আমরা অনেকেই নিজেদের বাইরের জগতে পরিপূর্ণতা খুঁজি। আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বাস করি যেখানে আমাদেরকে এই বিশ্বাস করতে শেখানো হয় যে বাহ্যিক প্রাপ্তিই আমাদের আকাঙ্খা পূরণ করতে পারে। কিন্তু বারবার আমাদের অভিজ্ঞতা আমাদের দেখিয়ে দেয় যে বাইরের কোনো কিছুই “আরও কিছু”-র জন্য অন্তরের গভীর আকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে পূরণ করতে পারে না।
অধিকাংশ সময়ে, আমরা নিজেদেরকে এমন কিছুর জন্য সংগ্রাম করতে দেখি যা সবসময় আমাদের নাগালের বাইরে বলে মনে হয়। আমরা ‘হওয়া’র চেয়ে ‘করা’তেই বেশি মগ্ন থাকি, সচেতনতার চেয়ে কর্মে বেশি লিপ্ত থাকি। আমাদের পক্ষে সম্পূর্ণ প্রশান্তি ও প্রতিক্রিয়ার এমন একটি অবস্থার কল্পনা করা কঠিন, যেখানে চিন্তা ও অনুভূতি অবিরাম নৃত্যে মত্ত থাকে না। তথাপি, এই প্রকার নিস্তব্ধতার মাধ্যমেই আমরা এমন এক স্তরের আনন্দ ও উপলব্ধির স্পর্শ পেতে পারি, যা অন্যথায় লাভ করা অসম্ভব।
বাইবেলে বলা হয়েছে: “স্থির হও এবং জানো যে আমিই ঈশ্বর।” এই কয়েকটি শব্দের মধ্যেই যোগ বিজ্ঞানের মূল সূত্র নিহিত আছে। এই প্রাচীন আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান আমাদের চিন্তার স্বাভাবিক চাঞ্চল্য এবং শরীরের অস্থিরতা দূর করে সরাসরি সেই জ্ঞান লাভের উপায় বলে দেয়, যা আমাদের প্রকৃত স্বরূপ জানতে বাধা দেয়।
সাধারণত আমাদের সচেতনতা এবং শক্তি বহির্মুখী হয়ে এই জগতের বিষয়গুলির দিকে ধাবিত হয়, যেগুলিকে আমরা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সীমিত উপকরণের মাধ্যমে উপলব্ধি করি। যেহেতু মানবীয় যুক্তি শারীরিক ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সরবরাহকৃত আংশিক এবং প্রায়শই মিথ্যা তথ্যের উপর নির্ভরশীল, তাই জীবনের প্রহেলিকা — আমি কে? কেন আমি এখানে? কিভাবে আমি সত্য উপলব্ধি করব? – এসব সমাধান করতে হলে, আমাদের গভীরতর এবং সূক্ষ্ম স্তরের সচেতনতাকে কাজে লাগাতে শিখতে হবে।
যোগ হল একটি সরল প্রক্রিয়া, যা শক্তি ও চেতনার স্বাভাবিক বহির্মুখী প্রবাহকে বিপরীতমুখী করে। এর ফলে মন একটি গতিশীল কেন্দ্রে পরিণত হয়, যা প্রত্যক্ষ উপলব্ধির মাধ্যমে ভ্রমপ্রবণ ইন্দ্রিয়সমূহের উপর নির্ভরশীল না থেকে সত্যের অভিজ্ঞতা লাভে সক্ষম হয়।
আবেগপূর্ণ যুক্তির বশবর্তী হয়ে অথবা অন্ধ বিশ্বাসের মাধ্যমে কোনো কিছুকে গ্রহণ না করে, যোগের ক্রমিক পদ্ধতিগুলি অনুশীলনের দ্বারা আমরা সেই অসীম চৈতন্য, শক্তি ও আনন্দের সাথে নিজেদের একাত্মতা উপলব্ধি করতে পারি যা সবকিছুকে জীবন দেয় এবং যা আমাদের নিজ সত্ত্বার সার।
বিগত শতাব্দীগুলিতে, যোগের অনেক উচ্চতর প্রক্রিয়া মানবজাতির মহাবিশ্বের চালিকা শক্তি সম্পর্কে সীমিত জ্ঞানের কারণে খুব কমই বোঝা বা অনুশীলন করা হোত। কিন্তু আজ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান দ্রুত আমাদের নিজেদের এবং বিশ্বকে দেখার পদ্ধতি পরিবর্তন করছে। জীবনের ঐতিহ্যবাহী বস্তুবাদী ধারণা বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই আবিষ্কারের সাথে যে বস্তু এবং শক্তি মূলত একই: প্রতিটি বিদ্যমান পদার্থকে শক্তির একটি বিন্যাস বা রূপে হ্রাস করা যেতে পারে, যা অন্যান্য রূপের সাথে যোগাযোগ ও আন্তঃসংযোগ স্থাপন করে। আজকের কিছু বিখ্যাত পদার্থবিদ আরও একধাপ এগিয়ে চেতনাকে সকল সত্ত্বার মৌলিক ভিত্তি রূপে চিহ্নিত করছেন। এইভাবে আধুনিক বিজ্ঞান যোগের প্রাচীন নীতিগুলির সত্যতা প্রমাণ করছে, যা ঘোষণা করে যে একত্ব মহাবিশ্বে পরিব্যাপ্ত।
যোগ শব্দটির অর্থ হল “মিলন”: ব্যক্তিগত চেতনা বা আত্মার সাথে সর্বজনীন চেতনা অথবা পরমাত্মার মিলন। যদিও অনেকে যোগকে শুধুমাত্র শারীরিক ব্যায়াম হিসেবে মনে করেন — আসন বা শারীরিক ভঙ্গি যা সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে — এগুলো আসলে এই গভীর বিজ্ঞানের বাহ্যিক দিক যে বিজ্ঞান মানব মন ও আত্মার অসীম সম্ভাবনা উন্মোচন করে।
এই লক্ষ্যে পৌঁছোনর জন্য বিভিন্ন যোগ মার্গ রয়েছে, যার প্রত্যেকটি একটি সমন্বিত পদ্ধতির বিশেষ শাখা:
হঠ যোগ — শারীরিক ভঙ্গি বা আসনসমূহের একটি পদ্ধতি, যার প্রধান উদ্দেশ্য হল শরীরকে শুদ্ধ করা এবং এর অভ্যন্তরীণ অবস্থার ওপর সচেতন নিয়ন্ত্রণ আনা, যা শরীরকে ধ্যানের উপযোগী করে তোলে।
কর্ম যোগ — ফলাকাঙ্খা বর্জিত হয়ে অনাসক্ত চিত্তে নিজের বৃহত্তর স্বরূপের অংশ হিসাবে অন্যদের প্রতি নিঃস্বার্থ সেবা; এবং ঈশ্বরকে কর্তারূপে জেনে সমস্ত কর্ম সম্পাদন করা।
মন্ত্র যোগ — জপের মাধ্যমে অন্তরের চৈতন্যে স্থিত হওয়া অথবা বিশেষ আধ্যাত্মিক চেতনার প্রতিনিধিত্বকারী কিছু সার্বজনীন মূল শব্দ-ধ্বনির পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমে চৈতন্যের কেন্দ্রস্থাপন।
ভক্তি যোগ — সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অর্জিত সেই ভক্তি, যার দ্বারা সাধক প্রতিটি জীব ও বস্তুর মধ্যে দেবত্ব দেখতে ও ভালোবাসতে সচেষ্ট হন এবং এইভাবে অবিরাম ঈশ্বরের উপাসনা করেন।
জ্ঞান যোগ — প্রজ্ঞার পথ, যা আধ্যাত্মিক মুক্তিলাভের জন্য বিশেষ বিচারবুদ্ধির প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দেয়।
রাজযোগ — যোগের রাজকীয় অথবা সর্বোচ্চ পথ, ভগবান কৃষ্ণ কর্তৃক ভগবদগীতায় অমর করে যাওয়া এবং ভারতীয় ঋষি পতঞ্জলি কর্তৃক খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে আনুষ্ঠানিকভাবে সুবিন্যস্ত, যা অন্যান্য সকল পথের সারমর্মকে একত্রিত করে।
রাজযোগ পদ্ধতির কেন্দ্রস্থলে, এই বিভিন্ন প্রকার প্রচেষ্টাকে ভারসাম্যপূর্ণ ও একত্রিত করে, রয়েছে সুনির্দিষ্ট, বিজ্ঞানসম্মত ধ্যান প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সাধনার প্রথম থেকেই পরম লক্ষ্যের আভাস উপলব্ধি করা যায় — সেই অনন্ত আনন্দময় পরমাত্মার সঙ্গে সচেতন সংযোগ।
যোগের লক্ষ্যে পৌঁছোনর সবচেয়ে দ্রুত এবং কার্যকরী পদ্ধতি হল সেই ধ্যান প্রক্রিয়া, যা সরাসরি শক্তি ও চেতনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ক্রিয়াযোগই সেই বিশেষ রাজযোগ ধ্যান, যা পরমহংস যোগানন্দ শিখিয়েছেন এবং এই প্রত্যক্ষ পদ্ধতিই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।