যোগী কথামৃত-র ৫০তম বার্ষিকীতে (১৯৯৬), পরমহংস যোগানন্দ-র কিছু ঘনিষ্ঠ শিষ্য, যাঁরা তখনও জীবিত ছিলেন, সেই দিনটির স্মৃতিচারণ করেছিলেন যেদিন এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এবং তাঁদের জীবনে তার কী গভীর প্রভাব পড়েছিল। তাঁরাই প্রথম এই গ্রন্থের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা ঐশ্বরিক জ্ঞান, প্রেম ও রূপান্তরকারী দৃষ্টিভঙ্গি অনুভব করেন—যা তখন থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে।

যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এর তৃতীয় অধ্যক্ষ, ১৯৫৫–২০১০
গুরুদেব বলেছিলেন: “আমি যখন এই পৃথিবী ছেড়ে যাব, তখন এই বই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বদলে দেবে। আমি যখন থাকব না এটিই আমার বার্তাবাহক হবে।”
অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি গ্রন্থ রচনা এমন একটি প্রকল্প ছিল যা সম্পূর্ণ করতে পরমহংসজির বহু বছর সময় লেগেছিল। ১৯৩১-এ যখন আমি মাউন্ট ওয়াশিংটনে এসেছিলাম, তিনি ইতিমধ্যেই এর কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। একবার যখন আমি তাঁর অধ্যয়নকক্ষে সচিবের কাজে তাঁকে সহায়তা করছিলাম, তখন আমি তাঁর লেখা প্রথম দিকের একটি অধ্যায় দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম — সেটি ছিল “দ্য টাইগার স্বামী” সম্পর্কে। গুরুদেব আমাকে সেটি সংরক্ষণ করতে বলেছিলেন কারণ এটি একটি গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হবে।
তাঁর আত্মজীবনীর বেশিরভাগ অংশই ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫-এর মধ্যে রচিত হয়। পরমহংসজির দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা এত বেশি ছিল যে প্রতিদিন বই লিখতে পারতেন না; তবে সাধারণত সন্ধ্যাবেলা ও অবসর সময়ে তিনি এই কাজে মন দিতে পারতেন।
আমাদের ছোট্ট দলটি — আনন্দমাতা (নীচে), শ্রদ্ধামাতা ও আমি — প্রায়ই সেই সময় তাঁর আশেপাশে থাকতাম, পান্ডুলিপি টাইপ করতে সাহায্য করতাম। প্রতিটি অংশ টাইপ হওয়ার পর, গুরুদেব তা তাঁর সম্পাদক তারা মাতাকে দিতেন।
একদিন আত্মজীবনী লেখার সময় গুরুদেব আমাদের বলেছিলেন: “আমি যখন এই পৃথিবী ছেড়ে যাব, তখন এই বই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বদলে দেবে। আমি যখন থাকব না এটিই আমার বার্তাবাহক হবে।”
যখন পাণ্ডুলিপিটি শেষ হল, তারা মাতা এর জন্য প্রকাশক খুঁজতে নিউ ইয়র্কে গেলেন। পরমহংসজি তাঁর জ্ঞান ও সম্পাদনার দক্ষতার জন্য তাঁকে অত্যন্ত সম্মান করতেন এবং প্রকাশ্যে তাঁর প্রশংসা করতেন। তিনি বলেছিলেন: “এই বইয়ের জন্য [তিনি] যা করেছেন, তা আমি বর্ণনাও করতে পারব না। নিউ ইয়র্কে যাবার আগে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তবুও সেই অবস্থায় তিনি নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন। তাঁর জন্যই বইটি প্রকাশ পেল।”
বই সম্পূর্ণ হওয়ার পর গুরুদেব যে আনন্দে ভেসেছিলেন সেই প্রতিক্রিয়া ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তিনি আমাকেও একটি স্বাক্ষরিত কপি দিয়েছিলেন, যেমন দিয়েছিলেন অনেক ভক্তদের যারা এখানকার আশ্রমবাসী ছিলেন। আমি যখন এটি পেলাম, আমি জানতাম, যেহেতু এই পান্ডুলিপি টাইপে সাহায্য করেছিলাম, যে এটি একটি অমর গ্রন্থ হতে চলেছে — এমন এক গ্রন্থ যা প্রথমবার সেই গুপ্ত সত্যকে উন্মোচন করেছে যা এর আগে এত স্বচ্ছ, অনুপ্রেরণামূলকভাবে কখনো প্রকাশিত হয়নি। এই বইয়ের পৃষ্ঠায় যা আছে, পুনর্জন্ম, কর্ম, অলৌকিক ঘটনা, মৃত্যুর পর জীবন এবং অন্যান্য অসাধারণ আধ্যাত্মিক সত্য — এই বিষয়গুলোতে অন্য কোনো লেখক গুরুদেবের ব্যাখ্যার মতো করে তুলে ধরেননি।
আজ যদি তিনি এই বইয়ের খ্যাতির কথা জানতেন তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হোত? তিনি বিনয়ের সঙ্গে অভিভূত হতেন যে যোগী-কথামৃত পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে, প্রতিটি সংস্কৃতি, ধর্ম ও বয়সের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে এবং এই পঞ্চাশ বছর ধরে তা অতুলনীয় সমাদর ও উৎসাহ পেয়ে এসেছে। তিনি যদিও কখনই নিজেকে বড়ো করে ভাবতেন না, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন যা তিনি লিখে গেছেন তার অসাধারণ মূল্য রয়েছে কারণ তিনি জানতেন যে তিনি সত্য লিখছেন।
তারা মাতা (লরি প্র্যাট)-র জন্য স্বাক্ষরিত বই। যোগী-কথামৃত-র লেখকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ অংশে পরমহংসজি তাঁর পান্ডুলিপি সম্পাদনায় তারা মাতার অবদানের জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বইয়ের যে কপিটি তিনি তাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন, সেখানে তার উক্তি থেকে এই মূল্যবান শিষ্যার সেবার প্রতি গুরুদেবের গভীর সম্মান ও ভালোবাসা বোঝা যায়।


আমাদের লরি প্র্যাট
“ঈশ্বর ও গুরুগণ এই বইটি প্রকাশে তোমার সাহসী ও প্রেমময় ভূমিকার জন্য তোমাকে আশীর্বাদ করুন। পি.ওয়াই।”
“অবশেষে ঈশ্বর, আমার গুরু ও মহাপুরুষদের পবিত্র সুবাস আমার আত্মার গোপন দরজা পেরিয়ে বাইরে এসেছে — অগুন্তি সমস্যার পর লরি প্র্যাট ও অন্যান্য শিষ্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সকল বাধা এবং অসুবিধা এখন আনন্দের চিরন্তন শিখায় দগ্ধ হচ্ছে।”

যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এর চতুর্থ অধ্যক্ষ, (২০১১-২০১৭)
“অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি এক দিব্য গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছিল, যা শেষ পর্যন্ত গুরুর আশীর্বাদ এবং ঈশ্বরের প্রতি প্রেমকে লক্ষ লক্ষ অন্বেষণকারী আত্মার কাছে পৌঁছে দেবে।”
১৯৪৬-এর শেষদিকে এক সন্ধ্যায়, এনসিনিটাস আশ্রমে, আমরা কয়েকজন নবীন শিষ্য রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত ছিলাম যখন গুরুদেব দরজা দিয়ে ঢুকলেন। আমাদের সমস্ত কাজ থেমে গেল এবং আমাদের সমস্ত মনোযোগ তাঁর মুখভর্তি হাসি আর তার থেকেও বেশি সুন্দর স্বাভাবিকের থেকে উজ্জ্বল তাঁর চোখের দীপ্তির দিকে একাগ্র হল। তাঁর হাত দুটি তাঁর পিছনে ছিল যেন “কিছু” লুকিয়ে রেখেছিলেন। তিনি আরও সবাইকে আসতে বললেন এবং তাঁর সামনে সারিবদ্ধ হতে বললেন। তারপর সেই গোপন বস্তুটি আমাদের সামনে আনলেন — তাঁর লেখা অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি বইয়ের একটি অগ্রিম কপি।
“ওহ!” আর “আহ!” শব্দের মাঝে আমরা আমাদের আনন্দের প্রকাশ ঠিকভাবে করতে পারছিলাম না, যখন অবশেষে আমরা বহু প্রতীক্ষিত সেই গ্রন্থটি দেখতে পেলাম —গুরুদেবের জীবনের সেই অধ্যায়, যেখানে তিনি ভারতের মহান সাধু-সন্তদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে কাটানো মূল্যবান সময়ে যা শুনিয়ে তিনি আমাদের বহুবার মুগ্ধ করেছেন। তিনি বইটির কয়েকটি পৃষ্ঠা খুলে দেখালেন, শেষের জন্য তুলে রাখলেন মহাবতার বাবাজির ছবি। প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমরা শ্রদ্ধাভরে সেই ছবি দেখলাম এবং আশীর্বাদ অনুভব করলাম— আমরা সেই সৌভাগ্যবান, যাদের প্রথমবার আমাদের সেই পরম-পরম-পরমগুরুর প্রতিচ্ছবি দেখার সুযোগ হয়েছে।
ডিসেম্বরের শুরুতে, আমাদের সবাইকে মাউন্ট ওয়াশিংটনে ডাকা হল — বই প্রকাশকের থেকে আসা প্যাকেটগুলির আগমনে অংশ নিতে এবং সেই বহু প্রতীক্ষিত বই উৎসুক ভক্তদের কাছে পাঠানোর প্রস্তুতিতে সহায়তা করতে — শত শত ব্যাক-অর্ডার ছিল। কয়েক সপ্তাহ আগেই, যখনই কারও হাতে একটু সময় মিলতো, আমরা পুরনো ম্যানুয়াল টাইপরাইটারে ঠিকানার লেবেল টাইপ করে রাখতাম। অফিসে বড়ো বড়ো টেবিল (আসলে করাত-মেশিনের ওপর চওড়া কাঠের তক্তা বসানো) বসানো হয়েছিল, যাতে করে একটার পর একটা বই সযত্নে মোড়া যায় বড়ো রোল থেকে বাদামি কাগজ কেটে, ঠিক মাপমতো কেটে বই মোড়ানো হোত, তারপর ভেজা স্পঞ্জে স্ট্যাম্প ভিজিয়ে লেবেল আর টিকিট সাঁটা হতো। তখন কোনো স্বয়ংক্রিয় মেল করার মেশিন ছিল না! কিন্তু সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের এই স্মরণীয় ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের মুহূর্তে অংশগ্রহণ করতে পারা কী অসাধারণ আনন্দ ছিল। বিশ্ব আমাদের আশীর্বাদপ্রাপ্ত গুরুদেবকে এই মহান দূতের মাধ্যমে জানতে পারবে।
চার তলার বসার ঘরে গুরুদেব টানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে একের পর এক বইতে টানা স্বাক্ষর করছিলেন। প্রকাশকের পাঠানো কার্টন থেকে বইগুলো বের করে, খুলে, তাঁর সামনে ধারাবাহিকভাবে পর পর রাখা হতো — তিনি একে একে স্বাক্ষর করতেন, একটি কলম খালি হলে তৎক্ষণাৎ আরেকটি ভরে দেওয়া হতো।
রাত গভীর হলে তিনি আমাকে ওপরে ডেকে পাঠালেন। তখনও তিনি স্বাক্ষর করেই চলেছেন। প্রবীণ শিষ্যরা বারবার তাঁকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করছিলেন, কিন্তু তিনি কোনোভাবেই তা মানতে চাইছিলেন না যতক্ষণ না পুরো চালানের প্রত্যেকটি বই তাঁর স্বাক্ষর দ্বারা আশীর্বাদ প্রাপ্ত হচ্ছে। তাঁর মুখে ছিল অপার্থিব আনন্দের প্রকাশ, যেন নিজের একটি অত্যন্ত মূল্যবান অংশ, ঈশ্বরপ্রেমে পরিপূর্ণ তাঁর আত্মার ছোঁয়া এই বইগুলির মাধ্যমে পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে এবং সেটিকে একটি বাড়তি মুহূর্তের জন্যও দেরি করা ঠিক হবে না।
অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করা যায় না এমন আনন্দে আমরা তাঁর চরণে বসে ভোর রাত অব্দি ধ্যান করলাম। গুরুদেব নিজ হাতে আমাদের প্রত্যেককে এই পরম ধনের একটি করে ব্যক্তিগত কপি উপহার দিয়েছেন এবং বাকি সব কপি ইতিমধ্যেই পাঠানোর জন্য মোড়া হয়েছে, যা সকালে হলিউড ও সান ডিয়েগোর মন্দিরে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত। অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি এখন তার ঐশ্বরিক গন্তব্যের পথে, শেষ অব্দি এই গ্রন্থ লক্ষ লক্ষ অনুসন্ধানী আত্মার কাছে পৌঁছে দেবে গুরুদেবের আশীর্বাদ ও ঈশ্বরপ্রেম।

“আমার মনে আছে, অনেক সময় গুরুদেব সারারাত ধরে বলতে থাকতেন, আর কখনও কখনও তো পুরো দিন, এমনকি তারও বেশি সময় ধরে চলতেই থাকত।”
যখন পরমহংসজি অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি লেখার কাজে রত ছিলেন, তখন এনসিনিটাস আশ্রমে আমাদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজনই বসবাস করছিলাম, এটি ছিল এমন একটি প্রকল্প যা সম্পূর্ণ হতে বহু বছর লেগেছিল। সেই সময়ের একটি অংশে আমিও সেখানে থাকতাম।
গুরুদেব মূলত তাঁর লেখালেখির কাজ আশ্রমের অধ্যয়ন কক্ষে করতেন। আমার মনে আছে, অনেক সময় তিনি সারারাত ধরে বলে যেতেন, আর কখনও কখনও তো পুরো দিন, এমনকি তারও বেশি সময় ধরে বলা চলতেই থাকত। আমি, দয়ামাতা ও আনন্দ মাতা-র মতো সচিবের কাজে সরাসরি যুক্ত ছিলাম না। তাঁরা কখনও গুরুদেবের কথা শর্টহ্যান্ডে লিপিবদ্ধ করতেন, আবার কখনও টাইপরাইটারে টাইপ করতেন। আমার দায়িত্ব ছিল মূলত তাঁদের জন্য রান্না করা, যাতে তাঁরা বিনাবাধায় কাজ করে যেতে পারেন!
যখন অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি বইটি প্রকাশকের কাছ থেকে এসে পৌঁছোল, তখন আমাদের মধ্যে প্রবল আনন্দের সঞ্চার হল। সঙ্গে সঙ্গেই গুরুদেব চাইলেন, যাঁরা আগে থেকেই বইয়ের জন্য অর্ডার দিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে দ্রুত পাঠিয়ে দিতে! সুতরাং, প্রাথমিক উৎসবের পরই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম সেই জমে থাকা অর্ডার পূরণে। সিস্টার শিলা ও আমি বহু কপি বইতে মোড়ক লাগালাম, ডাকটিকিট লাগালাম, আর সেগুলো পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করলাম। এরপর আমরা গাড়িটা নিয়ে এলাম, তার বুট এবং সব দরজা খুলে দিলাম। গাড়ি পুরোপুরি বইয়ের প্যাকেট দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলে আমরা তা নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলসের প্রধান ডাকঘরে রওনা দিলাম। আমরা খুব আনন্দিত ছিলাম: অবশেষে অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি সবার জন্য উপলব্ধ হতে চলেছে!

“আমার হৃদয়ে আমি অনুভব করেছিলাম যে আমি যাকে খুঁজছিলাম, তাকে পেয়ে গেছি, আর আমি স্থির সিদ্ধান্ত নিই যে পরমহংস যোগানন্দের শিক্ষা অধ্যয়ন করব এবং ঈশ্বরকে খুঁজে বের করব।”
আমি তখন কৈশোরের শুরুর দিকে, যখন এক গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে সুইজারল্যান্ডের বড়ো শহরগুলোর একটি, উইন্টারথার শহরের উপকণ্ঠে আমার এক কাকা ও কাকি-র সঙ্গে সময় কাটাতে যাই। আমার কাকা ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ, একটি সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার সদস্য। তিনিও ছুটিতে ছিলেন এবং তাঁর বড়ো বাগানে কাজ করে সময় কাটাচ্ছিলেন। আমি তাঁকে সাহায্য করতাম যেহেতু তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না, তাই কাকা আমার প্রতি গভীর আগ্রহ দেখাতেন। বাগানে কাজের সময় আমরা অনেকক্ষণ ধরে গল্প করতাম। আমি লক্ষ্য করলাম, কাকা প্রাচ্য দর্শনের প্রতি গভীরভাবে অনুরাগী। তিনি কর্ম, পুনর্জন্ম, কারণ ও সূক্ষ্ম জগত এবং বিশেষ করে জ্ঞানপ্রাপ্ত সাধু-সন্তদের সম্পর্কে যেভাবে বলতেন, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম।
তিনি বুদ্ধদেবের কথা বলতেন, কীভাবে তিনি সেই আশীর্বাদপুত চেতনার স্তরে পৌঁছেছিলেন এবং আরও অনেক সাধুর কাহিনি শুনিয়ে আমার হৃদয়ে তাঁদের অনুসরণ করার এক গভীর আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছিলেন। আমার মনে পড়ে কীভাবে আমি ঘুরে বেড়াতাম এবং মনে মনে বারবার জপ করতাম: দীপ্তি, দীপ্তি। যদিও তখন শব্দটির সম্পূর্ণ অর্থ জানতাম না, তবুও জানতাম, এটি এমন কিছু যা সাধারণ মানুষ, সে যতই জাগতিক বা শিল্পক্ষেত্রে সফল হোক, তা অর্জন করতে পারে না। আমি কাকাকে জিজ্ঞেস করতাম, কীভাবে সেই অবস্থা অর্জন করা যায়? তিনি শুধু এটুকু বলতে পারতেন যে এজন্য ধ্যান করতে হবে। কিন্তু কিভাবে, তা তিনি জানতেন না। তিনি বললেন, “একজন গুরু থাকা দরকার, যিনি সব কিছু শেখাতে পারেন।” আমি তাঁকে জানালাম যে আমি এমন একজন গুরুর সঙ্গে দেখা করতে খুবই আগ্রহী, তখন তিনি শুধু মাথা নাড়লেন আর হেসে বললেন, “অভাগা ছেলে, সুইজারল্যান্ডে কোনো গুরু নেই!”
তখন থেকেই আমি গুরুর জন্য প্রার্থনা করতে শুরু করলাম। সেই আকাঙ্ক্ষা এত প্রবল ছিল যে, বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর আমি প্রায়ই ট্রেন স্টেশনে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতাম, ভাবতাম যে “তিনি” আসবেন। কিন্তু কিছুই হতো না।
পড়াশোনা শেষ করার পর আমি আমার বাবার ব্যবসায় হতাশাজনক দুটি বছর কাজ করি। তখন পর্যন্ত আমি হিন্দু দর্শনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম, কারণ মনে হয়েছিল, গুরুকে খুঁজে পাওয়া একেবারে অসম্ভব। আমি শিল্পকলায় একটি কর্মজীবন শুরু করেছিলাম, এবং তিন বছর পর বিখ্যাত স্থপতি ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইটের সাথে অধ্যয়নের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম।
আমেরিকায় আসার প্রথম সপ্তাহেই আমি এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করি, যিনি ১৯২০-র দশকে এখানে চলে এসেছিলেন। কথাবার্তার মাঝে তিনি হিন্দু দর্শনের কথা তোলেন। আমি তাঁকে জানালাম, আমি বহু বছর আগে এই বিষয়ে আগ্রহী ছিলাম, তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অধ্যয়ন কক্ষে আমাকে নিয়ে গেলেন এবং অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি বইটি দেখালেন। বইটির প্রচ্ছদে পরমহংস যোগানন্দের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি কখনও ওঁর নাম শুনেছ?” আমি না বলতেই তিনি বললেন, “আমি জীবনে এত বড়ো মানুষ আর দেখিনি। তিনি একজন সত্যিকারের গুরু!”
আমি বিস্ময়ে চিৎকার করে বললাম, “আপনি ওঁকে দেখেছেন? উনি কোথায় আছেন—আমেরিকায় কি নেই !?”
তিনি বললেন, “হ্যাঁ, উনি লস অ্যাঞ্জেলস-এ থাকেন।” তারপর তিনি জানালেন, কীভাবে তিনি এই দেশে আসার কিছুদিন পরই পরমহংসজির বক্তৃতা ও ক্লাসে যোগ দিয়েছিলেন। আমি ভাবলাম, এই সমস্ত বছর আমি একজন গুরুর জন্য আকুল হয়েছি, অথচ আমার আত্মীয় একজন গুরু এবং তাঁর শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন!
আমি সেই বইটি গলাধঃকরণ করতে শুরু করলাম, এটাই ছিল প্রথম অলৌকিক ঘটনা। এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়ছিলাম যে বুঝতেই পারিনি, আসলে এটাই ছিল অলৌকিক — কারণ আমি যথেষ্ট ইংরেজি জানতাম না যে সেই ভাষায় লেখা বই পড়ে ফেলব। ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইট নিজেও একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন, কিন্তু তার প্রথম দুই পৃষ্ঠা পড়তে গিয়েই আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। সে বই পড়ার উপযুক্ত ইংরেজি শিখতে আমার আরও এক বছর লেগে যায়। অথচ অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি আমি তখনই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলেছিলাম।
আমার হৃদয়ে স্পষ্টভাবে জানতাম, আমি যা খুঁজছিলাম, সেটিই পেয়ে গেছি। আমি স্থির সিদ্ধান্ত নিই, পরমহংস যোগানন্দের শিক্ষার অনুসরণ করব এবং ঈশ্বরকে খুঁজে পাবো।
কয়েক মাস পরে, যখন আরও ভালোভাবে ইংরেজি শিখে ফেলেছি, তখন আমি লস অ্যাঞ্জেলস যাওয়ার সুযোগ পাই গুরুদেবের দর্শনের আশায়। যখন আমি মাদার সেন্টারের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করি, এক অপার্থিব শান্তি অনুভব করি, এমন শান্তি আমি এর আগে কোথাও অনুভব করিনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমি এক পবিত্র ভূমিতে পা রেখেছি।
রবিবার সকালে আমি হলিউড মন্দিরে পরমহংসজির প্রভাতী সৎসঙ্গে যোগ দিই। সেটিই ছিল প্রথমবার, আমি তাঁকে সামনাসামনি দেখব। এ এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। অনুষ্ঠানের শেষে গুরুদেব একটি চেয়ারে বসেন, আর বেশিরভাগ ভক্ত তাঁর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে যান। আমি যখন লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, আমি কেমন বোধ করছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। অবশেষে যখন আমি তাঁর সামনে দাঁড়াই, তিনি আমার হাত ধরেন, আমি তাঁর গভীর, দীপ্তিময়, কোমল চোখের দিকে তাকাই। কোনো শব্দ বিনিময় হয়নি। কিন্তু আমি অনুভব করলাম, এক অবর্ণনীয় আনন্দ যেন তাঁর হাত ও দৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমার মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে।
মন্দির থেকে বেরিয়ে আমি এক প্রকার ঘোরের মধ্যেই সানসেট বুলেভার্ড ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। এতটাই আনন্দে আত্মহারা ছিলাম যে সোজা হাঁটতেও পারছিলাম না, মাতালের মতো দুলছিলাম। শুধু তা-ই নয়, আমি নিজের মধ্যে আনন্দ ধরে রাখতে পারছিলাম না, বারবার জোরে হেসে উঠছিলাম। পথচলতি মানুষজন অবাক হয়ে তাকাচ্ছিলেন; কেউ কেউ পথ ছেড়ে এক পাশে সরে যাচ্ছিলেন, বিরক্তভাবে মাথা নেড়ে ভাবছিলেন, রবিবার সকাল সকাল মদ্যপান! আমি পরোয়া করিনি। জীবনে এর চেয়ে আনন্দ আমি কখনও অনুভব করিনি।
এই ঘটনার কিছুদিন পরেই আমি সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ আশ্রমে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করি।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো তিনি এক বার বসেই পুরো বইটি পড়ে ফেললেন। লেখকের অতুলনীয় আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা উপলব্ধি করে, যেটি এর আগে তিনি আর কারও মধ্যে দেখেননি, স্বামী প্রেমময় পরমহংস যোগানন্দজিকে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন।
পরমহংস যোগানন্দের পঁয়ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ের সন্ন্যাসী শিষ্য এবং সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এর প্রতিভূ, স্বামী প্রেমময়, ১৯৯০-তে তাঁর মহাপ্রয়াণ পর্যন্ত সংঘের তরুণ সন্ন্যাসীদের আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁদের কাছে তিনি এই গল্পটি শুনিয়েছিলেন।
স্বামী প্রেমময় স্লোভেনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। রাজপরিবার এবং প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক যোগাযোগের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে তাঁর মাতৃভূমি কমিউনিস্টদের দখলে চলে যাওয়ার পর তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। ১৯৫০-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর তাঁকে আমেরিকায় অভিবাসনের জন্য আমন্ত্রণ জানায়।
১৯৫০-এর শরৎকালে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে জাহাজ যাত্রার ঠিক আগে, স্বামী প্রেমময় পারিবারিক পুরনো বন্ধু ইভেলিনা গ্লানজম্যান-এর কাছ থেকে একটি বিদায় উপহার পান। উপহারটির আকার দেখে তিনি মনে করেছিলেন এটি সম্ভবত একটি মিষ্টির বাক্স এবং জাহাজে উঠে তিনি তা সহযাত্রীদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য এটি খুলে দেখেন। বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি দেখলেন, এটি আসলে মিষ্টির বাক্স নয়, বরং একটি বই — অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি।
উপহার পেয়ে আবেগাপ্লুত হলেও, প্রেমময়জির মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে বইটি পড়ার আগ্রহ জাগেনি। যদিও তিনি অল্প বয়সে প্রচুর বই পড়তেন, সেই দিন তখন অতীত (তিনি পরে বলতেন যে তিনি পনেরো বছর বয়সের আগেই জীবনের বাকি সময়ে যত বই পড়েছেন, তার চেয়ে বেশি পড়ে ফেলেছিলেন)। তাছাড়া, তিনি প্রাচ্য দর্শনের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন, কৈশোরে ভগবদ্গীতা পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং প্রায় পুরোটাই মুখস্থ করেছিলেন। তাই উপহার-প্রাপ্ত বইটির বিষয়বস্তু দেখে তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, “আমি এটা পড়ব না — আমি আসক্ত হয়ে পড়তে চাই না!”
আমেরিকায় এসে তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যে জড়িয়ে পড়েন এবং শেষে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মহাসচিব ড্যাগ হ্যামারশোল্ড-এর ব্যক্তিগত সহকারীর পদ গ্রহণের প্রস্তাব পান। (তবে ক্যালিফোর্নিয়ায় আসার আগে তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।) মাসের পর মাস কেটে গেল — আর অটোবায়োগ্রাফি বইটি না পড়া অবস্থায় নিউ ইয়র্কে স্বামী প্রেমময়ের বাড়ির তাকেই পড়ে রইল। এই সময়ে, ইভেলিনা গ্লানজম্যান (যিনি ইতালীয় ভাষায় অটোবায়োগ্রাফি-টির অনুবাদক ছিলেন) বন্ধুর কাছে বইটির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইতে থাকেন। তবুও স্বামী প্রেমময় বইটির পাতা উল্টালেন না। শেষমেশ, গ্লানজম্যান এক চিঠিতে এমন কিছু লিখলেন: “তুমি পছন্দ করো বা না করো; অন্তত একটা কিছু বলো!” একদিন দুঃখিত ভাবে — যেটি ছিল তাঁর জন্মদিন, ৬ই মার্চ এবং জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে ভাবতে তিনি বইটি হাতে তুলে নিলেন এবং পড়তে শুরু করলেন।
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তিনি একটানা পুরো বইটি পড়ে ফেললেন। বুঝলেন, লেখকের মধ্যে যে আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা আছে, তা তিনি আগে আর কারও মধ্যে দেখেননি। তখনই স্বামী প্রেমময় ঠিক করলেন পরমহংস যোগানন্দজিকে চিঠি লিখবেন।
কিন্তু স্বামী প্রেমময় জানতেন না, তিনি যখন সেই চিঠি ডাকে দিচ্ছেন, তখনই গুরু তাঁর পার্থিব জীবনের শেষ দিন যাপন করছেন।
গুরুর মহাপ্রয়াণের সংবাদ স্বামী প্রেমময় কিছুদিন পরে জানতে পারেন, যখন শ্রীশ্রী দয়ামাতা তাঁর চিঠির উত্তর দেন। কয়েক মাস কেটে যায়; কিন্তু বই এবং লেখকের ভাবনা স্বামী প্রেমময় ভুলতে পারেন না। সেই গ্রীষ্মে তিনি ঠিক করেন, লস অ্যাঞ্জেলসে গিয়ে পরমহংসজির শিক্ষার ব্যাপারে আরও জানবেন। সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এর সদর দপ্তরের চত্বরে প্রথমবার পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই, একজন অচেনা ব্যক্তি হাসিমুখে তাঁকে অভ্যর্থনা জানায়। উজ্জ্বল হেসে সেই ব্যক্তি তাঁকে এমন স্নেহভরে আলিঙ্গন করেন যেন বহু পুরোনো বন্ধু — বহুদিন ধরে অপেক্ষিত এবং অত্যন্ত আদৃত। কোনো কথা হয়নি তখন; পরে স্বামী প্রেমময় জানতে পারেন, সেই নতুন “পুরোনো বন্ধু” আর কেউ নন — শ্রীশ্রী রাজর্ষি জনকানন্দ, সোসাইটির অধ্যক্ষ!
এইভাবেই, সেই বই যাকে পরমহংসজি তাঁর “রাজদূত” বলে বর্ণনা করেছিলেন — আরও একটি প্রাণকে যাদু করলো আর সেই দিন থেকেই স্বামী প্রেমময়ের জীবনের পথ স্থির হয়ে গেল।

“রাতের বেলা আমি পড়তাম, আর [আমার মা] পড়তেন যখন আমি কাজে যেতাম। “পড়া” শব্দটি আমরা যে সত্যের জগতে প্রবেশ করে এক গভীর অভিজ্ঞতায় নিমগ্ন হয়েছিলাম তার বর্ণনা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। জীবনের উৎস, শিষ্যত্ব, ক্রিয়া যোগের ধর্মীয় আচার — অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি-তে সবই ছিল সুস্পষ্ট।”
১৯৫২-তে, আমি তখন লস অ্যাঞ্জেলস-এর উইলশায়ার বুলেভার্ডে অবস্থিত অ্যাম্বাসেডর হোটেলে সহকারী ব্যবস্থাপকের সচিব পদে কর্মরত ছিলাম: একটি আকর্ষণীয় চাকরি, এক সম্ভ্রান্ত পরিবেশে, যেখানে বহু বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটত। কিন্তু আমি তখনও বুঝিনি, একটি নাম আমার জীবনে কী বিপুল প্রভাব ফেলবে, যখন তা আমার কানে উচ্চারিত হয়।
৬ই মার্চ, এক চলচ্চিত্র প্রযোজকের সচিব হোটেলে ফোন করে অনুরোধ করলেন যেন পরমহংস যোগানন্দজিকে একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়। সেই নামটি শুনেই আমার বুকে যেন বিশাল এক “ঘণ্টাধ্বনি” বেজে উঠল; মাথা ঘুরতে লাগল, হৃদয় ও মনে আনন্দ উথলে উঠল এবং আমি সোজা হাঁটতেও পারছিলাম না, কোনো রকমে বার্তা পৌঁছে দিতে রিজার্ভেশন ডেস্কে পৌঁছোলাম। আমাকে বলা হল, ওই নামে কেউ হোটেলে নিবন্ধিত নন, যদিও ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ও তাঁর প্রতিনিধি দল তখন সেখানে ছিলেন। অফিসে ফেরার পথে বারবার সেই নামটি আমার চেতনার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং আমার ভিতরটা ভালোবাসা ও আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠছিল। কিছুক্ষণ পর, চলচ্চিত্র প্রযোজক নিজেই ফোন করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, “আমার সেক্রেটারি তোমাকে কী নাম বলেছিল?” আমি বললাম “পরমহংস যোগানন্দ।” তিনি চমকে উঠে বললেন, “তাই তো আমি শুনেছিলাম! কিন্তু আমি তো ওই নাম বলিনি। সেও জানে না কেন সে সেই নাম বলেছে!”
সারা দিন আমি যেন এক অদ্ভুত অন্তরের সচেতনতার অবস্থায় ছিলাম, আর সেই নামের সঙ্গে গভীর এক সংযুক্তি অনুভব করছিলাম। এরপর এলো ৭ই মার্চ, পরমহংস যোগানন্দের মহাসমাধির সেই দুর্ভাগ্যের দিন। খবরের কাগজে পড়ে মনে হল যেন আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছি। হৃদয় বিদারক এক বেদনা! মনে হচ্ছিল আমার জীবন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল। বার বার মনে হচ্ছিল, আমি তাঁকে হারালাম! আমি তো সারা জীবন অপেক্ষা করছিলাম তাঁর জন্য আর আমি তাঁকে হারিয়ে ফেললাম! অথচ আমি জানতাম না কেন এমন ভাবছিলাম, কারণ আমি কোনো গুরু বা পথ খুঁজছিলাম না। তবুও, আমার চেতনার গভীরে আমি এই সত্যি বুঝতে পারছিলাম, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হারিয়েছি।
সেই মুহূর্ত থেকে আমার সুশৃঙ্খল, আড়ম্বরপূর্ণ জীবন আর আমার জন্যে মানানসই হচ্ছিল না। আমি হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা বাতিল করলাম, পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করা বন্ধ করে দিলাম, আর বই পড়ে খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু কখনো মনে হয়নি যে পরমহংস যোগানন্দ কোনো বই লিখেছেন কিনা। আমার শুধু এটাই মনে হতো, তিনি চলে গেছেন এবং আমি তাঁকে হারিয়েছি। চারটি অধিবিদ্যা বিষয়ক বই পড়েও অন্তরের প্রয়োজন মেটেনি। তখন আবার আমি আমার মার সঙ্গে হলিউড পাবলিক লাইব্রেরির একই তাকে ঘেঁটে চলেছি যিনি তখন আমার ভেতরের সেই আগুনে কিছুটা আক্রান্ত হয়েছেন। আমি প্রথম বিভাগটির প্রায় পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলাম, ভেবেছিলাম আগেই ওটা ভালো করে খুঁজে দেখেছি, তখনই হঠাৎ ওপরের তাক থেকে একটি বই পড়ে আমার মাথায় লাগল, তারপর মেঝেতে পড়ে গেল। মা সেটি তুলে নিয়ে চমকে উঠলেন এবং বইটি আমার দিকে ঘুরিয়ে ধরলেন — পরমহংস যোগানন্দের অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি। আমার হৃদয় যে নাম খুঁজছিল, সেটি তখন চোখের সামনে আর সেই মুখ, যার চোখ যেন আত্মার গভীরে পৌঁছে যায়!
আমি রাতের বেলা পড়তাম আর মা পড়তেন যখন আমি কাজে যেতাম। ‘পড়া’ শব্দটি আমরা যে সত্যের জগতে প্রবেশ করে এক গভীর অভিজ্ঞতায় নিমগ্ন হয়েছিলাম তার বর্ণনা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। জীবনের উৎস, শিষ্যত্বের তাৎপর্য, ক্রিয়াযোগের প্রয়োগ —অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি-তে সবই ছিল সুস্পষ্ট।
আমরা হলিউড মন্দিরে একটি সৎসঙ্গে অংশ নিই, যা আমাকে অভিভূত করে দেয় সেই একই “উপস্থিতি”-তে, যা আমি সেই সকালে অনুভব করেছিলাম যেদিন প্রথম ফোনে গুরুদেবের নাম শুনেছিলাম। অনুষ্ঠানের পর মীরা মাতা আমাদের খুব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন এবং কিছুক্ষণ পর প্রস্তাব দেন যেন আমি মাউন্ট ওয়াশিংটনের মাদার সেন্টারে যাই ও তাঁর কন্যা মৃণালিনী মাতার সঙ্গে দেখা করি। আমরা সেখানে গেলাম এবং সন্ন্যাসী পরম্পরা সম্পর্কে জানলাম, আর তখন আমি তৃতীয়বার “আবিষ্ট” হলাম — প্রথমে পরমহংস যোগানন্দের দ্বারা, দ্বিতীয়বার অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি দ্বারা এবং এবার, একমাত্র ঈশ্বরকে উৎসর্গীকৃত ত্যাগময় জীবনের আদর্শ দ্বারা।
৬ই মার্চ যেদিন ফোনে পরমহংসজির নাম শুনে আমার মনে যে প্রভাব পড়েছিল, সেই প্রসঙ্গটি যখন আমি মনে করছিলাম, তখন জানতে পারি, সেদিন সকালে তিনি হোটেলেই ছিলেন, ভারতের রাষ্ট্রদূত মহামান্য বিনয় আর. সেন-এর সম্মানে আয়োজিত এক প্রাতরাশ সভায় অংশ নিতে। সেই প্রাতরাশ সভাটি ছিল আমার অফিসের পাশের ঘরেই। আমি যখন ফোন ধরেছিলাম এবং তাঁর নাম শুনেছিলাম, তখন ঠিক আমার পাশের দেয়ালের ওপারে গুরুদেব বসে ছিলেন।
গুরু তাঁর এই মহান অটোবায়োগ্রাফি-র মাধ্যমে “তাঁর আপনজনদের” ডাক দিয়ে চলেছেন। আমরা কেউ কেউ একটু দেরিতে সাড়া দিই। কাউকে মাথায় ধাক্কা দিয়ে সাড়া দেওয়াতে হয়, আমি যেমন! কিন্তু কতই না ধন্য সেই কোটি কোটি আত্মা, যারা তাঁর “আহ্বান” শুনে তাঁর স্পষ্ট ডাকের উত্তর দেয়।
১৯৪৩-এ যখন আমি পরমহংস যোগানন্দজিকে প্রথম দেখি, তখন আমার বয়স ছিল নয় বছর। আমার বাবা সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের একজন সদস্য ছিলেন এবং সান ডিয়েগোর মন্দিরে নিয়মিত সৎসঙ্গে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৪৭-এ আমি তাঁর অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি বইটি পড়ি, যা পরমহংসজি নিজে তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। আমার বাবা ছিলেন খুবই বিনম্র প্রকৃতির মানুষ, নিজের বিশ্বাস অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কখনোই করতেন না। ফলে, তিনি এমনকি বইটি কখনো আমাকে দেখাননি — আমি হঠাৎ করেই সেটি খুঁজে পাই। আমার সেটি পড়তে কিছুটা সময় লেগেছিল — আমি তখনও অনেক ছোটো আর বইটিতে কিছু কঠিন শব্দও ছিল! কিন্তু শুরু থেকেই অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি আমার জন্য স্বর্গ হয়ে উঠেছিল, আমার আত্মার জন্য এক প্রশান্তিদায়ক প্রলেপ…। সর্বোপরি, অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি দেখিয়েছিল যে আমাদের পক্ষে ঈশ্বরকে জানা সম্ভব।

১৯৩৯-এ আশ্রমে প্রবেশ করার কিছুদিন পর পরমহংসজি আমাদের কয়েকজনের সঙ্গে মাউন্ট ওয়াশিংটনের প্রশাসনিক ভবনের বারান্দায় কথা বলছিলেন। তিনি আমাদের বললেন, ঈশ্বর তাঁকে জানিয়েছেন যে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে কয়েকটি নির্দিষ্ট বই লিখতে হবে; আর সেই বই লেখা শেষ হলেই তাঁর পার্থিব কার্য সমাপ্ত হবে। অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি সেই বইগুলির একটি। অটোবায়োগ্রাফি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, আমি এক-দুদিনেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলি — কত না অনুপ্রেরণাদায়ক ও অসাধারণ! আমার মনে আছে আমি ভাবছিলাম, এই বই পরমহংসজির শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে। আজ অবধি আমরা শুধু হিমশৈলের চূড়াটি দেখেছি।

আমি আমার আশ্রম জীবনে ১৯৪৬-এর প্রথম খ্রিস্টমাসের কথা মনে করতে পারি। অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি তখন সম্পূর্ণ হয়েছে আর পরমহংসজি আমাদের সকলকে একটি করে কপি উপহার দেন। সেই পাতাগুলোর মাধ্যমে গুরুদেবের প্রাণবন্ত ও আনন্দময় ব্যক্তিত্ব কত গভীরভাবে প্রকাশ পেয়েছিল — আমরা যেভাবে তাঁর উপস্থিতিতে ভালোবাসা ও আনন্দ অনুভব করতাম, সেভাবেই। আমরা তাঁর মুখেই সেই বহু ঘটনা শুনে উন্নীত হয়েছিলাম, আর এখন এই বইয়ের মাধ্যমে সবাই তা জানতে পারবে।

আমি স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি, যখন অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি প্রথম প্রকাশিত হয়। কিছুদিন পরে আমি পরমহংসজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি কি আমার কপিতে একটি ছোটো বার্তা লিখবেন? তিনি লিখেছিলেন: “এই পাতাগুলির বেদীতে গোপনে লুকিয়ে থাকা অনন্তকে খুঁজে বের করো।” কখনো কখনো যখন আমার নির্দিষ্ট কোনও প্রয়োজন হয়, আমি অটোবায়োগ্রাফি খুলে কোনও একটি অনুচ্ছেদ পড়ি এবং মনে হয়, “আমি তো কখনো এই অংশটা দেখিনি!” অথচ সেই মুহূর্তে আমি যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম ঠিক সেই বিষয়টিই সেখানে আলোচিত হয়েছে। যদিও আমি জানতাম না বইয়ের কোথায় গেলে তা খুঁজে পাওয়া যাবে, তবুও আমার যখন প্রয়োজন সেটি যেন নিজেই সামনে এসে পড়ে। আমি সত্যিই দেখেছি, গুরুদেবের উপদেশ সত্য — তুমি এই পাতাগুলির বেদীতে লুকিয়ে থাকা অনন্তকে খুঁজে পাবে।

১৯৪৩-এ যখন আমি পরমহংস যোগানন্দজিকে প্রথম দেখি, তখন আমার বয়স ছিল নয় বছর। আমার বাবা সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের একজন সদস্য ছিলেন এবং সান ডিয়েগোর মন্দিরে নিয়মিত সৎসঙ্গে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৪৭-এ আমি তাঁর অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি বইটি পড়ি, যা পরমহংসজি নিজে তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। আমার বাবা ছিলেন খুবই বিনম্র প্রকৃতির মানুষ, নিজের বিশ্বাস অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কখনোই করতেন না। ফলে, তিনি এমনকি বইটি কখনো আমাকে দেখাননি — আমি হঠাৎ করেই সেটি খুঁজে পাই। আমার সেটি পড়তে কিছুটা সময় লেগেছিল — আমি তখনও অনেক ছোটো আর বইটিতে কিছু কঠিন শব্দও ছিল! কিন্তু শুরু থেকেই অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি আমার জন্য স্বর্গ হয়ে উঠেছিল, আমার আত্মার জন্য এক প্রশান্তিদায়ক প্রলেপ…। সর্বোপরি, অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি দেখিয়েছিল যে আমাদের পক্ষে ঈশ্বরকে জানা সম্ভব।

১৯৩৯-এ আশ্রমে প্রবেশ করার কিছুদিন পর পরমহংসজি আমাদের কয়েকজনের সঙ্গে মাউন্ট ওয়াশিংটনের প্রশাসনিক ভবনের বারান্দায় কথা বলছিলেন। তিনি আমাদের বললেন, ঈশ্বর তাঁকে জানিয়েছেন যে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে কয়েকটি নির্দিষ্ট বই লিখতে হবে; আর সেই বই লেখা শেষ হলেই তাঁর পার্থিব কার্য সমাপ্ত হবে। অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি সেই বইগুলির একটি। অটোবায়োগ্রাফি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, আমি এক-দুদিনেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলি — কত না অনুপ্রেরণাদায়ক ও অসাধারণ! আমার মনে আছে আমি ভাবছিলাম, এই বই পরমহংসজির শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে। আজ অবধি আমরা শুধু হিমশৈলের চূড়াটি দেখেছি।

আমি আমার আশ্রম জীবনে ১৯৪৬-এর প্রথম খ্রিস্টমাসের কথা মনে করতে পারি। অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি তখন সম্পূর্ণ হয়েছে আর পরমহংসজি আমাদের সকলকে একটি করে কপি উপহার দেন। সেই পাতাগুলোর মাধ্যমে গুরুদেবের প্রাণবন্ত ও আনন্দময় ব্যক্তিত্ব কত গভীরভাবে প্রকাশ পেয়েছিল — আমরা যেভাবে তাঁর উপস্থিতিতে ভালোবাসা ও আনন্দ অনুভব করতাম, সেভাবেই। আমরা তাঁর মুখেই সেই বহু ঘটনা শুনে উন্নীত হয়েছিলাম, আর এখন এই বইয়ের মাধ্যমে সবাই তা জানতে পারবে।

আমি স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি, যখন অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি প্রথম প্রকাশিত হয়। কিছুদিন পরে আমি পরমহংসজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি কি আমার কপিতে একটি ছোটো বার্তা লিখবেন? তিনি লিখেছিলেন: “এই পাতাগুলির বেদীতে গোপনে লুকিয়ে থাকা অনন্তকে খুঁজে বের করো।” কখনো কখনো যখন আমার নির্দিষ্ট কোনও প্রয়োজন হয়, আমি অটোবায়োগ্রাফি খুলে কোনও একটি অনুচ্ছেদ পড়ি এবং মনে হয়, “আমি তো কখনো এই অংশটা দেখিনি!” অথচ সেই মুহূর্তে আমি যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম ঠিক সেই বিষয়টিই সেখানে আলোচিত হয়েছে। যদিও আমি জানতাম না বইয়ের কোথায় গেলে তা খুঁজে পাওয়া যাবে, তবুও আমার যখন প্রয়োজন সেটি যেন নিজেই সামনে এসে পড়ে। আমি সত্যিই দেখেছি, গুরুদেবের উপদেশ সত্য — তুমি এই পাতাগুলির বেদীতে লুকিয়ে থাকা অনন্তকে খুঁজে পাবে।
