মৃত্যু ও বিয়োগের বিচার

শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দের লেখা থেকে উদ্ধৃত

Soul leaving body at death.সাধারণ মানুষ মৃত্যুকে ভয়াবহ এবং দুঃখময় ভাবলেও, যারা চলে গেছে তারা মৃত্যুকে শান্তি ও মুক্তির এক অপূর্ব অভিজ্ঞতারূপে জানে।

মৃত্যুর সময় তুমি ভৌত ​​দেহের সমস্ত সীমাবদ্ধতা ভুলে যাও এবং বুঝতে পারো যে তুমি কতটা স্বাধীন। প্রথম কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভয় লাগে — অজানার ভয়, চেতনার অপরিচিত কিছুর ভয়। কিন্তু তার পরে এক বিরাট উপলব্ধি আসে: আত্মা স্বস্তি এবং মুক্তির এক আনন্দময় অনুভূতি বোধ করে। তুমি জানতে পারো যে তুমি নশ্বর দেহ থেকে আলাদা।

আমাদের প্রত্যেকেরই একদিন না একদিন মৃত্যু হবে, তাই মৃত্যুকে ভয় পেয়ে লাভ নেই। নিদ্রার মধ্যে শরীরের চেতনা হারিয়ে ফেলার উৎকণ্ঠা তোমার হয় না; তুমি নিদ্রাকে একরকম স্বাধীনতা হিসেবে মেনে নাও এবং আগ্রহের সঙ্গে তুমি তার অপেক্ষা করো। মৃত্যুও তাই; এটি বিশ্রামের একটি অবস্থা, এই জীবন থেকে অবসর। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যখন মৃত্যু আসে, তাকে উপহাস করো। মৃত্যু শুধু এক অভিজ্ঞতা মাত্র, যার উদ্দেশ্য তোমাকে একটি মহান শিক্ষা দেওয়া: তোমার মৃত্যু হতে পারে না।

আমাদের প্রকৃত সত্ত্বা, আত্মা হল অমর। মৃত্যু নামক পরিবর্তনে হয়তো কিছুক্ষণ নিদ্রামগ্ন থাকলেও আমাদের কখনও বিনাশ করা যায় না। আমাদের অস্তিত্ব আছে এবং সেই অস্তিত্ব চিরন্তন। ঢেউ তীরে আসে, আবার সমুদ্রে ফিরে যায়; তা হারিয়ে যায় না। ঢেউটি সমুদ্রের সাথে এক হয়ে যায়, অথবা অন্য একটি ঢেউয়ের আকারে আবার ফিরে আসে। এই দেহ এসেছে এবং এটি চলেও যাবে; কিন্তু এর ভিতরের আত্মারূপী সত্ত্বার অস্তিত্ব কখনও শেষ হবে না। সেই শাশ্বত চেতনাকে কোনো কিছুই বিনাশ করতে পারে না।

বিজ্ঞান যেমন দেখিয়েছে, পদার্থের একটি কণা কিংবা শক্তির একটি তরঙ্গও অবিনাশী; মানুষের আত্মা বা আধ্যাত্মিক তত্ত্বও অবিনাশী। পদার্থের রূপান্তর ঘটে; আত্মার অভিজ্ঞতার পরিবর্তন হয়। আমূল পরিবর্তনকে মৃত্যু বলা হয়, কিন্তু মৃত্যু বা আকারের পরিবর্তন আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে বদলাতে বা ধ্বংস করতে পারে না।

দেহ কেবল একটি পোশাক। এই জীবনে তুমি কতবার তোমার জামাকাপড় বদলেছ, কিন্তু তুমি বলবে না যে এর জন্য তুমি বদলে গেছো। একইভাবে, মৃত্যুর সময় যখন তুমি এই শরীররূপী পোশাক পরিত্যাগ করো, তখন তুমি বদলাও না। তুমি সেই একই থাকো, এক অমর আত্মা, ঈশ্বরের সন্তান।

“মৃত্যু” শব্দটি নামের একটি বিরাট ভুল, কারণ মৃত্যু বলে কিছু নেই; যখন তুমি জীবন থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়ো, তখন তুমি কেবল দেহের আবরণ খুলে ফেলো এবং সূক্ষ্মজগতে ফিরে যাও।

আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে ভগবদগীতার বাণী সুন্দর এবং সান্ত্বনাদায়ক:

এই আত্মা কখনো জন্মায় না; এই আত্মার বিনাশও কখনও হয় না;
এমন কোনো সময় ছিল না যখন এর অস্তিত্ব ছিল না; আদি ও অন্ত শুধুই স্বপ্ন!
এই আত্মা অজ, অমর, অব্যয়;
এর শরীররূপী গৃহ মৃত হলেও মৃত্যু আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না।

মৃত্যুই শেষ কথা নয়: তোমার বর্তমান শরীর এবং পরিবেশের কর্মফল নির্ধারিত উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে, বা দুঃখকষ্টে যখন তুমি এতটাই ক্লান্ত এবং অবসন্ন যে শরীরের বোঝা আর বইতে পারছো না, তখন মৃত্যু সাময়িক মুক্তি এনে দেয়। যারা কষ্ট পাচ্ছে, তাদের কাছে মৃত্যু হল দেহের যন্ত্রণাদায়ক নিপীড়ন থেকে শান্তি এবং নিরবতায় জাগরণ এবং পুনরুত্থান। বয়স্কদের জন্য এটি বছরের পর বছর ধরে জীবনসংগ্রাম করে পাওয়া অবসর। সকলের জন্য এটি একটি আকাঙ্খিত বিশ্রাম।

যখন তুমি মনে করো যে এই পৃথিবী মৃত্যুতে পরিপূর্ণ এবং তোমাকেও দেহ ত্যাগ করতে হবে, তখন ঈশ্বরের পরিকল্পনা খুবই নিষ্ঠুর বলে মনে হয়। তুমি কল্পনাও করতে পারো না যে তিনি করুণাময়।

কিন্তু যখন তুমি জ্ঞানের চোখ দিয়ে মৃত্যুর প্রক্রিয়াটি দেখ, তখন দেখতে পাও যে এটি কেবল ঈশ্বরের একটি চিন্তা যা এক পরিবর্তনের দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে আবার ঐশ্বরিক আনন্দময় স্বাধীনতায় রূপান্তরমাত্র। সাধু এবং পাপী উভয়কেই মৃত্যুর পরে যোগ্যতা অনুসারে কম-বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হয়। ঈশ্বরের স্বপ্নের সূক্ষ্মজগতে — যেখানে মৃত্যুর পরে আত্মারা যায় – তারা এমন স্বাধীনতা উপভোগ করে যা তারা পার্থিব জীবনে কখনও করেনি।

তাই মৃত্যুর মায়ার মধ্য দিয়ে যে ব্যক্তি যাচ্ছে তাকে করুণা কোরো না, কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মুক্ত হবে। সেই ভ্রম থেকে একবার বেরিয়ে এলে মানুষ দেখতে পায় যে মৃত্যু আসলে অতটা খারাপ ছিল না। তখন সে বুঝতে পারে যে, মৃত্যু কেবল এক স্বপ্নমাত্র ছিল এবং এই জেনে আনন্দিত হয় যে এখন কোনো আগুন তাকে দগ্ধ করতে পারবে না, কোনো জল তাকে নিমজ্জিত করতে পারবে না; সে মুক্ত এবং নিরাপদ।

মৃত ব্যক্তির চেতনা হঠাৎ করেই শরীরের ভার, শ্বাস-প্রশ্বাসের তাগিদ এবং সব শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে যায়। আত্মা তখন এক অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ, কুয়াশাচ্ছন্ন, ম্লান আলোর সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে উর্ধ্বগামী হওয়ার অনুভূতি লাভ করে। তারপর আত্মা এক বিস্মৃতিপূর্ণ সুষুপ্তির মধ্যে চলে যায়, যা পার্থিব দেহে অনুভূত গভীরতম নিদ্রার চেয়েও লক্ষ গুণ গভীর এবং উপভোগ্য….

বিভিন্ন মানুষ তাদের পার্থিব জীবনযাত্রার ধরণ অনুযায়ী মৃত্যু-পরবর্তী অবস্থা বিভিন্নভাবে অনুভব করে। যেমন বিভিন্ন মানুষের নিদ্রার সময়কাল এবং গভীরতা ভিন্ন হয়, তেমনি মৃত্যুর পরেও তাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হয়। জীবনের কারখানায় কঠোর পরিশ্রমকারী সৎ মানুষটি অল্প সময়ের জন্য গভীর, অচেতন, শান্তিপূর্ণ ঘুমে তলিয়ে যায়। তারপর সে সূক্ষ্মজগতের কোনো জীবনক্ষেত্রে জেগে ওঠে: “আমার পিতার গৃহে অনেক প্রাসাদ রয়েছে।”

সূক্ষ্মজগতে আত্মারা অতি সূক্ষ্ম আলোকরশ্মির পোশাক পরে থাকে। তারা মাংসের আবরণ দেওয়া হাড়ের স্তূপে নিজেদের ঢেকে রাখে না। তারা কোনো দুর্বল, ভারী কাঠামো বয়ে বেড়ায় না যা অন্যান্য স্থূল কঠিন পদার্থের সাথে সংঘর্ষে ভেঙে যেতে পারে। অতএব, সূক্ষ্মজগতে মানুষের দেহের সঙ্গে কঠিন পদার্থ, সমুদ্র, বজ্রপাত এবং রোগের কোনো বিরোধ নেই। দুর্ঘটনাও নেই, কারণ সবকিছুই বিরোধের পরিবর্তে পারস্পরিক সহায়তার মধ্যে সহাবস্থান করে। সকল ধরণের স্পন্দন একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে কাজ করে। শান্তি এবং সচেতন সহায়তার মধ্যে সব শক্তি সহাবস্থান করে। আত্মারা যে রশ্মিতে পা ফেলে হাঁটে, যে কমলা রঙের রশ্মি পান করে এবং খায়, আর তারা নিজেরাও, জীবন্ত আলো দিয়ে তৈরি। আত্মারা পারস্পরিক স্বীকৃতি এবং সহযোগিতায় বাস করে, তারা অক্সিজেন নয়, বরং পরমাত্মার আনন্দের শ্বাস নেয়।

[শ্রীযুক্তেশ্বরজি বলেছেন] “পরলোকে পূর্ব জন্মের বন্ধুরা পরস্পর পরস্পরকে অতি সহজেই চিনতে পারে। দুঃখ আর মোহময় পার্থিব জীবনের অবসানকালে প্রেমের অবিনশ্বরতা সম্বন্ধে যে সন্দেহ উপস্থিত হয়, আবার তারা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে অক্ষয় বন্ধুত্বের আনন্দ উপভোগ করে, সেই প্রেমের অমরত্ব সহজেই উপলব্ধি করতে পারে।”

মৃত্যুপারের জীবন খুবই চমৎকার! আর তোমাকে সমস্ত ঝামেলা সমেত এই পুরনো হাড়ের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে না। তুমি কোনো শারীরিক সীমাবদ্ধতা ছাড়া সূক্ষ্মজগতের স্বর্গে স্বাধীন থাকবে।

যখন কোনো প্রিয়জন মারা যায়, তখন অযৌক্তিকভাবে শোক করার পরিবর্তে, বোঝো যে ঈশ্বরের ইচ্ছায় সে এক উচ্চতর স্তরে চলে গেছে এবং ঈশ্বরই জানেন তার জন্য কী সবচেয়ে ভালো। তার স্বাধীনতায় আনন্দ করো। প্রার্থনা করো যে তোমার ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছা তার ভবিষ্যতের পথে যেন উৎসাহের বার্তা নিয়ে আসে। এই মনোভাব অনেক বেশি কাজের। অবশ্যই, প্রিয়জনদের অবর্তমানে আমাদের যদি মনটা খালি না লাগে তাহলে আমরা মানুষই নই; কিন্তু তাদের জন্য মনখারাপ লাগলেও আমাদের স্বার্থপর আসক্তি যেন তাদের পৃথিবীতে আটকে না রাখে। প্রচণ্ড দুঃখ এক বিদেহী আত্মাকে বৃহত্তর শান্তি এবং স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে বাধা দেয়।

বিগত প্রিয়জনদেরকে তোমার চিন্তাভাবনা পাঠাবার জন্য চুপচাপ নিজের ঘরে বসে ঈশ্বরের ধ্যান করো। যখন তুমি নিজের ভিতরে তাঁর শান্তি অনুভব করবে, তখন দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী বিন্দুতে, ইচ্ছার কেন্দ্রবিন্দু কূটস্থ কেন্দ্রে, গভীরভাবে মনোনিবেশ করো, এবং তোমার ভালোবাসা সেই প্রিয়জনদের কাছে পাঠিয়ে দাও যারা চলে গেছে।

তুমি যার সাথে যোগাযোগ করতে চাও, তাকে কূটস্থ কেন্দ্রে কল্পনা করো। সেই আত্মার কাছে তোমার ভালোবাসা, শক্তি ও সাহসের স্পন্দন পাঠাও।

যদি তুমি এটা ক্রমাগত করো, এবং যদি সেই প্রিয়জনের প্রতি তোমার মঙ্গলচিন্তার তীব্রতা না কমে, তাহলে সেই আত্মার কাছে তোমার স্পন্দন অবশ্যই পৌঁছোবে। এই ধরনের চিন্তাভাবনা তোমার প্রিয়জনদের মঙ্গলের অনুভূতি দেয়, ভালোবাসা পাওয়ার অনুভূতি দেয়। তুমি যেমন তাদের ভোলোনি, তারাও তোমাকে ততটাই ভোলেনি।

তোমার প্রিয়জনদের কাছে ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছার ভাবনাগুলো যখন খুশি পাঠাও, কিন্তু বছরে অন্তত একবার – সম্ভবত কোনো বিশেষ বার্ষিকীতে নিশ্চয় পাঠিও। তাদের মনে মনে বলো, “আমাদের আবার দেখা হবে এবং আমরা একে অপরের সাথে আমাদের দিব্য ভালোবাসা এবং বন্ধুত্ব আরও বিকশিত করতে থাকব।” যদি তুমি এখন থেকেই তোমার ভালোবাসার ভাবনাগুলো তাদের পাঠাতে থাকো, তাহলে একদিন অবশ্যই তাদের সাথে তোমার আবার দেখা হবে। তুমি বুঝতে পারবে যে এই জীবনই শেষ নয়, বরং তোমার প্রিয়জনের সাথে তোমার সম্পর্কের চিরন্তন শেকলের একটি আংটা মাত্র।

সংকল্পবাক্য

সংকল্পবাক্যের তত্ত্ব ও নির্দেশাবলি

“পরমাত্মার সাগর আমার আত্মায় এক ক্ষুদ্র বুদবুদ রূপে প্রকাশ পেয়েছে। জন্মে ভাসুক কিংবা মৃত্যুতে হারিয়ে যাক, মহাচৈতন্যের সাগরে আমার জীবনের বুদবুদটি মরতে পারে না। আমি পরমাত্মার অমরত্বের বুকে সুরক্ষিত অবিনাশী চেতনা।”

আরও পড়ুন

এই শেয়ার করুন