আধ্যাত্মিক অন্বেষণে গুরুর ভূমিকা

শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দের লেখা থেকে উদ্ধৃত

গুরুর ভূমিকা

গুরুগীতা (শ্লোক ১৭) যথাযথভাবে গুরুকে “অন্ধকার দূরকারী” হিসেবে বর্ণনা করেছেন (গু, যার অর্থ “অন্ধকার” এবং রু, যার অর্থ “যা দূর করে”)। একজন প্রকৃত, ভগবদপ্রাপ্ত গুরু হলেন তিনি, যিনি আত্ম-নিয়ন্ত্রণ লাভের দ্বারা সর্বব্যাপী পরমাত্মার সাথে নিজের একত্ব অনুভব করেছেন। সাধককে পরিপূর্ণতার দিকে তার অভ্যন্তরীণ যাত্রায় পথ দেখানোর জন্য এমন একজনই একমাত্র যোগ্য।

পরমহংসজি বলতেন “অন্ধ অন্ধকে পথ দেখাতে পারে না। একজন গুরু, যিনি ঈশ্বরকে জানেন, একমাত্র তিনিই অন্যদের ঈশ্বর সম্পর্কে সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে পারেন। নিজের দিব্যতা ফিরে পেতে হলে এমন একজন গুরু থাকা অত্যন্ত আবশ্যক। কেউ যখন বিশ্বাসের সঙ্গে একজন প্রকৃত গুরুকে অনুসরণ করে, সে তাঁর মতো হয়ে ওঠে, কারণ গুরু শিষ্যকে তাঁর নিজস্ব উপলব্ধির স্তরে উন্নীত করতে সহায়তা করেন।”

গুরু-শিষ্য সম্পর্ক হল বন্ধুত্বের সর্বোত্তম অভিব্যক্তি, কারণ এটি নিঃশর্ত দিব্য প্রেম এবং জ্ঞানের ভিত্তিতে গঠিত। এটি সকল সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং পবিত্র। জিশু খ্রিস্ট এবং তাঁর শিষ্যেরা এক আত্মা এক প্রাণ ছিলেন, যেমন আমার গুরু [স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর] এবং আমি, আর যারা আমার সাথে একসুরে বাঁধা, কারণ আমাদের মধ্যে ভগবদপ্রেমের একই বন্ধন রয়েছে… যে এই সম্পর্কের অংশীদার হয় সে জ্ঞান এবং মুক্তির পথে এগিয়ে যায়।

Paramahansa Yogananda standing on a Seashore

জীবনের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের মতো, আধ্যাত্মিক সাধনায় সাফল্যের জন্য ঈশ্বরের নিয়ম অনুসরণ করা প্রয়োজন। কোনো স্কুল থেকে জাগতিক বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতে হলে তোমাকে এমন একজন শিক্ষকের থেকে শিখতে হয় যিনি বিষয়টি জানেন। একইভাবে আধ্যাত্মিক সত্য বোঝার জন্য এমন একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষক বা গুরু থাকা প্রয়োজন, যিনি ঈশ্বরকে জানেন।

যখন তুমি জীবনের পাহাড়ি রাস্তায় অন্ধভাবে এগিয়ে যাও, অন্ধকারে হোঁচট খেতে শুরু করো, তখন তোমার এমন একজনের সাহায্যের প্রয়োজন হয় যার চোখ আছে। তোমার একজন গুরুর প্রয়োজন হয়। পৃথিবীতে যে বিরাট গোলমাল তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরোবার একমাত্র উপায় হল এক জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অনুসরণ করা। গুরুদেবের দেখা না পাওয়া পর্যন্ত আমি কখনো প্রকৃত সুখ এবং মুক্তির স্বাদ পাইনি। তিনি আমার আধ্যাত্মিক বিকাশে আগ্রহী ছিলেন এবং আমাকে পথ দেখানোর জ্ঞান তাঁর ছিল।

তোমার হৃদয়ের গভীরে ঈশ্বরের জন্য সর্বদা কাঁদতে থাকো। যখন তুমি ঈশ্বরকে নিশ্চিত করবে যে তুমি তাঁকেই পেতে চাও, তখন তিনি এমন একজনকে – তোমার গুরুকে – পাঠাবেন যিনি তোমাকে তাঁকে জানার উপায় শেখাবেন। যিনি নিজে ঈশ্বরকে জানেন একমাত্র তিনিই অন্যদের তাঁকে জানার উপায় দর্শাতে পারেন। যখন আমি এমন একজনকে, আমার গুরু স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বরজিকে পেয়েছিলাম, তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ঈশ্বর অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে শিক্ষা দেন না, বরং জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে শিক্ষা দেন। ঈশ্বর অদৃশ্য, কিন্তু যিনি তাঁর সাথে নিরন্তর যোগাযোগ রাখেন এমন একজনের বুদ্ধিমত্তা এবং আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে তিনি দৃশ্যমান হন। একজন মানুষের জীবনে অনেক শিক্ষক থাকতে পারে, কিন্তু গুরু মাত্র একজন। গুরু-শিষ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ঐশ্বরিক নিয়মের পূর্তি হয়, যেমনটি জিশুর জীবনেও দেখা গিয়েছিল, যখন তিনি যোহন বাপ্তিস্মককে তাঁর গুরু হিসাবে স্বীকার করেছিলেন।

যিনি ঈশ্বরোপলব্ধি লাভ করেছেন এবং ঈশ্বর যাঁকে অন্য আত্মাদের উদ্ধার করার জন্য আদেশ করেছেন, একমাত্র তিনিই হলেন গুরু। কেবল নিজেকে গুরু ভাবলেই কেউ গুরু হতে পারে না। জিশু দেখিয়েছিলেন যে প্রকৃত গুরু কেবল ঈশ্বরের নির্দেশেই কাজ করেন, যখন তিনি বলেছিলেন: “যে পরমপিতা আমাকে পাঠিয়েছেন তিনি আকর্ষণ না করলে কেউ আমার কাছে আসতে পারে না।” তিনি ঈশ্বরের শক্তিকেই সমস্ত কৃতিত্ব দিয়েছিলেন। যদি একজন শিক্ষক অহংকারমুক্ত হন, তাহলে তুমি জানবে যে তাঁর দেহমন্দিরে কেবলমাত্র ঈশ্বর বাস করেন; এবং যখন তুমি তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে চলো, তখন তুমি ঈশ্বরের সাথেও সুর মিলিয়ে চলে থাকো। জিশু তাঁর শিষ্যদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন: “যে কেউ আমাকে গ্রহণ করবে, সে আমাকে নয়, বরং যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁকেই গ্রহণ করবে।”

যে শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে অন্যের বন্দনা গ্রহণ করেন তিনি কেবল নিজের অহংকারের উপাসক। কোনো পথ সত্য কিনা তা জানতে, তার পিছনে কেমন ধরণের শিক্ষক আছেন তা বিচার করো, দেখো তাঁর কার্যকলাপ কী নির্দেশ করে – তিনি ঈশ্বরের দ্বারা পরিচালিত, নাকি নিজের অহংকার দ্বারা পরিচালিত। যে দলপতির কোনো উপলব্ধি নেই তিনি তোমাকে ঈশ্বরের রাজ্য দেখাতে পারবেন না, তা তাঁর অনুগামীর দল যত বড়ই হোক না কেন। সকল গির্জাই ভালো কাজ করেছে, কিন্তু ধর্মীয় মতবাদের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস মানুষকে আধ্যাত্মিকভাবে অজ্ঞ এবং স্থবির করে রাখে। অনেকবার আমি বিশাল জনসমাবেশে ঈশ্বরের নাম গান হতে দেখেছি, কিন্তু সুদূর নক্ষত্রদের মতো ঈশ্বর তাদের চেতনা থেকে দূরে ছিলেন। কেবল চার্চে গিয়ে কেউই নিরাপদে থাকতে পারে না। মুক্তির আসল পথ হল যোগ, বিজ্ঞানসম্মত আত্ম-বিশ্লেষণ, এবং ধর্মতত্ত্বের জঙ্গল অতিক্রম করে তোমাকে ঈশ্বরের কাছে নিরাপদে নিয়ে যেতে পারে এমন একজনের অনুসরণ।

সত্যের এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি

ঈশ্বর কর্তৃক নিযুক্ত এইরকম গুরু, মানুষের গভীর প্রার্থনার জবাবে তাদের সাহায্য করার জন্য যাঁকে ঈশ্বর নিযুক্ত করেছেন, তিনি কোনো সাধারণ শিক্ষক নন; বরং তিনি হলেন একজন মানবরূপী বাহন যাঁর দেহ, বাক্য, মন এবং আধ্যাত্মিকতাকে ঈশ্বর পথভ্রষ্ট আত্মাদের তাঁর পরমধামে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবহার করেন। সত্য জানার জন্য অনিশ্চিত আকাঙ্ক্ষার কারণে আমরা শুরুতে নানা শিক্ষকের সংস্পর্শে আসি। কিন্তু গুরু হলেন শাস্ত্রীয় সত্যের এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি এবং জড়তার বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য ভক্তের অবিরাম আবেদনের জবাবে ঈশ্বর কর্তৃক নিযুক্ত মুক্তির প্রতিনিধি।

সৎসঙ্গ, সাধুসঙ্গ এবং ঈশ্বরদূতদের প্রতি ভক্তির দ্বারা মায়া নাশ হয়। এমনকি সাধু সন্তদের চিন্তাও তোমার ভ্রম দূর করতে সাহায্য করবে। ব্যক্তিগত সঙ্গ নয়, ঈশ্বরের দূতের সাথে চিন্তার সাযুজ্যই ভ্রম নাশ করে। প্রকৃত গুরু অন্যদের হৃদয়ে নিজেকে স্থাপন করার ইচ্ছা রাখেন না, বরং তাদের চেতনায় ঈশ্বরের চেতনা জাগ্রত করার ইচ্ছা রাখেন। গুরুদেব [স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর] এমনই ছিলেন: তিনি আমাদের সঙ্গে একভাবে থাকতেন — কখনও নিজের মহত্ত্বের কোনো প্রদর্শন করেননি। আশ্রমের কেউ যদি স্বীকৃতি বা কর্তৃত্বের উচ্চ আসন চাইত, তাহলে গুরুদেব তাকে সেই পদটি দিয়ে দিতেন। কিন্তু আমি গুরুদেবের হৃদয় চেয়েছিলাম, তাঁর ভিতরে থাকা দিব্য চেতনা চেয়েছিলাম; এবং ফলস্বরূপ, তিনি সর্বদাই আমার হৃদয়ে আছেন। মহান ব্যক্তিদের সাথে এই রকম সমন্বয় তোমার প্রয়োজন।

আমার গুরুদেব আমাকে বলেছিলেন: “আমি এখন থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত তোমার বন্ধু থাকব, তা তুমি সবচেয়ে নীচু মানসিক স্তরেই থাকো বা জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরেই থাকো। তুমি ভুল করলেও আমি তোমার বন্ধু থাকব, কারণ তখন তোমার অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে আমার বন্ধুত্বের বেশি প্রয়োজন হবে।”

যখন আমি গুরুদেবের নিঃশর্ত বন্ধুত্ব স্বীকার করলাম, তখন শিশুর মতো সরল বিশ্বাসে তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমিও কি আমায় ওইরকম নিঃশর্ত ভালোবাসা দিতে পারবে?”

“গুরুদেব, চিরকালই আমি আপনাকে ভালোবাসব!”

“সাধারণ ভালোবাসা স্বার্থপর, কামনা-বাসনা পরিতৃপ্তির গাঢ় অন্ধকারের ভিতরই এর মূল দৃঢ়নিবদ্ধ। স্বর্গীয় ভালোবাসা প্রতিদান চায় না; তা সীমাহীন, তার কোনো পরিবর্তন নেই। অনাবিল প্রেমের পরশমণির ছোঁয়ায় মানব মনের আবিলতা চিরতরে দূর হয়ে যায়। আর দেখো, কখনো যদি তুমি আমায় ভগবদবিচ্যুত হতে দেখো তাহলে প্রতিজ্ঞা করো যে, আমার মাথা তোমার কোলে নিয়ে আমাদের উভয়ের প্রেমের ঠাকুরের কাছে আমাকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করবে।”

এই আধ্যাত্মিক চুক্তিটি করার পরই আমি একজন শিষ্যের কাছে গুরুর তাৎপর্য পুরোপুরি বুঝতে শুরু করি। যতক্ষণ আমি আমার গুরুদেবের ঐশ্বরিক চেতনার সঙ্গে নিঃশর্ত আনুগত্য এবং নিষ্ঠার সাথে নিজেকে একীভূত করিনি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি সম্পূর্ণ তৃপ্তি, স্বস্তি এবং ঈশ্বরসংযোগ পাইনি।

সর্বোত্তম দাতা

ঈশ্বর কেবল তাঁর জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত ভক্তদের মধ্য দিয়েই জগতের সাথে কথা বলেন। অতএব, সমস্ত কাজের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হল গুরুর ইচ্ছার সাথে তাল মিলিয়ে চলা, যে গুরুকে ভগবান তোমার অন্তরের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি গুরু নন যিনি নিজেকে গুরু বলে জাহির করেন; যাঁকে ঈশ্বর অন্যদের তাঁর কাছে ফিরিয়ে আনতে বলেছেন তিনিই গুরু। যখন সামান্য আধ্যাত্মিক বাসনা জাগে, ঈশ্বর তোমাকে আরও অনুপ্রাণিত করতে গ্রন্থ এবং শিক্ষক প্রেরণ করেন; এবং যখন তোমার বাসনা প্রবলতর হয়, তিনি একজন সদগুরু প্রেরণ করেন…।

কিছু শিক্ষক এমন আছেন যাঁরা চান তাদের অনুসরণকারীরা যেন সর্বদা এক ডাকে সাড়া দেয় এবং মুহূর্তের মধ্যে তাঁদের আজ্ঞা পালন করতে তৈরি থাকে; তা না হলে শিক্ষক রেগে যান। কিন্তু একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষক যিনি ঈশ্বরকে জানেন এবং প্রকৃত অর্থে একজন গুরু, যিনি কখনও নিজেকে একজন শিক্ষক হিসেবে ভাবেন না। তিনি সকলের মধ্যেই ভগবানকে দেখেন এবং কোনো শিষ্য তাঁর কথা না শুনলেও বিরক্ত হন না। হিন্দু শাস্ত্র বলে যে, যারা একজন প্রকৃত গুরুর জ্ঞানের সাথে সুর মিলিয়ে চলে, তারা গুরুর পক্ষে তাদেরকে সাহায্য করা সম্ভব করে তোলে। “এটা (গুরুর জ্ঞান) বুঝতে পেরে, হে অর্জুন! তুমি আর কখনও ভ্রান্তিতে পড়বে না।”

গুরু এবং শিষ্যের মধ্যে যে বন্ধুত্ব তা চিরন্তন। যখন একজন শিষ্য গুরুর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তখন সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ থাকে, কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না।

Sri Yukteswar and Paramahansa Yogananda in 1935

আমার গুরুর সাথে আমার যে সম্পর্ক ছিল এই পৃথিবীতে তার চেয়ে বড়ো আর কোনো সম্পর্কের কথা আমি ভাবতে পারি না। গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক হল প্রেমের সর্বোচ্চ রূপ। একবার আমি তাঁর আশ্রম থেকে এই ভেবে বেরিয়ে গিয়েছিলাম যে হিমালয়ে ভগবানকে আরও ভালোভাবে খুঁজতে পারব। আমার ভুল হয়েছিল; এবং খুব তাড়াতাড়ি আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি ভুল করেছি। তবুও যখন আমি ফিরে এলাম, তিনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করলেন যেন আমি কখনও আশ্রম ছেড়ে যাইনি। তাঁর অভ্যর্থনা খুব স্বাভাবিক ছিল; আমাকে তিরস্কার করার পরিবর্তে, তিনি শান্তভাবে বললেন, “চলো দেখি আজ সকালে কী খেতে পাওয়া যায়।”

আমি বললাম, “কিন্তু গুরুদেব, আমি চলে যাওয়ায় আপনি রাগ করেন নি?”

তিনি বললেন, “কেন রাগ করব? আমি কারো থেকে কিছু আশা করি না, তাই তাদের কার্যকলাপ আমার ইচ্ছার বিরোধী হতে পারে না। আমি নিজের স্বার্থে তোমাকে ব্যবহার করব না; তোমার প্রকৃত সুখেই আমার সুখ।”

তিনি যখন এই কথাটি বললেন, আমি তাঁর পায়ে পড়ে কেঁদে বললাম “জীবনে প্রথম একজনকে পেলাম যে আমাকে সত্যি ভালোবাসে!”…

ভগবানের খোঁজে আমার আশ্রম থেকে পালানো সত্ত্বেও আমার জন্য তাঁর ভালোবাসার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় নি। তিনি আমাকে বকলেনও না… আমি কখনও কল্পনাও করতে পারিনি যে আমার জন্য কেউ এতটা ভাববে। তিনি আমাকে শুধু আমার জন্যই ভালোবেসেছিলেন। আমি যেন ত্রুটিহীন হই, তাই তিনি চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আমি পরমসুখী হই। তাতেই তাঁর সুখ ছিল। তিনি চেয়েছিলেন যে আমি যেন ভগবানকে জানি; যেন জগন্মাতার সান্নিধ্য পাই, যাঁর জন্য আমার হৃদয় ব্যাকুল ছিল।

এটাই কি তাঁর দিব্য প্রেম ছিল না? সর্বদা মঙ্গল এবং প্রেমের পথে আমাকে পরিচালিত করতে চাওয়া? যখন গুরু ও শিষ্যের মধ্যে সেই প্রেম গড়ে ওঠে, তখন শিষ্যের গুরুকে প্রভাবিত করার কোনো ইচ্ছা থাকে না, গুরুও শিষ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করেন না। সর্বোচ্চ যুক্তি এবং বিচার তাদের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে; এরকম আর কোনো প্রেম হয় না। আমি আমার গুরুর কাছে সেই প্রেমের স্বাদ পেয়েছি।

গুরু হলেন জাগ্রত ঈশ্বর, শিষ্যের মধ্যে ঘুমন্ত ঈশ্বরকে জাগিয়ে তোলেন। সহানুভূতি এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে, একজন প্রকৃত গুরু শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে যারা অভাবগ্রস্ত, তাদের মধ্যে ভগবানকে কষ্ট পেতে দেখেন এবং সেই কারণেই তিনি তাদের সাহায্য করাকে তাঁর এক আনন্দদায়ক কর্তব্য বলে মনে করেন। তিনি দরিদ্রদের মধ্যে ক্ষুধার্ত ঈশ্বরকে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন, অজ্ঞদের মধ্যে ঘুমন্ত ঈশ্বরকে জাগিয়ে তোলেন, শত্রুদের মধ্যে অচেতন ঈশ্বরকে ভালোবাসেন এবং আকুল ভক্তদের মধ্যে অর্ধঘুমন্ত ঈশ্বরকে জাগিয়ে তোলেন। প্রেমের মৃদু স্পর্শে, তিনি মুহূর্তের মধ্যে উন্নত সাধকের অন্তরে প্রায় সম্পূর্ণ জাগ্রত ঈশ্বরকে জাগ্রত করেন। গুরুই সকল মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। স্বয়ং ভগবানের মতো, তাঁর উদারতার কোনো সীমা নেই।

গুরুর অঙ্গীকার

যারা যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া-তে প্রকৃতই অন্তর থেকে আধ্যাত্মিক সাহায্যের জন্য এসেছে, তারা ঈশ্বরের কাছ থেকে যা চায় তা পাবে। আমার শরীর থাকতে, বা তার পরেও, ওয়াইএসএস গুরুপরম্পরার মাধ্যমে ঈশ্বরের শক্তি ভক্তদের মধ্যে একইভাবে প্রবাহিত হবে এবং তাদের মুক্তির কারণ হবে…

ওয়াইএসএস শিক্ষার অনুশীলনে নিয়মিত এবং নিষ্ঠাবান সকল ভক্তই তাদের জীবনকে পবিত্র এবং রূপান্তরিত হতে দেখতে পাবে। অধ্যবসায় এবং স্থিরতার মাধ্যমে এই পথের প্রকৃত ভক্তেরা মুক্তি লাভ করবে। ওয়াইএসএস-এর পদ্ধতিসমূহ এবং শিক্ষাবলির মধ্যে ওয়াইএসএস গুরুপরম্পরার সাহায্য এবং আশীর্বাদ নিহিত আছে। যে সব ভক্তেরা ওয়াইএসএস-এর নীতি অনুসারে তাদের জীবন পরিচালনা করবে তারা ওয়াইএসএস পরম্পরার গুরুদের পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনা লাভ করবে। চিরজীবী বাবাজি সমস্ত নিষ্ঠাবান ওয়াইএসএস ভক্তদের আধ্যাত্মিক অগ্রগতি রক্ষা এবং পরিচালনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। লাহিড়ী মহাশয় এবং শ্রীযুক্তেশ্বরজি, যাঁরা তাঁদের শরীর ত্যাগ করেছেন, এবং আমি নিজে, এমনকি আমি দেহ ত্যাগ করার পরেও — সকলেই সর্বদা ওয়াইএসএস/এসআরএফ-এর নিষ্ঠাবান সদস্যদের রক্ষা করব এবং নির্দেশনা দেবো।

Paramahansa Yogananda last smile

ঈশ্বর তোমাদের আমার কাছে পাঠিয়েছেন, আমি কখনোই তোমাদের আশাভঙ্গ করব না… আমি চলে যাওয়ার পরেও, সারা বিশ্বের ভক্তেরা সর্বদাই আমার সাহায্য পাবে, যদি তারা সুর মিলিয়ে চলে। এক মুহূর্তের জন্যও ভেবো না যে আমি তোমাদের সঙ্গে পার্থিব শরীরে উপস্থিত নেই বলে আমি তোমাদের সাথে নেই। আমি যখন এই দেহে থাকব না তখনও তোমাদের আধ্যাত্মিক কল্যাণের জন্য আমি ততটাই গভীরভাবে উদ্বিগ্ন থাকব যতটা আমি এখন আছি। আমি সর্বদা তোমাদের প্রত্যেকের উপর নজর রাখব, এবং যখনই একজন প্রকৃত ভক্ত তার আত্মার নীরব গভীরে আমার কথা ভাববে, তখন সে বুঝতে পারবে যে আমি কাছেই আছি।

আরও জানতে হলে:

এই শেয়ার করুন