার সাথে সাথে শরীর শিথিল করে দেবে। এটি রক্ত চলাচলকে স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে। যদি তোমার হৃদয় সত্যই শান্ত হয় তাহলে তুমি আদৌ কোনো ভয় অনুভব করবে না।”

শরীরকে শিথিল করার প্রক্রিয়া

ইচ্ছাশক্তির দ্বারা টানটান করো: প্রাণের প্রবাহ যাতে শরীর বা শরীরের কোনো একটি অংশকে প্লাবিত করতে পারে (টানটান করার পদ্ধতির মাধ্যমে), সেজন্য ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগে তাকে সেদিকে চালিত করো। অনুভব করার চেষ্টা করো, শক্তি যেন সেখানে স্পন্দিত হচ্ছে এবং সেখানে শক্তিসঞ্চার করে তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলছে। শিথিল করে অনুভব করো: টানটান ভাবটিকে শিথিল করো, এবং শরীরের যে অংশটি শক্তিসঞ্চারের দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে, সেখানে নতুন জীবন ও প্রাণশক্তির মধুর শিহরণ অনুভব করো। অনুভব করো যে তুমি কোনো শরীর নও; তুমি সেই প্রাণ যা শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে। এই প্রক্রিয়া অভ্যাসের ফলে যে শান্তভাবের উদয় হয়, এবং তার থেকে যে শান্তি, মুক্তির চেতনা ও বর্ধিত সচেতনতার জন্ম হয়, তা অনুভব করো।

অনেকেই আমার কাছে তাদের দুশ্চিন্তার কথা বলতে আসে। আমি তাদের শান্তভাবে বসে ধ্যান এবং প্রার্থনা করতে বলি; এবং অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করার পর, সমস্যাটির সমাধান বা তাকে নির্মূল করার বিকল্প উপায়গুলি সম্পর্কে চিন্তা করতে বলি। যখন মন ঈশ্বরের চিন্তায় শান্ত থাকে, যখন ঈশ্বরে বিশ্বাস দৃঢ় থাকে, তখন তারা তাদের সমস্যার সমাধান খুঁজে পায়। কেবল উপেক্ষা করলেই সমস্যার সমাধান হবে না, কিন্তু সেগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা করলেও হবে না। শান্ত না হওয়া পর্যন্ত ধ্যান করে যাও; তারপর তোমার সমস্যাটির ওপর মন দাও এবং ঈশ্বরের সাহায্যের জন্য গভীরভাবে প্রার্থনা করো। সমস্যাটির ওপর মনোনিবেশ করো তাহলে তুমি দুশ্চিন্তার বিরাট চাপের মধ্য দিয়ে না গিয়েই সমাধান খুঁজে পাবে…

জেনে রেখো, মনের লক্ষ লক্ষ যুক্তির চেয়ে অন্তরের শান্তি অনুভব না করা পর্যন্ত ঈশ্বরের ধ্যানে বসে থাকাই শ্রেয়। তারপর ভগবানকে বলো, “আমি একা আমার সমস্যা সমাধান করতে পারব না, অগণিত চিন্তা করলেও না; তোমার হাতে তা সঁপে দিয়ে, প্রথমে তোমার নির্দেশ প্রার্থনা করে, তারপর বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সমাধানের পথ খুঁজে নিতে পারব।” যারা নিজেদের সাহায্য করে, ঈশ্বর তাদের অবশ্যই সাহায্য করেন। যখন তুমি ধ্যানে ভগবানের কাছে প্রার্থনা কর তখন তোমার মন শান্ত এবং বিশ্বাসে পূর্ণ হয়ে ওঠে; এর ফলে তুমি তোমার সমস্যার বিভিন্ন সমাধান দেখতে পাও এবং সবচেয়ে ভালো সমাধানটি বেছে নিতে সক্ষম হও। সেই সমাধানটি অনুসরণ করো, সফল হবে। এই হল দৈনন্দিন জীবনে ধর্মীয় বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ।

আমরা যতই ব্যস্ত থাকি না কেন, দুশ্চিন্তা এবং সমস্ত দায়িত্ব থেকে মাঝে মাঝে আমাদের মনকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখার কথা ভুলে গেলে চলবে না… বিশেষ করে যদি তুমি চিন্তিত হও তাহলে মনকে অভ্যন্তরীণ শান্তির ওপর স্থির রেখে এক এক মিনিট ধরে নেতিবাচক চিন্তা না করে থাকার চেষ্টা করো। তারপর কয়েক মিনিট শান্ত মন নিয়ে থাকার চেষ্টা করো। এরপর, কোনো আনন্দের ঘটনার কথা চিন্তা করো; এই ভাবনাটি ধরে রাখো এবং মানসনেত্রে তাকে দেখো; মনে মনে বারবার কোনো আনন্দের অভিজ্ঞতাকে অনুভব করো যতক্ষণ না তুমি তোমার দুশ্চিন্তা পুরোপুরি ভুলে যাচ্ছ।

চিন্তা করার, কথা বলার, অনুভব করার এবং কাজ করার সমস্ত শক্তি ঈশ্বরের থেকেই আসে এবং তিনি সর্বদা আমাদের সাথে আছেন এবং আমাদের অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনা দিচ্ছেন – এই উপলব্ধি তৎক্ষণাৎ উদ্বেগ থেকে মুক্তি এনে দেয়। এই উপলব্ধির সাথে সাথে ঐশ্বরিক আনন্দের উচ্ছ্বাস আসবে; কখনো কখনো সত্তার ভেতরে এক গভীর অন্তর্জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়বে, যা ভয়ের ধারণামাত্রকেই দূর করে দেবে। মহাসাগরের মতো ঈশ্বরের শক্তি হৃদয়ের মধ্যে এক শুদ্ধিকরণের বন্যায় উত্তাল তরঙ্গের মতো ঢুকে পড়ে ভ্রান্তিকর সংশয়, উদ্বেগ এবং ভয়ের সমস্ত বাধা দূর করে দেয়। প্রতিদিনের ধ্যানের মাধ্যমে লভ্য আত্মার মধুর প্রশান্তিকে স্পর্শ করে জড় পদার্থের ভ্রম এবং এক নশ্বর দেহমাত্র হওয়ার চেতনা কাটিয়ে ওঠা যায়। তখন তুমি জানবে যে এই দেহ তাঁর মহাজাগতিক সমুদ্রে শক্তির একটি ছোট্ট বুদবুদ।

ভগবানকে পাওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করো। আমি তোমাকে ব্যবহারিক সত্য ও প্রায়োগিক জ্ঞান দিচ্ছি; এবং তোমাকে এমন একটি তত্ত্ববিদ্যা দিচ্ছি যা তোমার সমস্ত দুঃখের চেতনা দূর করে দেবে। কোনো কিছুকে ভয় কোরো না… গভীরভাবে বিশ্বাসের সঙ্গে ধ্যান করে যাও। একদিন তুমি ঈশ্বরের পরমানন্দে জেগে উঠবে আর দেখবে যে মানুষ কতটা বোকামি করে ভাবছে যে তারা কষ্ট পাচ্ছে। তুমি, আমি এবং তারা সকলেই শুদ্ধ আত্মা।

সংকল্পবাক্য

সংকল্পবাক্যের তত্ত্ব এবং নির্দেশাবলী

“আমি নিজেকে একেবারে হালকা করে দিয়ে মনের সব ভার ঝেড়ে ফেলি, যাতে আমার মাধ্যমে ঈশ্বর তাঁর যথার্থ ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞান প্রকাশ করতে পারেন।”

“হে সর্বব্যাপী রক্ষাকর্তা! যখন যুদ্ধের মেঘ আমার দিকে গ্যাস ও আগুনের বৃষ্টি পাঠায়, তুমি বোমা থেকে আমার রক্ষার আশ্রয়স্থল হও।”

“জীবনে, মরণে, ব্যাধিতে, দুর্ভিক্ষে, মহামারীতে, অথবা দারিদ্রে, আমি যেন চিরদিন তোমাকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে পারি। আমাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করো যে আমি অবিনশ্বর আত্মা। শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য ও জড় জগতের উত্থানপতনের কোনো পরিবর্তনই আমাকে স্পর্শ করতে পারে না।”

আরও জানতে হলে

এই শেয়ার করুন