অন্যদের সাথে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে সম্প্রীতি তৈরি করা

শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দের লেখা থেকে উদ্ধৃতি

Two Swans depicting Harmony in Relationships.

ঈশ্বরসংযোগের সুখের পরেই সবচেয়ে বড়ো সুখ হল, যাদের সাথে বছরের প্রতিটি দিনই বসবাস করতে হয় সেইসব কাছের মানুষদের সাথে শান্তিতে থাকা। যখন মানুষ কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই মানব অনুভূতির অত্যন্ত জটিল কলকব্জাগুলি পরিচালনা করার চেষ্টা করে, তখন তার ফলাফল প্রায়ই ভয়াবহ হয়। খুব কম লোকই বুঝতে পারে যে আমাদের সুখের বেশিরভাগই মানুষের আচরণবিধি বুঝতে পারার মধ্যে নিহিত। এই কারণেই অনেক মানুষ প্রায়ই তাদের বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঝামেলায় পড়ে, আর তার চেয়েও খারাপ, তারা বাড়িতে তাদের নিজেদের প্রিয়জনদের সাথে ক্রমাগত ঝগড়ায় লিপ্ত থাকে।

মানুষের সঠিক আচরণের মূল নিয়ম হল আত্ম-সংস্কার… যখনই আমাদের বন্ধুবান্ধব বা প্রিয়জনদের সাথে কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তখন আমাদের উচিত সেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ার জন্য মনে মনে নিজেদের দোষ মেনে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি এবং অমায়িকভাবে সম্ভব তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা। অন্যদের উপর চেঁচিয়ে, নির্দয় এবং অভদ্রভাবে দোষারোপ করে ঝামেলা বাড়িয়ে কোনো ফল হয় না, যদিও আমরা দেখি যে তারাই দোষী। আমরা রূঢ় বা ধার্মিকম্মন্য কথার বদলে ভালো উদাহরণ স্থাপন করে রগচটা প্রিয়জনদের তাদের ভুল সংশোধন করতে শতগুণ ভালোভাবে শেখাতে পারি।

বেশিরভাগ সময়ই মানুষ তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলে এবং কাজ করে। তারা কদাচিৎ অন্য জনের দিকটি দেখে, এমনকি দেখার চেষ্টাও করে। যদি না বুঝেই তুমি কারো সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ো, তাহলে মনে রেখো যে, তোমরা প্রত্যেকেই অন্যজনের মতোই দোষী, তা তর্কের সূত্রপাত যেই করে থাকুক না কেন। “বোকারা তর্ক করে; জ্ঞানী লোকেরা আলোচনা করে।”

শান্ত মনে থাকার অর্থ এই নয়, যে যাই বলুক না কেন তুমি সর্বদা হাসিমুখে থাকবে, এবং সবার সাথে একমত হবে — তুমি সত্যের কদর কর কিন্তু তা নিয়ে কাউকে বিরক্ত করতে চাও না। সেটা কিন্তু তাহলে চরম পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। যারা ভালো স্বভাবের জন্য প্রশংসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় এইভাবে সবাইকে খুশি করার চেষ্টা করে, তারা যে নিজেদের অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে তা নয়… যার অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে সে সত্যকে অনুসরণ করে, যেখানেই পারে সেই সত্য তুলে ধরে, এবং যারা স্পষ্টতই তা গ্রহণ করবে না তাদের অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিরক্ত করা এড়িয়ে চলে। সে জানে কখন কথা বলতে হবে এবং কখন নীরব থাকতে হবে, কিন্তু সে কখনোই তার নিজের আদর্শ এবং অভ্যন্তরীণ শান্তির সাথে আপোশ করে না। এই ধরনের মানুষ এই জগতে মহাকল্যাণকারক একটি শক্তি।

আমাদের উচিত আন্তরিকতাপূর্ণ ভদ্র ভাষার সুন্দর পোশাকে আচ্ছাদিত হয়ে নিজেদের আকর্ষণীয় করে তোলা। সবার আগে আমাদের নিকট আত্মীয়দের প্রতি ভদ্র আচরণ করা উচিত। যখন কেউ তা করতে পারবে, তখন সে স্বভাবতই সব মানুষের প্রতি সদয় হবে। প্রকৃত পারিবারিক সুখের ভিত্তি সহানুভূতি এবং সহৃদয় কথার বেদীর ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। সহৃদয়তা দেখানোর জন্য সবকিছুতেই একমত হওয়া জরুরি নয়। কেউ অন্যের সাথে একমত হোক বা না হোক, শান্ত নীরবতা, আন্তরিকতা এবং সুশীল কথাবার্তা এমন এক ব্যক্তির লক্ষণ যে জানে কীভাবে আচরণ করতে হয়।

যদি তুমি ভালোবাসা পেতে চাও, তাহলে অন্যদের ভালোবাসতে শুরু করো যাদের তোমার ভালোবাসার প্রয়োজন… যদি তুমি চাও যে অন্যরা তোমার প্রতি সহানুভূতিশীল হোক, তাহলে তোমার চারপাশের লোকদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে শুরু করো। যদি তুমি সম্মান পেতে চাও, তাহলে তোমাকে ছোটো-বড়ো সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখতে হবে… তুমি অন্যদের যেরকম দেখতে চাও, প্রথমে তুমি সেইরকম হও; তাহলে তুমি দেখবে যে অন্যরাও তোমার প্রতি একইভাবে সাড়া দিচ্ছে।

বিবাহের আধ্যাত্মিক নীতি

Swans with reflection on water.

ঈশ্বরোপলব্ধির দিকে একে অপরকে সাহায্য করার জন্য যে দুজন নিজেদের জীবন যুক্ত করে, তারা তাদের বিবাহকে সঠিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করে: নিঃশর্ত বন্ধুত্ব।

স্বামী এবং স্ত্রী, পিতা-মাতা এবং সন্তান, বন্ধু এবং বন্ধু, নিজের এবং সকলের মধ্যে খাঁটি এবং নিঃশর্ত ভালোবাসা গড়ে তোলার শিক্ষা লাভ করতেই আমরা পৃথিবীতে এসেছি।

সত্যিকারের বিবাহ হল এমন একটি গবেষণাগার যেখানে স্বার্থপরতা, বদমেজাজ এবং খারাপ আচরণের বিষ ধৈর্যের টেস্টটিউবে ঢেলে দেওয়া যায় এবং তা প্রেমের উদ্দীপক শক্তি এবং মহৎ আচরণের নিরন্তর প্রচেষ্টা দ্বারা প্রশমিত এবং পরিবর্তিত হয়ে যায়।

যদি তোমার সঙ্গীর মধ্যে এমন কোনো অভ্যাস বা চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য থাকে যা তোমার স্বভাবের অপ্রীতিকর দিকগুলিকে জাগিয়ে তোলে, তাহলে তোমাকে এই পরিস্থিতির তাৎপর্য বুঝতে হবে: যা হল তোমার ভেতরে লুকিয়ে থাকা কলুষতাকে সামনে আনা যাতে তুমি সেগুলো দূর করতে পারো এবং এভাবে তোমার স্বভাবকে শুদ্ধ করতে পারো।

স্বামী বা স্ত্রী একে অপরের জন্য যে শ্রেষ্ঠতম কামনা করতে পারেন তা আধ্যাত্মিকতা; কারণ আত্মার বিকাশ হলে সহানুভূতি, ধৈর্য, চিন্তাশীলতা, ভালোবাসার মতো দিব্য গুণাবলি প্রকাশ পায়। কিন্তু প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত যে আধ্যাত্মিক বিকাশের আকাঙ্ক্ষা অন্যের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। নিজে প্রেমপূর্ণ জীবনযাপন করো, তাহলে তোমার সদাচরণ তোমার সকল প্রিয়জনকে অনুপ্রাণিত করবে।

একে অপরকে সুখী দেখার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যখন স্বামী স্ত্রীর সেবা করে এবং স্ত্রী স্বামীর সেবা করে, তখন খ্রিস্ট চেতনা — ঈশ্বরের প্রেমময় মহাজাগতিক বোধি যা সৃষ্টির প্রতিটি অণুতে ব্যাপ্ত — তাদের চেতনার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করে।

যখন দুজন মানুষ একে অপরের প্রতি নিঃশর্ত আকর্ষণ অনুভব করে এবং একে অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকে, তখন তারা সত্যিকার অর্থে প্রেমে আবদ্ধ হয়।

প্রিয়জনের জন্য পরিপূর্ণতা কামনা করা এবং সেই আত্মার কথা ভেবে বিশুদ্ধ আনন্দ অনুভব করা হল দিব্য প্রেম; এবং এটাই প্রকৃত বন্ধুত্বের প্রেম।

প্রতিদিন সকালে একসাথে ধ্যান করো, বিশেষ করে রাতে….একটি ছোটো পারিবারিক উপাসনার স্থান তৈরি করো, যেখানে স্বামী ও স্ত্রী এবং সন্তানেরা সকলে একত্রিত হয়ে ঈশ্বরের প্রতি গভীর ভক্তি নিবেদন করবে এবং নিত্য-আনন্দময় মহাজাগতিক চেতনায় নিজেদের আত্মাকে চিরকালের জন্য মিলিত করবে….তোমরা যত বেশি একসঙ্গে ধ্যান করবে, একে অপরের প্রতি তোমাদের ভালোবাসা ততই গভীর হবে।

সংকল্পবাক্য

সংকল্পবাক্যের তত্ত্ব এবং নির্দেশাবলী

“যখন আমি অন্যদের মধ্যে আমার প্রেম ও শুভেচ্ছা বিকীর্ণ করি, তখন আমি ঈশ্বরের প্রেম আমার ভিতর দিয়ে আসবার পথটিকেই খুলে দিই। ঐশ্বরিক প্রেম হল সেই চুম্বক যা সকল কল্যাণকে আমার দিকে আকৃষ্ট করে।

আরও জানতে হলে

এই শেয়ার করুন