পরমহংস যোগানন্দের রচনা থেকে উদ্ধৃতি
মানবসমাজ সম্পূর্ণ ও অবিরাম আনন্দ দিতে পারে এমন “বিশেষ কিছু”-র চিরন্তন সন্ধানে নিমগ্ন। ঈশ্বরের সন্ধান করে তাঁকে পেয়ে সেই বিশেষ আত্মোপলব্ধ মানুষের জন্য এই সন্ধান সম্পন্ন হয়েছে: তিনি জেনেছেন তিনি নিজেই সেই বিশেষ কিছু।

অনেকেরই সন্দেহ হতে পারে জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরসন্ধান কিনা; তবুও প্রত্যেকেই একমত সুখের সন্ধানই জীবনের উদ্দেশ্য। আমি বলি ঈশ্বরই সুখ। তিনিই পরমানন্দ। তিনিই প্রেম। তিনি এমন আনন্দ যা কখনই তোমার হৃদয়কে ছেড়ে যায় না। তাহলে কেন তুমি সে আনন্দ পেতে সচেষ্ট হবে না? অন্য কেউই তোমাকে এটা দিতে পারে না। তোমার নিজেকেই এজন্য প্রতিনিয়ত অনুশীলন করতে হবে।

সম্পদ, ক্ষমতা, বন্ধুবর্গ — তুমি যা চেয়েছ জীবন যদি একসাথে দিয়েও দিত — কিছুদিন পরে আবার অতৃপ্ত হয়ে আরও কিছুর প্রয়োজন বোধ করতে। একটা বিষয় কিন্তু আছে যা তোমার কাছে কখনই একঘেয়ে হয়ে যাবে না — সেটা আনন্দ। এর সত্ত্বা নিত্য হলেও সুখ একরকম আনন্দময়তা, এটাই সেই প্রধান অনুভূতি যা সবাই খুঁজে চলেছে। পরমাত্মাই সেই চিরন্তন, চির নূতন পরমানন্দ। নিজের মধ্যে এই আনন্দ খুঁজে পেলে বাইরের সব কিছুর মধ্যে দেখতে পাবে। তুমি পরমাত্মার অন্তহীন আনন্দের অফুরন্ত ভান্ডারের দরজা পেয়ে যাবে।

মনে করো তোমার বিশ্রাম নেবার অত্যন্ত প্রয়োজন আর ঘুমোতে না দিয়ে তোমাকে শাস্তি দেওয়া হল, এমন সময় হঠাৎ কেউ বলল: “ঠিক আছে, তুমি এখন ঘুমোতে যাও।” ভাবো, ঘুমিয়ে পড়ার আগে কেমন আনন্দ তুমি পাবে। এই আনন্দকে ১০ লাখ দিয়ে গুণ করলেও পরমাত্মার সান্নিধ্যে পাওয়া আনন্দের বর্ণনা হতে পারবে না।

পরমাত্মার আনন্দ সীমাহীন, অবিশ্রান্ত, চিরনূতন। পরমাত্মার অনুগ্রহ আর মহিমা এমনই — তুমি এই চৈতন্যের মধ্যে থাকলে কোনো কিছুই এমনকি শরীর, মনও তোমাকে বিচ্যুত করতে পারবে না। আর তুমি যা কিছু এতদিন জানতে না; যা জানতে চাও সব তিনি সবিস্তারে তোমাকে বুঝিয়ে দেবেন।

তুমি যখন গভীর ধ্যানের নিস্তব্ধতায় বসে থাকো, বাইরের কোনও কারণ ছাড়াই বুদবুদের মতো আনন্দের ঢেউ ভিতরেই উঠতে থাকে। ধ্যানের আনন্দ অপরূপ। যথাযথ ধ্যানের নিস্তব্ধতায় না পৌঁছোন পর্যন্ত যথার্থ আনন্দ কি জানা যাবে না।
মন ও অনুভূতি অন্তর্মুখী হয়ে যায় বলেই তুমি পরমাত্মার আনন্দ উপলব্ধি করতে শুরু করো। ইন্দ্রিয়সুখ স্থায়ী হয় না; কেবলমাত্র পরমাত্মার আনন্দ চিরস্থায়ী। এ অতুলনীয়!
যথাযথভাবে, বিবেচনার সাথে, সযত্নে এর প্রয়োগ করলে আমরা জীবনে যে কি পেতে পারি আমাদের মধ্যে কয়েকজন মাত্র তা জানে। জাগরণের আগেই আমাদের জীবনে ভাটার স্রোত শুরু হয়ে যায়, আর তাই পরমাত্মার দেওয়া এই সময় অমৃতের মূল্য আমরা বুঝি না — এসো, আমরা সুচারুভাবে সময়ের সার্থক ব্যবহার করি।

নিশ্চেষ্টভাবে সময় নষ্ট কোরো না। বিরাট সংখ্যক মানুষ তুচ্ছ কাজকর্মেই নিজেদের ব্যাপৃত রাখে। তাদের যদি জিজ্ঞাসা করো তারা কি করছে, উত্তরে বলবে “ওহ, সারাক্ষণ খুব ব্যস্ত আছি!” অথচ কদাচিত তারা মনে করতে পারে তারা কি ব্যাপারে এত ব্যস্ত ছিল!

যে কোনো মুহূর্তে পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে; সমস্ত কাজ তোমাকে বাতিল করতে হবেই। তাহলে কেন এমন সব কাজকে গুরুত্ব দিচ্ছ, যার ফলে সাধনার জন্য সময় নেই? এটা তো সাধারণ জ্ঞান নয়। এসব মায়ার কারণে হয়, আমাদের ওপর ছড়িয়ে রাখা বিশ্বজনীন ভ্রমের জাল যাতে আমরা ঈশ্বরকে ভুলে নিজেদের পার্থিব স্বার্থে জড়িয়ে রাখি।

ঈশ্বরের সাথে আমরা একত্ব হতে পারলে, আমাদের জ্ঞান সর্বত্রব্যাপী পরমাত্মার অস্তিত্বের মহাসাগরে অপরিসীম হয়ে যায়। পরমাত্মাকে জানলে, নিজেদের আত্মা বলে জানলে তখন না থাকে ভূমি না সাগর, না থাকে পৃথিবী না আকাশ — সবই তিনি। সত্ত্বার পরমাত্মায় একীভূত হয়ে যাওয়ার অবস্থা কেউ বর্ণনা করতে পারে না। পরম আনন্দের অনুভূতি — আনন্দ, জ্ঞান ও প্রেমের শাশ্বত পরিপূর্ণতা।

ঈশ্বরের প্রেম, দৈবী প্রেম, সর্বহরা প্রেম। একবার তুমি এটা উপলব্ধি করলে, এ তোমাকে অবিরাম অনন্তলোকের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তোমার হৃদয় থেকে এই প্রেম কখনই তুলে ফেলা যাবে না, সেখানেই উজ্জ্বল হয়ে থাকবে, এর আলোয় তুমি দেখতে পাবে পরমাত্মার আকর্ষক শক্তি অন্যদের তোমার দিকে টেনে আনবে আর তোমার যা কিছু যথার্থ প্রয়োজন বা অভিলাষ মিটে যাচ্ছে।

তোমাদের বলি আসলে আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মানুষের থেকে নয়, ঈশ্বরের থেকে এসেছে। তিনি আছেন। অবশ্যই আছেন। এটা তাঁরই শক্তি আমার মাধ্যমে তোমাদের সাথে কথা বলছেন। যে প্রেমের কথা আমি বলি সেটা তাঁরই। রোমাঞ্চের ওপর রোমাঞ্চ! প্রাণের ওপর মৃদুমন্দ সমীরণের মতো বয়ে যায়। দিন রাত, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, বছরের পর বছর এটা বেড়েই চলে — তুমি জানই না এর শেষ কোথায়। আর তুমি, তোমাদের সবাই সেটাই খুঁজছে। তোমরা ভাবো তোমরা মানুষের প্রেম আর সমৃদ্ধি চাও, বরং এসবের পিছনেই তোমাদের পিতার আহ্বান। তাঁর এই সমস্ত উপহারের থেকেও তিনি উচ্চতর এমন উপলব্ধি করে থাকলে তুমি তাঁকে পাবে।

পরমাত্মাকে জানতে শেখার উদ্দেশ্যেই মানুষ ধরায় এসেছে; অন্য কোনও প্রয়োজনে নয়। এটাই ঈশ্বরের আন্তরিক বার্তা। যারা তাঁর সন্ধান করে, তাঁকে ভালোবাসে, তিনি তাদের বেদনাহীন, বার্ধক্যহীন, শত্রুহীন, মৃত্যুহীন অত্যুচ্চ জীবনের কথা জানান — একমাত্র শাশ্বত আশ্বাসন। সেই জীবনে কিছুই ধ্বংস হয় না। সেখানে শুধুমাত্র অনির্বচনীয় আনন্দ যা কখনও একঘেয়ে হয় না — সর্বদা এক নিত্য নবীন আনন্দ।

এইজন্য ঈশ্বরসন্ধান করা সার্থক। আন্তরিকভাবে তাঁকে যারা খুঁজবে তাঁকে সবাই অবশ্যই পাবে। যারা তাঁকে প্রেম করবে, ব্যাকুলভাবে তাঁর রাজ্যে প্রবেশ করতে চাইবে আর আন্তরিকভাবে তাঁকে জানতে চাইবে, তাঁকে খুঁজে পাবে। দিনরাত তাঁর জন্য তোমার ক্রমবর্ধমান চাহিদা থাকতেই হবে। তিনি তোমার প্রেম স্বীকার করে অনন্তকাল ধরে তোমাকে দেওয়া তাঁর আশ্বাস পূরণ করবেন আর তুমি অক্ষয় আনন্দ ও প্রসন্নতা জানতে পারবে। শুধুই আলো, শুধুই আনন্দ, শুধুই শান্তি, শুধুই প্রেম। তিনিই সব।