শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দের লেখা থেকে উদ্ধৃতি

ক্রোধের অনুপস্থিতিই মানসিক শান্তি লাভের দ্রুততম উপায়। আমাদের ইচ্ছায় বাধা পড়লেই আমাদের রাগ হয়… যিনি অন্যের কাছে কিছুই প্রত্যাশা করেন না, বরং সমস্ত প্রকার পরিপূর্ণতার জন্য ঈশ্বরের উপর নির্ভর করেন, তিনি তাঁর সঙ্গীদের প্রতি ক্রোধ বা হতাশা অনুভব করতে পারেন না। সাধু এই জেনে সন্তুষ্ট থাকেন যে প্রভুই এই জগৎকে চালাচ্ছেন… তিনি ক্রোধ, বিদ্বেষ এবং ক্ষোভ থেকে মুক্ত।

যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমাদের রাগের উদ্রেক হয়, রাগ সেই উদ্দেশ্যটিকেই ব্যর্থ করে দেয়। রাগের ওষুধ রাগ নয়। কারো তীব্র ক্রোধ অন্য একজনকে তার দুর্বল ক্রোধ চেপে রাখতে বাধ্য করতে পারে, কিন্তু তা কখনোই সেই দুর্বল ক্রোধকে বিনষ্ট করতে পারবে না। যখন রেগে আছ, তখন কিছু বোলো না। মনে রেখো এও একটি রোগ, ঠান্ডা লাগার মতো; তাই সেই প্রিয়জনদের কথা ভাবো যাদের ওপর তুমি কখনোই রাগ করতে পারো না, সে তারা যাই করুক না কেন; সেই ভাবনা মানসিক উষ্ণ স্নানের মতো তোমার রাগকে গলিয়ে দেবে। যদি তোমার আবেগ খুব বেশি তীব্র হয়, তাহলে ঠান্ডা জলে স্নান করো, অথবা সুষুম্নাশীর্ষকের ওপরে, মাথার দুপাশে কানের ঠিক ওপরে, কপালে, বিশেষ করে দুই ভ্রুর মাঝখানে এবং মাথার চাঁদিতে বরফের টুকরো লাগাও।

ক্রোধ থেকে ঈর্ষা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, প্রতিশোধস্পৃহা, ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি, অযৌক্তিক ভাবনাচিন্তা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা এবং সাময়িক পাগলামির জন্ম হয় — যার যে কোনো একটিই ভয়াবহ অপরাধের কারণ হতে পারে। এটি শান্তি ও ধীরতার জন্য বিষবৎ। এটি বিচারবুদ্ধির জন্যও বিষবৎ। ক্রোধ হল এক রকমের ভুল বোঝাবুঝি। ক্রোধের দ্বারা অন্যদের জয় করার চেষ্টা মূর্খামি, কারণ ক্রোধ কেবল শত্রুর মধ্যে আরও ক্রোধ জাগিয়ে তোলে এবং তার ফলে শত্রু আরও শক্তিশালী এবং পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। অন্যের ক্ষতি না করে অশুভকে ঠেকাতে ন্যায্য রাগ দেখানো কখনো কখনো ভালো ফল দিতে পারে। অন্ধ, অনিয়ন্ত্রিত রাগ হল প্রতিশোধপরায়ণ এবং বিদ্বেষপূর্ণ; তা কেবল সেই অশুভকেই বাড়ায় যা তুমি বিনষ্ট করতে চাও। যারা তোমাকে রাগিয়ে মজা পায় তাদের প্রতি উদাসীন থাকো।

যখন রাগ আসে, তখন শান্তি, ভালোবাসা এবং ক্ষমার মতো ওষুধ তৈরি করার জন্য তোমার প্রশান্তির যন্ত্রটিকে সচল করো যা রাগকে দূর করে। ভালোবাসার কথা ভাবো, এও ভাবো যে অন্যরা তোমার ওপর রাগ করুক তা যেমন তুমি চাও না, তুমি এও চাও না যে অন্যরা তোমার কদর্য রাগের শিকার হোক। যখন তুমি খ্রীষ্টের মতো হয়ে সমস্ত মানবজাতিকে এইভাবে দেখ যেন ছোটো ছোটো ভাইয়েরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে (“কারণ তারা জানে না তারা কি করছে”) তখন তুমি কারোর ওপর রাগ করতে পারবে না। অজ্ঞানতাই সমস্ত ক্রোধের জননী।

আধ্যাত্মিক যুক্তিবিচারের বিকাশ করে রাগ বিনষ্ট করো। যে তোমার রাগের উদ্রেক করেছে তাকে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে দেখো; মনে করো সে তোমার পাঁচ বছরের ছোট্ট এক ভাই যে হয়তো না বুঝে তোমাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। উলটে এই ছোটো ভাইটিকে ছুরি দিয়ে আঘাত করার ইচ্ছা হওয়া তোমার ঠিক নয়। মনে মনে এই বলে রাগ বিসর্জন দাও: “আমি রাগ দিয়ে আমার শান্তিকে বিষিয়ে দেব না; আমি রাগ দিয়ে আমার স্বভাবসিদ্ধ আনন্দদায়ক প্রশান্তিকে নষ্ট করব না।”

মোটামুটি দুই ধরণের মানুষ আছে: এক যারা পৃথিবীতে কতকিছু খারাপ আছে তা নিয়ে ক্রমাগত বিলাপ করে এবং আর এক যারা জীবনের অসুবিধাগুলিকে হাসিমুখে উপেক্ষা করে এবং চিন্তাভাবনাকে সর্বদা ইতিবাচক রাখে। সবকিছুকে এত গুরুত্ব দিচ্ছ কেন? যদি সবাই আরও বেশি ইতিবাচক আর সমন্বয়পূর্ণ হতো তাহলে এই জগৎটা কত চমৎকার হতো!

এই সভ্যতার জঙ্গলে, আধুনিক জীবনযাত্রার চাপের মধ্যেই আমাদের পরীক্ষা। তুমি যা কিছু দেবে, তা তোমার কাছেই ফিরে আসবে। ঘৃণা কর, আর বিনিময়ে তুমি ঘৃণা পাবে। যখন তুমি নিজেকে অসঙ্গতিপূর্ণ চিন্তাভাবনা এবং আবেগ দিয়ে ভরে রাখো, তখন তুমি নিজেরই সর্বনাশ কর। কেনই বা কাউকে ঘৃণা করবে বা কারোর ওপর রাগ করবে? শত্রুদের ভালোবাসা দাও। রাগের আগুনে কেন সেদ্ধ হবে? যদি তোমার রাগ হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তা ঝেড়ে ফেলো। একটু হেঁটে এসো, দশ বা পনেরো পর্যন্ত গোনো, অথবা মনে আনন্দ আনে এমন কিছুতে মন দাও। প্রতিশোধের ইচ্ছা পরিত্যাগ করো। যখন তুমি রেগে যাও, তখন তোমার মাথা বেশি গরম হয়ে যায়, তোমার হৃদপিণ্ডের ভালভের সমস্যা হয়, তোমার পুরো শরীর অচল হয়ে পড়ে। শান্তি ও সদাশয়তা বিকিরণ কর; কারণ এটাই তোমার ভেতরে ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবির স্বরূপ — তোমার প্রকৃত স্বরূপ। তাহলে কেউ তোমাকে বিরক্ত করতে পারবে না।

যখন তুমি একটি ভালো অভ্যাস তৈরি করতে চাও অথবা একটি খারাপ অভ্যাস দূর করতে চাও, তখন মস্তিষ্কের কোশগুলিতে মনোনিবেশ করো, যা অভ্যাসের প্রক্রিয়ার ভাণ্ডার। একটি ভালো অভ্যাস তৈরি করতে গেলে, ধ্যান করো; এবং তারপর দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী কূটস্থে – ইচ্ছাশক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে – মনোযোগ স্থির রেখে, তুমি যে ভালো অভ্যাসটি সৃষ্টি করতে চাও সেটি গভীরভাবে ব্যক্ত করো। আর যখন তুমি খারাপ অভ্যাস দূর করতে চাও, তখন কূটস্থে মনোনিবেশ করো এবং গভীরভাবে ব্যক্ত করো যে খারাপ অভ্যাসের সমস্ত খাঁজ মুছে যাচ্ছে।

এই পদ্ধতিটির কার্যকারিতা সম্বন্ধে আমি তোমাদের একটি সত্য কাহিনী বলব। ভারতে একবার এক বদমেজাজি লোক আমার কাছে এসেছিল। রেগে গেলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চড় মারার ব্যাপারে সে সিদ্ধহস্ত ছিল, তাই একের পর এক চাকরিও হারাত। সে এতটাই রেগে যেত যে যেই তাকে বিরক্ত করত, তার ওপর হাতের কাছে যা কিছু পেত, তাই ছুঁড়ে মারত। সে আমার কাছে সাহায্য চাইলে আমি তাকে বলেছিলাম, “পরের বার যখন তুমি রেগে যাবে, তখন কিছু করার আগে একশ পর্যন্ত গুনবে।” এটি চেষ্টা করার পর সে আমার কাছে ফিরে এসে বলল, “আমি যখন এটা করি তখন আরও বেশি রেগে যাই। গুনতে গিয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে আমি রাগে অন্ধ হয়ে যাই।” মনে হচ্ছিল তার আর কোনো আশা নেই।

তখন আমি তাকে ক্রিয়াযোগ অভ্যাস করতে বললাম, সাথে এও বললাম: “ক্রিয়া অভ্যাসের পর, ভাবো যে দিব্য জ্যোতি তোমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে, সমস্ত রাগ মুছে দিয়ে তাকে স্নিগ্ধ করছে, তোমার স্নায়ুকে শান্ত করছে, আর তোমার আবেগকে শান্ত করছে। দেখবে একদিন তোমার রাগের জ্বালা দূর হয়ে যাবে।” কিছুদিন পরেই, সে আবার আমার কাছে এল, এবং এবার বলল, “আমার রাগের অভ্যাস একেবারে চলে গেছে। আমি খুবই কৃতজ্ঞ।”

“আজ আমি তাদের সকলকে ক্ষমা করছি যারা কখনও আমাকে অসন্তুষ্ট করেছে। আমি সকল তৃষ্ণার্ত হৃদয়কে আমার ভালোবাসা দিচ্ছি, আমাকে যারা ভালোবাসে তাদের এবং যারা ভালোবাসে না তাদেরও।”

আমি ঠিক করলাম তাকে পরীক্ষা করব। আমি কিছু ছেলেপুলেদের ডেকে তার সাথে ঝগড়া বাঁধাতে বললাম। যে রাস্তা ধরে সে রোজ যায় তার পাশের পার্কে আমি লুকিয়ে থাকলাম যাতে সব দেখতে পাই। ছেলেগুলো তার সঙ্গে ঝগড়া বাঁধাবার বারবার চেষ্টা করল, কিন্তু তার কোনো প্রতিক্রিয়া হল না। সে নিজের শান্তভাব বজায় রাখল।

সংকল্পবাক্য

সংকল্পবাক্যের তত্ত্ব এবং নির্দেশাবলি

“আমাকে আশীর্বাদ করো, আমি যেন আত্মসম্মানের প্রলেপ দিয়ে নিজের মধ্যে রাগের ব্যথা নিরাময় করি এবং দয়ার মলম দিয়ে অন্যদের মধ্যে রাগের ব্যথা নিরাময় করি।”

আরও জানতে হলে

এই শেয়ার করুন