গুরু-শিষ্য সম্বন্ধ

আনন্দের সন্ধান তোমরা ঈশ্বরে পাও এছাড়া তোমাদের থেকে আমি আর কিছুই চাই না। আর তোমরাও আমার থেকে ঈশ্বরের আনন্দ ও প্রজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই চাও না।

—পরমহংস যোগানন্দ

Paramahansa Yogananda the Guru

গুরু: “অন্ধকার অপসারণকারী”

একজন প্রকৃত গুরু কোনো সাধারণ আধ্যাত্মিক শিক্ষক নন, তিনি নিজে পরমাত্মার সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্ম হতে পেরেছেন এবং সেই কারণেই তিনি অন্যদের সেই আনন্দময় লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার অধিকারি।
 
সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থে গুরুকে “অন্ধকার অপসারণকারী” বলে বর্ণনা করা হয়েছে (গু অর্থে “অন্ধকার” এবং রু “যা অন্ধকার অপসারণ করে”। গুরুর মহাজাগতিক চেতনার আলোয় অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়ে যায়—এই অন্ধকারই আমাদের প্রত্যেককে আমরাও যে “ঈশ্বরের আদলে তৈরি” এক অবিনশ্বর দিব্য সত্তা সেই উপলব্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে।
 
একজন প্রকৃত গুরু তাঁর শিষ্যদের ধ্যান প্রক্রিয়া এবং দৈনন্দিন জীবনের অনুশাসন সমন্বিত আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলার একটি সুনির্দিষ্ট পথ বা সাধনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেন। গুরুর উপদেশ অধ্যয়ন এবং প্রয়োগের মাধ্যমে, আন্তরিক আধ্যাত্মিক অন্বেষী একজন আত্মোপলব্ধিকারী গুরুর উদাহরণ দেখেই জীবনের আসল উদ্দেশ্য এবং নিজের সঙ্গে ঈশ্বরের পবিত্র জ্যোতি ও প্রেমের প্রকৃত সম্পর্ক উপলব্ধি করেন। আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শিষ্য যত পরিণত হন, তত তাঁরা ব্যক্তিগত পরিসরে ঈশ্বরের যন্ত্র বা দূত স্বরূপ গুরুর এই ধরনের আশীর্বাদ অনুভব করেন।
 
ক্রিয়াযোগের অবাধ প্রাচুর্য ভক্তের জীবনে শুধু উপদেশের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় না, পরমহংস যোগানন্দজি এবং এই পরম্পরার সকল গুরুর উপস্থিতি এবং নির্দেশের স্পষ্ট উপলব্ধির মধ্যে দিয়েও হয়। এই গুরুগণ পরমাত্মাকে জানেন এবং অব্যর্থভাবে অন্যদেরও সেই একই আধ্যাত্মিক চৈতন্যের পথ দেখাতে পারেন।

গুরু শিষ্যের বন্ধন

পরমহংস যোগানন্দজি গুরু শিষ্য সম্বন্ধকে বর্ণনা করেছেন “এক নিজস্ব এবং ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক বন্ধন রূপে … শিষ্যের পক্ষ থেকে এক বিশ্বস্ত আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা এবং তার ওপর গুরুর দিব্য আশীর্বাদের মিলন।”

গুরুর বিশ্বস্ততার বিনিময়ে শিষ্য গুরুর প্রতি তার নিজের বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার করে। ওয়াইএসএস পাঠমালার ছাত্র হলেই অন্তরে বা বাইরে তার এই অঙ্গীকার করা জরুরী নয়। পরমহংসজি দরাজভাবে এই জ্ঞান ও শক্তিশালী প্রক্রিয়া ধর্মের বাছবিচারের ঊর্ধ্বে গিয়ে —যারা আন্তরিকভাবে শিখতে চাইবে এবং এই জ্ঞানকে গুপ্ত রাখার অঙ্গীকার করবে এমন সকলকেই দিয়েছেন।

যারা নিজেরা ক্রিয়াযোগ বিজ্ঞানের পথে আকৃষ্ট এবং মনে করেন ঈশ্বর লাভ করার এটিই তাদের নিজস্ব পথ, পরমহংস যোগানন্দজি তাদের ক্রিয়াযোগ প্রক্রিয়া অভ্যাসের দীক্ষা দিয়েছেন। যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া দ্বারা প্রদত্ত এই পবিত্র দীক্ষা (সংস্কৃতে দীক্ষা) ছাত্র এবং পরমহংস যোগানন্দের মধ্যে গুরু শিষ্য সম্বন্ধ স্থাপন করে।

একজন প্রকৃত গুরু সদা জীবিত থাকেন, এমনকি যখন তিনি তাঁর ভৌত দেহে থাকেন না তখনও। ঈশ্বরের সর্ববিদ্যমানতা ও সর্বজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর একতার মাধ্যমে একজন প্রকৃত গুরু সবসময় তাঁর শিষ্যদের সম্পর্কে সদা সচেতন এবং নিরবিচ্ছিন্ন প্রেম ও সুরক্ষা দিয়ে তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখেন।

পরমহংস যোগানন্দ—ওয়াইএসএস পরম্পরার শেষ গুরু

দেহাবসানের আগে পরমহংস যোগানন্দজি বলে গিয়েছিলেন, তিনি ওয়াইএসএস/এসআরএফ এর শেষ গুরু হবেন এটা ঈশ্বরেরই ইচ্ছা। তাঁর উত্তরাধিকারী কোনো শিষ্য বা নেতা কখনও তাঁর সম্প্রদায়ের গুরু উপাধি গ্রহণ করবেন না। এই দিব্য নির্দেশ ধর্মের ইতিহাসে বিরল নয়। গুরু নানক যিনি ভারতবর্ষে শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁর দেহত্যাগের পর গুরুর স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী পরম্পরা চলছিল। দশম গুরু ঘোষণা করলেন তিনিই এই গুরু পরম্পরার শেষ গুরু হবেন এবং এরপর শিক্ষাই তাঁদের গুরু হবেন।

পরমহংস যোগানন্দজি আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তাঁর যাওয়ার পরও তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের মাধ্যমে কাজ করে যাবেন। তিনি বলেছেন “যখন আমি থাকব না তখন শিক্ষাই গুরু হবেন…এই শিক্ষার মধ্যে দিয়েই তোমরা আমার সঙ্গে এবং যে মহান গুরুগণ আমায় পাঠিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।”

এই শেয়ার করুন