ভগবদগীতার গূঢ় তত্ত্ব

ভগবদগীতার ওপর পরমহংস যোগানন্দের উচ্চ প্রশংসিত দুই খন্ডের ভাষ্য থেকে উদ্ধৃত: গড টকস উইথ অর্জুন ­— দ্য ভগবদগীতা

 

ভগবদগীতা: এক সর্বজনীন ধর্মগ্রন্থ

গীতার কালজয়ী ও সর্বজনীন বার্তা হল এর অন্তর্নিহিত সর্বব্যাপী সত্যের প্রকাশ।

ভগবদগীতার অর্থ “পরমাত্মার গান”, সত্যোপলব্ধির উদ্দেশ্যে মানুষ ও তার স্রষ্টার মধ্যে দিব্য সংযোগ, আত্মার মাধ্যমে পরমাত্মার শিক্ষাদান যা অবিরত গীত হওয়া উচিত… গীতার শুধুমাত্র ৭০০ সংক্ষিপ্ত শ্লোকের অসীম জ্ঞানভান্ডারের মধ্যে বিশ্বের সকল মহান ধর্মগ্রন্থের অন্তর্নিহিত প্রকৃত সত্যের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।

নিখিল মহাবিশ্বের জ্ঞান গীতায় পরিপূর্ণ। অতলস্পর্শী অথচ প্রশান্তিদায়ক সৌন্দর্য ও সারল্যপূর্ণ জ্ঞানগর্ভ ভাষায় সুব্যক্ত, গীতার জ্ঞান মানবিক কর্ম ও আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টার সকল স্তরে প্রতীত ও প্রযুক্ত হয়েছে — ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি ও চাহিদাযুক্ত ব্যাপক বৈচিত্রপূর্ণ মানব জাতির আশ্রয়দাতা রূপে। যখনই কেউ ঈশ্বরের কাছে প্রত্যাবর্তনের যাত্রা করবে, গীতা সেই পথে তার আলোক বিকীর্ণ করবে।

গীতার যোগীয় প্রতীকী তাৎপর্য ও রূপকের মর্মোদ্ঘাটন

Krishna and Arjuna on chariot (Rath)ইতিহাসে প্রতীকবিদ্যার সঙ্গে সুপ্রাচীন পবিত্র রচনাবলির কোনো সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশিত হয় না; বরং শাস্ত্রীয় উন্মোচনের ঐতিহ্যানুসারে তারা প্রায়ই আন্তঃমিলিত হয়ে যায়। ধর্মগুরুরা সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক তত্ত্বের বর্ণনায় দৈনন্দিন জীবনের উদাহরণ এবং তাঁদের সমসাময়িক ঘটনাবলি থেকে উপমা চিত্রিত করেন। সহজ সরল ভাষায় বর্ণিত না হলে সাধারণ মানুষ ঐশ্বরিক গভীরতা অনুধাবন করতে পারে না। সেজন্য শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতরা প্রায়শই পরমাত্মার গভীরতম প্রকাশকে অজ্ঞ, আধ্যাত্মিকভাবে অপরিণত মনের মানুষের থেকে গোপন করার জন্য গূঢ় রূপকালঙ্কার ও উপমা সহযোগে রচনা করতেন।

এইভাবে ভগবদ গীতা মহর্ষি ব্যাস দ্বারা উপমা, রূপক ও অর্থালঙ্কার ব্যঞ্জিত ভাষ্যে মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক সত্যের সঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি সংযুক্ত করে অতি চাতুর্যের সঙ্গে রচিত হয়েছে যা বিষয়ী ও আধ্যাত্মিক উভয় ব্যক্তিরই অন্তর্দ্বন্দ্বরত টালমাটাল অবস্থাকে শব্দালঙ্কারের মাধ্যমে পরিবেশন করে। তিনি নিগূঢ় আধ্যাত্মিক অর্থাবলিকে অন্ধকার যুগের অজ্ঞতার বিধ্বংসী প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য প্রতীকবিদ্যার কঠিন আবরণ দ্বারা গোপন করেছিলেন, যে যুগে পৃথিবীতে শ্রীকৃষ্ণ অবতারের পরিসমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতারও অধঃপতন হয়েছিল।

 
para-ornament

ভগবদগীতায় অর্জুনের প্রতি ভগবান কৃষ্ণের বাণী যোগবিজ্ঞানের এক অসামান্য ধর্মগ্রন্থ, ঈশ্বর সংযোগ এবং দৈনন্দিন জীবনের এক গাথা। শিক্ষার্থীরা অর্জুনের মতো ধাপে ধাপে আধ্যাত্মিক সংশয়ের নশ্বর চেতনা ও দুর্বলচিত্ততা থেকে ঐশ্বরিক সমন্বয় ও অন্তস্থ সমাধানে উন্নীত হয়।

ভগবদগীতা — একটি আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ — মুক্তির পথে সেই সকল অভিজ্ঞতার বর্ণন করে যা আধ্যাত্মিক পথিকদের সম্মুখীন হতে হবে…ভক্ত নিঃশঙ্ক চিত্তের অবস্থায় পৌঁছোনর জন্য সংগ্রাম করতে থাকে [এবং] বিরুদ্ধ চিত্তের অবস্থা ভক্তকে ভগ্নোদ্যম করে অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে। “প্রথমে সতর্ক হলে পরে প্রস্তুত থাকতে পারা যায়!” প্রকৃত পথ অনুধাবনকারী ভক্ত অনিবার্য বৈপরীত্যে কখনোই অনিশ্চিত ও হতাশ না হয়ে অবশ্যই এগিয়ে চলেন।

দৈনন্দিন জীবনের আধ্যাত্মিক সংগ্রাম ও পরম বিজয়

ভগবদগীতার কালজয়ী বার্তা একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ ছাড়াও শুভ ও অশুভের চিরকালীন মায়ার দ্বন্দ্বকেও সূচিত করে: জীবন হল পরমাত্মা ও জড়জগৎ, আত্মা ও দেহ, জীবন ও মৃত্যু, জ্ঞান ও অজ্ঞতা, স্বাস্থ্য ও ব্যাধি, নিত্যতা ও ক্ষণস্থায়ীত্ব, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও প্রলোভন, বৈষম্য এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন মন — এদের মধ্যে যুদ্ধের ধারাবাহিকতা…

ভক্তের জীবন কতটা অহংচালিত অজ্ঞতা (মায়া) ও দৈহিক চেতনার অধীন এবং কতটা আত্মজ্ঞান ও দিব্য প্রকৃতি প্রকাশে সক্ষম তা নির্ধারণের জন্য তাকে নিয়মিত মানসিক ও শারীরিক কার্যাবলি বিশ্লেষণ করা উচিত।

সুনির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক ও মনোদৈহিক পদ্ধতি এবং নিয়মাবলির মাধ্যমে নিজের প্রকৃত সত্ত্বার প্রতি সচেতনতার অনুশীলন ও স্থিরীকরণের প্রক্রিয়াই হল যোগীয় ধ্যান যার দ্বারা সংকীর্ণ আত্ম-অহংকার, মানবিক সচেতনতার বংশগত ত্রুটি, আত্মসচেতনতার মাধ্যমে দূরীভূত হয়।

প্রত্যেক ব্যক্তিকেই জীবনের কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে হয়। এটি কেবল জেতার যোগ্য একটি যুদ্ধই নয়, বরং মহাবিশ্ব এবং ঈশ্বর ও মানবাত্মার চিরস্থায়ী সম্পর্কের দৈব নির্দেশবাহী এমন এক যুদ্ধ যা আজ হোক বা কাল অবশ্যই জিততে হবে।

পবিত্র ভগবদগীতা অনুসারে দ্রুততম বিজয়প্রাপ্তি সেই ভক্তের জন্যই নিশ্চিত যে অর্জুনের মতো পরমাত্মার প্রজ্ঞাপূর্ণ গীত শ্রবণার্থে যোগীয় ধ্যানের দিব্য বিজ্ঞানের উদ্যমী অভ্যাস করবে।

গীতার সুষম পথ: ধ্যান ও সঠিক কর্ম

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবন কর্মত্যাগ না করার আদর্শকেই উপস্থাপন করে — যা কর্মময় জীবনে সীমাবদ্ধ মানুষের কাছে এক পরস্পরবিরোধী মতবাদ — কিন্তু অবশ্যই কর্মফলের পার্থিব আকাঙ্খার বিসর্জন দিয়ে. . . মানুষকে অবিচল ধ্যান দ্বারা মনকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যাতে সে অন্তরে ঈশ্বরচেতনাকে অক্ষুন্ন রেখে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় কর্তব্যকর্ম সম্পন্ন করতে পারে…

ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণের বার্তা আধুনিক যুগসহ যে কোনো যুগের জন্য এক যথার্থ সমাধান: কর্তব্যনিষ্ঠ কর্ম, অনাসক্তি এবং ঈশ্বরোপলব্ধির জন্য ধ্যানের যোগ। অন্তরে ঐশ্বরিক শান্তি ভিন্ন কর্ম সম্পাদন নরকের সমান; অন্তরে উত্থিত ঐশ্বরিক আনন্দের সঙ্গে কর্ম সম্পাদনের অর্থ যে কোনো স্থানে নিজ অন্তরে এক সুবহ স্বর্গ বহন করা।

ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ প্রস্তাবিত মার্গ বিশ্বের কর্মব্যস্ত ব্যক্তি ও চরম আধ্যাত্মিক উচ্চাকাঙ্খী উভয়ের জন্যই এক পরিমিত, মধ্যম, স্বর্ণালি পথ। সর্বজনীন আত্মোপলব্ধির এক গ্রন্থ, ভগবদগীতা প্রদর্শিত মোক্ষলাভের পথ অনুসরণ করে মানুষ তার প্রকৃত সত্ত্বা, আত্মার সাথে পরিচিত হতে পারে — যা তাকে দেখায় যে সে কিভাবে পরমাত্মা থেকে সৃষ্ট হয়েছে, কিভাবে সে পৃথিবীতে তার ধর্মনিষ্ঠ কর্তব্যসমূহ সম্পাদন করতে পারে এবং কিভাবে সে আবার পরমপিতার কাছে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। গীতার জ্ঞান শুষ্ক বুদ্ধিজীবীদের জন্য এক মানসিক ব্যায়াম নয়, এর বাণী ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের জন্য বিনোদনের মাধ্যম নয়; বরং এই জ্ঞান নারী-পুরুষ, সংসারী-সংসারত্যাগী নির্বিশেষে বিশ্বের সকলকে যোগের ক্রম পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে প্রকৃত ঈশ্বর সংযোগের দ্বারা সুষম জীবনযাপনের পথ প্রদর্শন করে।

রাজযোগের সনাতন বিজ্ঞান

বিশ্বস্রষ্টা সৃষ্টির সূচনায় ও মানবজাতির আগমনে তাঁর মেধাবী সৃজনশীল মহাজাগতিক শক্তি (মহাপ্রকৃতি অথবা পবিত্র আত্মা) শুধুমাত্র বিকর্ষক শক্তির সঙ্গেই সম্পৃক্ত করেননি — আত্মা এবং বস্তুজগতের মধ্যে মহাজাগতিক চেতনার স্বতন্ত্রীকরণে — পরমাত্মার সঙ্গে পুনর্মিলনের জন্য বস্তুজগতে বিচরণরত ভবঘুরে আত্মাদের পুনরাহ্বান শক্তিকেও পরিব্যাপ্ত করেছেন। বিশ্বের সকল বস্তু এই সৃজনশীল মহাজাগতিক শক্তি থেকেই আসে, সৃষ্ট হয়, স্থিতিলাভ করে এবং পরিশেষে সেখান থেকে পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়। উত্তরণ, অবতরণের ঠিক বিপরীত ধারা অনুসরণ করে। মানুষের ক্ষেত্রে সেই পথ হল অন্তঃস্থিত অনন্তমুখী রাজপথ, যা যুগে যুগে সর্বধর্মের সাধকদের জন্য ঈশ্বরমিলনের একমাত্র গমনপথ।

বিশ্বাস ও অনুশীলনের যে কোনও উপপথ বেয়ে প্রত্যেকেই সেই অভিন্ন একক রাজপথে পৌঁছোয়, দেহ চেতনা থেকে পরমাত্মায় অন্তিম আরোহণ: বস্তু চেতনাকে প্রাণশক্তিতে, প্রাণশক্তিকে মনে, মনকে আত্মায় এবং আত্মাকে পরমাত্মায় বিলীন করে সূক্ষ্ম মস্তিস্ক-সুষুম্না কেন্দ্রস্থিত আলোকদ্বারের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়চেতনা থেকে জীবন ও সচেতনতার ঊর্দ্ধমুখী অপসরণ। রাজযোগ হল উত্তরণের পদ্ধতি এবং সেই শাশ্বত বিজ্ঞান যা সূচনালগ্ন থেকে অখণ্ড সৃষ্টিরূপে বিরাজ করছে।

 

গীতার অধ্যায় ৪:২৯ ও ৫:২৭–২৮-তে উল্লিখিত অর্জুনকে শেখানো শ্রীকৃষ্ণ প্রদত্ত ক্রিয়াযোগ পদ্ধতি হল যোগীয় ধ্যানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান। জড়বাদী যুগ থেকে সুরক্ষিত এই অক্ষয় যোগ আধুনিক যুগের মানুষের জন্য মহাবতার বাবাজি কর্তৃক পুনরুজ্জীবিত হয়েছে এবং সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ/যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া-র গুরুগণ কর্তৃক শেখানো হয়েছে। বাবাজি স্বয়ং আমাকে (পরমহংস যোগানন্দ) ঈশ্বর-সংযোগের এই পবিত্র বিজ্ঞান প্রচারের জন্য নিযুক্ত করেছেন…।

যে ভক্ত — আদর্শ শিষ্যের উদাহরণ — অর্জুনকে অনুকরণ করবে এবং অনাসক্ত থেকে তার ন্যায়নিষ্ঠ কর্তব্য পালন করবে ও ক্রিয়াযোগের মতো পদ্ধতির মাধ্যমে যোগীয় ধ্যানের যথাযথ অনুশীলন করবে, সে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও পথনির্দেশ লাভ দ্বারা আত্মোপলব্ধিতে বিজয়ী হবে।

অর্জুনের মতো ভগবান তোমার সঙ্গেও কথা বলবেন। যেমন তিনি অর্জুনের আত্মিক চেতনাকে উত্থিত করেছিলেন, সেরকম তোমাকেও উন্নীত করবেন। অর্জুনকে তিনি যেমন সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক দৃষ্টি প্রদান করেছিলেন, সেরূপ তোমাকেও জ্ঞানালোক প্রদান করবেন।

ভগবদগীতায় আমরা আত্মার ঈশ্বরের কাছে প্রত্যাবর্তনের কাহিনী দেখতে পাই — যে যাত্রা প্রত্যেকেরই করা উচিত। হে দিব্য আত্মা! অর্জুনের মতো, “হৃদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতাকে (নশ্বর চেতনার) পরিত্যাগ করো। জাগো!” তোমার সামনে এই রাজকীয় পথ।

গড টকস উইথ অর্জুন-এ শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ বর্ণিত ভগবদগীতার প্রজ্ঞার ওপর বরিষ্ঠ ওয়াইএসএস সন্ন্যাসীদের আলোচনা শোনার জন্য নিচের বোতামে ক্লিক করুন:

এই শাশ্বত ধর্মগ্রন্থের আপনার কপিটি সংগ্রহ করুন:

এই শেয়ার করুন