শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ রচিত মানুষের চিরন্তন অন্বেষণ গ্রন্থের "ঈশ্বরের অসীম শক্তির সাহায্যে নিরাময়করণ" থেকে কিছু অংশ।
অ-সুস্থতা কি?
ব্যাধি তিন প্রকার: দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক।
বিবিধ ধরণের বিষক্রিয়াজনিত অবস্থা, সংক্রামক রোগ, ও দুর্ঘটনার কারণে দৈহিক ব্যাধি হয়ে থাকে।
ভয়, উদ্বেগ, রাগ ও অন্যান্য আবেগজনিত অসংগতির কারণে মানসিক রোগ দেখা দেয়।
আর আত্মিক রুগ্নতার কারণ হল – ঈশ্বরের সঙ্গে তার প্রকৃত সম্পর্কের ব্যাপারে মানুষের অজ্ঞতা।
অজ্ঞতাই হল সব চেয়ে বড়ো ব্যাধি। অজ্ঞতা দূরীভূত হলে দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাধির কারণও দূরীভূত হয়। আমার শ্রীগুরু স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বরজি প্রায়ই বলতেন: “জ্ঞানই হল সর্বশ্রেষ্ঠ পরিশোধক।”
ভৌত নিরাময় পদ্ধতির সীমিত শক্তির সাহায্যে বিভিন্ন প্রকার যাতনাকে জয় করার চেষ্টা প্রায়শই হতাশাজনক হয়ে থাকে। একমাত্র অধ্যাত্ম প্রক্রিয়ার অপরিমেয় শক্তির সাহায্যেই মানুষ দেহ, মন ও আত্মার “অ-সুস্থতা” থেকে স্থায়ী নিরাময়লাভ করতে পারে। ঈশ্বরের থেকেই নিরাময়ের ওই সীমাহীন শক্তি পাওয়া যেতে পারে। যদি আপনি প্রিয়জনের মৃত্যুতে মানসিক আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে ঈশ্বরের কাছেই আবার তাদের দেখা পাবেন। ঈশ্বরের কৃপায় সব কিছুই সম্ভবপর হয়। যে ঈশ্বরকে প্রকৃত জানে না তারপক্ষে একথা বলা কদাপি উচিত নয় যে, কেবলমাত্র মনেরই অস্তিত্ব আছে; তার এই কথা বলাও অন্যায় যে, স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রয়োজন নেই, অথবা নিরাময়ের জন্য কোনোরকম ভৌত সাহায্যেরও দরকার নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না ঈশ্বরোপলব্ধি হচ্ছে, ততক্ষণ সকল কাজে মানুষের উচিত নিজের সাধারণ জ্ঞানকে প্রয়োগ করা। সেইসঙ্গে ঈশ্বরবিষয়ে সন্দেহপোষণ করাও উচিত নয়; বরং ঈশ্বরের সর্বব্যাপী দিব্যশক্তির প্রতি নিজের আস্থাকে সর্বদা ব্যক্ত করাই কর্তব্য।
চিকিৎসকেরা রোগের কারণ নির্ণয় ও তাদের দূর করার শিক্ষা গ্রহণ করেন, যাতে তা পুনরায় দেখা দিতে না পারে। রোগ নিরাময়ে নির্দিষ্ট ভৌত দ্রব্যের প্রয়োগে ডাক্তাররা খুবই দক্ষ হন। তবে সব রোগ ওষুধ ও শল্যচিকিৎসায় সাড়া দেয় না; আর ঠিক এখানেই রয়েছে ওইসব পদ্ধতির আসল সীমাবদ্ধতা।
রাসায়নিক বস্তু ও ওষুধপত্র শুধুমাত্র দেহকোশের বাহ্য ভৌত গঠনকেই প্রভাবিত করতে পারে – ভেতরের আণবিক গঠন অথবা কোশের জৈব নিয়মগুলিকে পরিবর্তন করতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে – রোগ নিরাময় ততক্ষণ সম্ভবপর হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ভেতর থেকে ঈশ্বরের নিরাময়কারী শক্তি, দেহের চৈতন্যময় প্রাণশক্তি, অথবা ‘লাইফট্রনের’ ভারসাম্যতার অভাবকে সংশোধন করে দিচ্ছে।
আপনার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন
উপবাস হল রোগ নিরাময়ের একটা সাধারণ পদ্ধতি। জীবজন্তু অথবা বন্য প্রাণীরা অসুস্থ হলে আহার পরিত্যাগ করে। তারফলে শরীরের কল-কব্জাগুলি নিজেদের পরিস্কার করে নিতে পারে, এবং সেইসঙ্গে প্রয়োজনীয় কিছু বিশ্রামও পায়। বুদ্ধি-বিবেচনা করে উপবাস করলে অনেক রোগ থেকেই মুক্তি পাওয়া যায়। হৃৎপিন্ডের দুর্বলতা না থাকলে, নিয়মিত স্বল্পকালীন উপবাস করাকে ভালো স্বাস্থ্যবিধি বলে যোগীরা মতামত দিয়েছেন। দৈহিক রোগ নিরাময়ে আর একটা সুন্দর উপায় হল ঔষধি বা তার রস ব্যবহার করা।
অনেক সময় ওষুধ ব্যবহার করে দেখা গেছে যে রোগ নিরাময়ের মতো যথেষ্ট ক্ষমতা তাদের নেই, অথবা তাদের শক্তি এত বেশি যে, রোগ নিরাময় করার বদলে তারা দেহকোশকেই উত্তেজিত করে তুলছে। সেইরকম, কয়েক ধরণের ‘নিরাময়কারী রশ্মিতে’ বেশিক্ষণ থাকলে কোশগুলি জ্বলে যায়। অতএব দেখা যাচ্ছে, রোগ নিরাময়ের ভৌত প্রক্রিয়া ব্যবহারের মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে!
ওষুধের চেয়েও ভালো হল সূর্যরশ্মি। সূর্যরশ্মিতে অত্যাশ্চর্য রোগ নিরাময় ক্ষমতা আছে। সবার উচিত রোজ অন্তত দশ মিনিট রোদে দাঁড়ানো। অনেকদিন অন্তর দীর্ঘসময় সূর্যস্নানের চেয়ে রোজ দশ মিনিট সূর্যস্নান ভালো। রোজ অল্পসময় সূর্যস্নান, তার সঙ্গে সুস্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে, যাবতীয় ক্ষতিকর বীজাণু ধ্বংসকারী প্রাণশক্তি দেহ যথেষ্ট পরিমাণে লাভ করতে পারবে।*
যারা স্বাস্থ্যবান, রোগ প্রতিরোধের একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা তাদের থাকে – বিশেষ করে সংক্রামক ব্যাধি থেকে। কুখাদ্য খাওয়া বা অতিভোজনের কারণে যখন রক্তের প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, অথবা অতিরিক্ত কামপ্রবণতা যখন প্রাণশক্তিকে হ্রাস করে, তখনই রোগ দেখা দেয়। দেহের শুক্রশক্তিকে ধারণ করতে হলে সমস্ত কোশে স্পন্দমান প্রাণশক্তি সরবরাহ করা প্রয়োজন; তখন দেহে প্রবল রোগপ্রতিরোধী শক্তি সঞ্চিত হয়। অতিরিক্ত যৌনকামনা শরীরকে দুর্বল করে, ফলে তা অসুস্থতার শিকার হয়।
[*টীকা: ভোরে বা বেলার দিকে সূর্যস্নান করা বুদ্ধিমানের কাজ। সংবেদনশীল ত্বকে যাতে বেশি রোদ না লাগে, তার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। সূর্যকিরণে শরীর অনাবৃত করা সংক্রান্ত ব্যাপারে যদি কারোর প্রশ্ন থাকে, তবে তার উচিত হবে গৃহচিকিৎসক অথবা কোনো চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া।]
হাসির শক্তি
শুক্রশক্তি সঞ্চয় করুন, সুষম আহার করুন, সদা হাসুন আর সুখী হোন। যে নিজের মধ্যে আনন্দের সন্ধান পায়, সে বুঝতে পারে – ঈশ্বরের কৃপাতেই তার দেহ বিদ্যুৎতরঙ্গ ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর – খাদ্যদ্রব্যের কারণে নয়। যদি মনে হয় হাসতে আপনি অক্ষম, তাহলে একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে টেনে মুখ ফাঁক করে হাসি আনতে চেষ্টা করুন। হাসতে পারাটা এতটাই জরুরী!
খাবারদাবার, ভেষজ দ্বারা দেহ শুদ্ধকরণ অথবা উপবাস সম্বন্ধীয় নিরাময়করণ প্রক্রিয়ার বিষয়ে যা আলোচনা করলাম, তার কার্যকারিতা কিন্তু সীমাবদ্ধ; কিন্তু কেউ যদি অন্তরে উৎফুল্ল থাকে, তাহলে সে ঈশ্বরের অফুরন্ত শক্তির সাহায্যলাভ করে থাকে। আমি এখানে ঐকান্তিক আনন্দের কথাই বলছি – যে আনন্দের ভাণ আপনি বাইরে করেন অথচ অন্তরে অনুভব করেন না, তার কথা আমি বলছি না। আনন্দ ঐকান্তিক হলে আপনি হাসির ক্রোড়পতি হবেন। অনাবিল হাসি সারা দেহকোশে প্রাণশক্তি সঞ্চার করে থাকে। সুখী মানুষদের রোগ হয় কম, কেননা সুখ প্রকৃতপক্ষে দেহে অনেক বেশি পরিমাণে বৈশ্বিক প্রাণশক্তি আহরণ করে থাকে।
এই নিরাময় প্রসঙ্গে অনেক কিছুই আলোচনা করার আছে। আসল কথা হল – অপরিমিত মানসিক শক্তির ওপর নির্ভর করা চাই। রোগ প্রতিরোধ করার উপায়গুলি হল: আত্ম-সংযম, ব্যায়াম, উপযুক্ত আহার, প্রচুর ফলরস পান করা, মাঝে মাঝে উপবাস, সবসময় মনে মনে হাসি-খুশি থাকা ইত্যাদি। ওই হাসি ধ্যান থেকে আসে। তবেই আপনি ঈশ্বরের শাশ্বত শক্তির সন্ধান পাবেন। যখন আপনি ঈশ্বরের সঙ্গে তুরীয়ানন্দে মগ্ন থাকেন, তখন আপনি সচেতনভাবে নিজ দেহে ঈশ্বরের আরোগ্যদায়ী উপস্থিতি আকর্ষণ করে আনেন।

মানসিক শক্তির সঙ্গে ঈশ্বরের অব্যর্থ শক্তি সদাই সংযুক্ত থাকে; ওই শক্তিকেই আপনি নিজের দেহেতে চান। সেই শক্তিকে আকৃষ্ট করার একটা উপায় আছে এবং তা হল – ধ্যানের মধ্যে ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা। যখন আপনার ঈশ্বর-সংযোগ সম্পূর্ণ হবে, তখন নিরাময় স্থায়ী হবে।
দিব্য নিরাময়
অবিরাম প্রার্থনা ও অবিচল বিশ্বাস দ্বারাই পরাশক্তিকে আবাহন করা যায়। যোগ্য আহার করতে হবে এবং দেহের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাজও করতে হবে; আর সেই সঙ্গে ভগবানের কাছে সর্বক্ষণ প্রার্থনা জানিয়ে বলতে হবে: “ঠাকুর, তুমিই পারো আমাকে নিরাময় করে তুলতে, কেননা তুমিই হলে দেহের প্রাণকণা ও সূক্ষ্ম অবস্থার নিয়ন্ত্রক, যার নাগাল ডাক্তার ও ওষুধপত্র পায় না।” বহিরঙ্গে ওষুধ ও উপবাসের কিছু উপকারী প্রভাব দেহেতে থাকে বটে, তবে ভেতরের যে শক্তি কোশসমূহকে বাঁচিয়ে রাখে, তাকে কোনোভাবে সে প্রভাবিত করতে পারে না। একমাত্র যখন আপনি ঈশ্বরের কাছে গিয়ে তাঁর আরোগ্যদায়ী শক্তি লাভ করেন, তখনই কেবল দেহকোশের কণার দিকে প্রাণশক্তি চালিত হয় এবং তাৎক্ষণিক আরোগ্যদান করে থাকে। তাই, আপনাদেরও কি উচিত নয় ঈশ্বরের ওপর বেশি করে নির্ভর করা?
তবে ভৌত থেকে অধ্যাত্ম প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করার চেষ্টা ধীরেসুস্থেই করা উচিত। অমিত ভোজনে অভ্যস্ত কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মানসিক নিরাময়লাভের আকাঙ্খায় সে যদি হঠাৎ উপবাস শুরু করে দেয়, তাহলে কোনোরকম সাফল্য দেখতে না পেয়ে সে হয়তো হতাশ হয়ে পড়তে পারে। খাদ্যের ওপর নির্ভরতা থেকে মনের ওপর নির্ভরতা – মানুষের চিন্তাধারায় এই পরিবর্তন ঘটাতে অনেক সময় লাগে। ঈশ্বরের আরোগ্যকারী শক্তিলাভের জন্য উপযুক্ত হতে হলে, মনকে অবশ্যই দৈব সহায়তায় ‘বিশ্বাসী’ হবার শিক্ষা নিতে হবে।
ওই পরাশক্তি থেকেই যাবতীয় আণবিক শক্তি, ভৌত বিশ্বের প্রতিটি কোশে স্পন্দিত, বিকশিত ও পরিপুষ্ট হয়ে চলেছে। প্রেক্ষাগৃহের অভিক্ষেপ কক্ষ (projection booth) থেকে অভিক্ষিপ্ত আলোকধারা যেমন চলচ্চিত্রকে উজ্জ্বল করে, তেমনি, আমরাও সবাই মহাজাগতিক আলোকধারায় পরিপুষ্ট হই। এ হল এক দিব্য জ্যোতি, যা অনন্তের অভিক্ষেপ কক্ষ থেকে সম্পাদিত হয়ে চলেছে। যখন আপনি সেই জ্যোতির সন্ধান করবেন ও তার খোঁজ পাবেন, তখন আপনি সমস্ত দেহকোশে যত অকার্যকর অণু, ইলেক্ট্রন ও লাইফট্রন রয়েছে তাদের পুনর্গঠনে এর অসীম শক্তির পরিচয়কে জানতে পারবেন। ওই মহান আরোগ্যদাতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করুন!
নিরাময়ের জন্য সংকল্পবাক্য
আমার শারীরিক ব্যাধির অন্ধকার কোণায় কোণায় ঈশ্বরীয় সুস্বাস্থ্য ছড়িয়ে পড়েছে। আমার সকল কোশ ঈশ্বরের নিরাময়কারী জ্যোতিতে উদ্ভাসিত। তাদের মধ্যে ঐশ্বরিক পরিপূর্ণতা রয়েছে বলে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ।

পরমাত্মার আরোগ্যদায়ী শক্তি আমার দেহের প্রতিটি কোশের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। বিশ্বজনীন ঈশ্বরীয় উপাদানে আমিও সৃষ্ট।

আমার দেহের সকল অংশে তোমার পূর্ণ জ্যোতি দিব্যভাবে বিরাজমান। যেখানেই সেই নিরাময়কারী আলোকরশ্মি প্রকাশিত, সেখানেই পূর্ণতা। আমি সুস্থ, কেননা ভগবানের পূর্ণতা আমার মধ্যে বিরাজ করছে।

আমি সেই পরিবর্তনহীন, আমিই সেই অনন্ত। আমি এক ক্ষুদ্র মরণশীল, ভঙ্গুর অস্থিযুক্ত, নশ্বর দেহধারী প্রাণীমাত্র নই। আমি সেই মৃত্যুহীন, পরিবর্তনহীন অনন্ত।
আরও জানতে হলে
- সংকল্প ও নিরাময়, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি – শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ
- “অনশনের শারীরিক ও আত্মিক উপযোগিতা,” মানুষের চিরন্তন অন্বেষণ – শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ
- "Mind Power Can Help You Lose or Gain Weight," The Divine Romance by Sri Sri Paramahansa Yogananda
- "How to Work Without Fatigue," The Divine Romance by Sri Sri Paramahansa Yogananda
- "Healing the Sick," Discourse 25 in The Second Coming of Christ: The Resurrection of the Christ Within You by Sri Sri Paramahansa Yogananda
- "The Mind: Repository of Infinite Power," The Divine Romance by Sri Sri Paramahansa Yogananda
যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার বিশ্বব্যাপী প্রার্থনাচক্রের নিরাময়কারী প্রার্থনার জন্য অনুরোধ জানান।