"আমি নিজেকে একেবারে হালকা করে দিয়ে মনের সকল ভার ঝেড়ে ফেলি যাতে আমার মাধ্যমে ঈশ্বর তাঁর যথার্থ প্রেম, শান্তি ও জ্ঞান প্রকাশ করতে পারেন।"
— শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ

দেহ ও মনের নিরাময়ের জন্য সংকল্পবাক্যের শক্তি প্রয়োগ সম্বন্ধে সাধারণ জনসমাজ অবহিত হওয়ার বেশ কয়েক দশক আগেই পরমহংস যোগানন্দ সারা দেশের মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতাদের শেখাচ্ছিলেন কিভাবে প্রতিটি মানুষ নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসাধারণ আরোগ্যকারী ক্ষমতাগুলিকে সরাসরি প্রাপ্ত এবং প্রয়োগ করতে পারে। ১৯২৪-এ দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত তাঁর প্রথম বক্তৃতা-সফরের সময় তিনি আমেরিকান শ্রোতাদের এই শক্তিশালী নিরাময় পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৩০ এবং ৪০-এর দশক জুড়ে যখনই এই মহান গুরু তাঁর নিজের স্থাপিত এসআরএফ-এর মন্দিরগুলিতে অনুপ্রেরণামূলক উপদেশবাণী প্রদান করেছেন, তখন প্রায়ই উপস্থিত সকলকে নিয়ে নিরাময়ের জন্য, অথবা ইচ্ছাশক্তি বা ভক্তি জাগ্রত করার জন্য, বা ঈশ্বরের উপস্থিতির উপলব্ধি জাগ্রত করার জন্য কোনো একটি সংকল্পবাক্য দিয়ে তিনি শুরু বা শেষ করেছেন। আজ বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর নিরাময়কারী বিজ্ঞানসম্মত সংকল্পবাক্যগুলির অভ্যাস দ্বারা উপকৃত হয়েছেন।
পরমহংসজি তাঁর পথপ্রদর্শনকারী বই “সঙ্কল্প ও নিরাময়, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি”-তে বলেছেন
ঐকান্তিকতা, প্রত্যয়, বিশ্বাস এবং অন্তর্দৃষ্টিতে সংপৃক্ত বাক্যগুলি প্রচণ্ড বিস্ফোরক কম্পন-বোমার মতো হয়। তার বিস্ফোরণ ঘটলে তা যাবতীয় প্রতিবন্ধকতার পাহাড় ভেঙে অভিলষিত পরিবর্তন নিয়ে আসে….আন্তরিকভাবে উচ্চারিত কথা বা সংকল্পবাক্যকে যদি যথাযথ উপলব্ধি, অনুভূতি এবং আগ্রহের সঙ্গে বারবার উচ্চারণ করা হয়, তাহলে তা তোমাকে বিপন্মুক্ত করার জন্য সর্বব্যাপী, মহাজাগতিক স্পন্দনশীল শক্তিকে নিশ্চিতভাবে সক্রিয় করে তুলবে। যাবতীয় সন্দেহকে পরিত্যাগ করে, অটল বিশ্বাসে, সেই মহাশক্তির কাছে প্রার্থনা করো। তা না হলে তোমার একাগ্রতারূপী তীরটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারে।
"মহাজাগতিক চৈতন্যরূপী মৃত্তিকায় স্পন্দনশীল প্রার্থনারূপী বীজটিকে একবার প্রোথিত করার পর, তাতে অঙ্কুরের উদ্গম হয়েছে কিনা দেখার জন্য বারবার তাকে মাটি থেকে তুলে দেখা উচিত নয়। ঐশ্বরিক শক্তিগুলিকে অবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করার সুযোগ দাও।"
— সঙ্কল্প ও নিরাময়, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি, শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ
"ভিন্ন ভিন্ন সংকল্পবাক্য অভ্যাসের সময় মানুষের মনোভাব তার অনুরূপ ভিন্ন ভিন্ন হওয়া দরকার; যেমন ইচ্ছাশক্তি সম্বন্ধীয় সংকল্পবাক্য অভ্যাসের সময় দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ভাব, আবেগ সম্বন্ধীয় সংকল্পবাক্যের সময় ভক্তিভাব এবং যুক্তিবিচার সম্বন্ধীয় সংকল্পবাক্যের সময় পরিষ্কার ধারণা থাকার প্রয়োজন। কাউকে নিরাময় করার সময় এমন একটি সংকল্পবাক্য বেছে নিতে হবে যা আরোগ্যকামীর ঐচ্ছিক, কল্পনাত্মক, আবেগশীল বা চিন্তাশীল প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সমস্ত সংকল্পবাক্যের অভ্যাসের জন্য সর্বাগ্রে দরকার প্রগাঢ় মনোযোগ; তবে অবিচ্ছিন্নতা এবং পুনরাবৃত্তির গুরুত্বও অনেক। ফলের দিকে না তাকিয়ে সংকল্পবাক্যের সঙ্গে ভক্তি, ইচ্ছা এবং বিশ্বাসকে গভীরভাবে ও বারংবার মেলাতে হবে। তোমার পরিশ্রমের ফল একদিন স্বাভাবিকভাবেই তোমার কাছে আসবে।"
— সঙ্কল্প ও নিরাময়, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি, শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ
কেবলমাত্র শারীরিক নিরাময়ের জন্যই নয়, বরং সমস্ত বাধা অতিক্রম করে আমাদের জীবনে সর্বাত্মক সাফল্য নিয়ে আসার জন্য পরমহংস যোগানন্দ একাগ্র চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাবার প্রচ্ছন্ন নিয়মগুলি প্রকাশ করেছেন। শরীরের নিরাময়, আত্মবিশ্বাসের বিকাশ, জ্ঞানের জাগরণ, বদভ্যাস থেকে মুক্তি এবং আরও অনেক কিছুর জন্য বিস্তৃত নির্দেশাবলী এবং বিভিন্ন প্রকারের সংকল্পবাক্যগুচ্ছ এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সংকল্পবাক্য অভ্যাসের নির্দেশাবলী
একটি সংকল্পবাক্য বেছে নিন
সকালে ঘুম থেকে ওঠার ঠিক পরে অথবা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগেই সংকল্পবাক্য অভ্যাস করা সবচেয়ে কার্যকর। সংকল্পবাক্য অভ্যাসের আগে চেয়ারে বা শক্ত সমতল জায়গায় সঠিক ধ্যানের ভঙ্গীতে বসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেরুদণ্ড সোজা থাকবে, চোখ বন্ধ করে কোনো চাপ না দিয়ে দৃষ্টি এবং মনোযোগ দুই ভ্রূর মাঝখানে একত্রিত করতে হবে। অশান্ত ভাবনাচিন্তা ও উদ্বেগ থেকে মনকে মুক্ত রাখুন।
নিচের সংকল্পবাক্যগুলি থেকে কোনো একটি বেছে নিন এবং সম্পূর্ণ সংকল্পবাক্যটি বারবার বলতে থাকুন — প্রথমে স্বাভাবিক স্বরে, তারপর ক্রমশ ধীরে ধীরে এবং মৃদুস্বরে, যতক্ষণ না আপনার স্বর এক অস্ফুট ধ্বনিতে পরিণত হয়। অবশেষে শুধু মনে মনে সংকল্পবাক্যটি বলতে থাকুন যতক্ষণ না আপনার মনে হয় যে আপনি এক গভীর অবিচ্ছিন্ন একাগ্রতা লাভ করেছেন। ক্রমবর্ধমান শান্তি অনুভব করার সাথে সাথে নিজের একাগ্রতা গভীরতর করার জন্য প্রযত্ন করুন, যাতে আপনি অতিচেতন জগতে প্রবেশ করতে পারেন এবং সংকল্পবাক্যটি মূর্ত করতে পারেন।
“অনন্ত জ্যোতির মধ্যে আমি নিমজ্জিত। সেই জ্যোতি আমার সত্তার কণায় কণায় পরিব্যাপ্ত। সেই জ্যোতিতেই আমি নিবাস করি। পরমাত্মা আমাকে অন্তরে ও বাহিরে পরিপূর্ণ করে রেখেছেন।”

“ভগবান আমার অন্তরে-বাহিরে সর্বত্রই আছেন এবং আমাকে রক্ষা করছেন; তাই, আমার যে ভীতি তাঁর পথনির্দেশক জ্যোতি আগমনের পথকে রুদ্ধ করছে, তাকে আমি চিরতরে দূরীভূত করব।”

“হে পূর্ণ পরমপিতা — তোমারই জ্যোতি খ্রিস্ট, সর্বধর্মের সাধুসন্তগণ, ভারতের মহান গুরুগণ, এবং আমার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেই দিব্য জ্যোতি আমার সর্ব অঙ্গে বিদ্যমান। আমি সুস্থ।”

“আমি জানি যে ঈশ্বর অসীম শক্তির অধিকারী। আর যেহেতু আমি তাঁরই ভাবমূর্তি, তাই যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার শক্তি আমারও আছে।”

“আমি নিজেকে একেবারে হালকা করে দিয়ে মনের সকল ভার ঝেড়ে ফেলি যাতে আমার মাধ্যমে ঈশ্বর তাঁর যথার্থ প্রেম, শান্তি ও জ্ঞান প্রকাশ করতে পারেন।”

“জন্মগ্রহণে, দুঃখে, আনন্দে, সকল কর্মে, আমার ধ্যানে, অজ্ঞানতায়, বিপদে, মৃত্যুতে, এবং অন্তিম মুক্তিতে আমি সর্বদাই তোমার সর্বরক্ষাকারী, সর্ববিদ্যমানতার জ্যোতির্মন্ডলীর দ্বারা পরিবৃত হয়ে আছি, আমাকে এই অনুভব করতে শেখাও।”

“তোমার মঙ্গল আলোক এবং রক্ষাকারী শক্তি, সর্বদাই আমার ভিতর প্রজ্জ্বলিত রয়েছে। আমার জ্ঞানচক্ষু মুদিত ছিল বলে আমি তাকে দেখতে পাইনি। এখন তোমার শান্তির স্পর্শে আমার চোখ খুলে যাওয়ায় আমি দেখছি — তোমার দয়া এবং অব্যর্থ রক্ষাকারী-শক্তি, আমার ভিতর প্রবাহিত হচ্ছে।”

“হে আমার পরমপিতা, তুমিই প্রেম, আর আমি তোমার প্রতিমূর্তি রূপে গড়া। আমি প্রেমের সেই অনন্ত বৃত্ত, যার মধ্যে আমি সকল গ্রহপুঞ্জ, সকল নক্ষত্ররাজি, সকল প্রাণী, সকল সৃষ্টিকে ঝিকিমিকি আলোর মতো দেখি। আমি সেই প্রেম যা সমগ্র জগৎকে আলোকিত করে।”

“অত্যন্ত কঠিন হলেও আমার হাসি দিয়ে আমি বিলাপরত মানুষকে হাসতে সাহায্য করব।”

“আমি সবার প্রতি ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা বিকীর্ণ করব, যাতে ঈশ্বরের ভালোবাসা সকলের কাছে পৌঁছোনর একটি পথ হতে পারি।”
এখানে দেওয়া সংকল্পবাক্যগুলি পরমহংস যোগানন্দজির সংকল্প ও নিরাময়, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি, এবং আধ্যাত্মিক ধ্যান, এই দুটি বই থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।