ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত-এ প্রচ্ছন্ন সত্য

ওমর খৈয়াম রচিত রুবাইয়াত-এর ওপর পরমহংস যোগানন্দজির টিকা সংবলিত এই পুস্তক-খণ্ডটিতে কাব্য ও আধ্যত্মিকতার বিষয়ে তিনজন মহান এবং সুবিখ্যাত মানুষের অন্তর্দৃষ্টিকে একত্রিত করে দেখানো হয়েছে যাদের মিলিত জীবনকাল নয়শত বছরেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত ছিল। ওমর খৈয়ামের একাদশ শতাব্দীতে রচিত কবিতা এবং উনবিংশ শতাব্দীতে এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড দ্বারা সেগুলির অনুবাদ বহুকাল ধরেই পাঠকদের পরমানন্দিত করে আসছে। তবে কবিতাগুলির প্রকৃত অর্থ সম্বন্ধে নানামত দেখা গেছে। এই প্রাচীন সাহিত্যটির প্রহেলিকাময় রূপকের অন্তরালে অতীন্দ্রিয়বাদের যে বৈশিষ্ট্য প্রচ্ছন্ন ছিল, পরমহংসজি তাকে উন্মোচন করেছেন।

প্রতিটি মানুষের মধ্যেই দেবত্ব যে সহজাত এবং তা প্রচ্ছন্ন রয়েছে, প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মানুষের মধ্যে এই ধারণাকে জাগিয়ে তোলার জন্য, পরমহংসজি দ্বারা রুবাইয়াতের ব্যাখ্যা করা তাঁর জীবনব্যাপী প্রয়াসের একটা অংশ ছিল। বিভিন্ন ধর্মের মতবাদ এবং অভ্যস্ত কাজকর্মের পিছনে যে একই সত্য, একই জ্ঞানাতীত বাস্তবিকতা রয়েছে, সকল আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের প্রবুদ্ধ ঋষিদের মতো যোগানন্দজিও তা উপলব্ধি করেছিলেন। এই বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং দৃষ্টিশক্তির প্রসারতা থাকার কারণে যোগানন্দজি ভারতের প্রাচীন যোগ-বিজ্ঞানের শিক্ষা এবং ইসলামধর্মীয় জগতের একজন মহোত্তম অতীন্দ্রিয়বাদী কবি, যাঁকে সর্বাধিক ভুল বোঝা হয়েছে, সেই ওমর খৈযামের লেখার মধ্যে নিগূঢ় সম্পর্ক স্পষ্ট করে দেখাতে পেরেছিলেন।

Wine of Mystic book cover.

এই বইটিতে পরমহংসজির মন্তব্য তো বটেই, কিন্তু তা ছাড়াও সম্যক জীবনযাত্রা প্রণালীর ওপর পরমহংসজির আধ্যাত্মিক শিক্ষাও সমন্বিত রয়েছে। ওমর খৈয়ামের কল্পনাপ্রসূত শব্দালঙ্কারগুলির বাহ্য আবরণের পিছনে লুকানো, মানবজীবনের সহজাত আনন্দ এবং তার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যে নিগূঢ় এবং অতি সুন্দর উপলব্ধি বর্তমান, পরমহংস যোগানন্দ তা উদ্ঘাটন করে দেখিয়েছেন।

“ওমর খৈয়ামের রচনার রহস্যোদ্ঘাটন”
পরমহংস যোগানন্দ রচিত “দ্য ওয়াইন অফ দ্য মিস্টিক”-এর ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত:

“বহুকাল আগে, ভারতবর্ষে, আমি পারস্যদেশীয় এক প্রাচীন কবির পরিচয়লাভ করেছিলাম, যিনি আমাকে বলেছিলেন যে পারস্যদেশের কবিতায় প্রায়ই দুটি অর্থ থাকে, এক বাহ্যিক, আর এক অন্তর্নিহিত। পারস্যদেশের একাধিক কবিতার দুই ধরণের মর্মার্থ থাকে, এটা তাঁর ব্যাখ্যা থেকে জেনে, আমি যে প্রচুর পরিমাণ পরিতৃপ্তি পেয়েছিলাম, তা আমার মনে পড়ে।

“একদিন যখন আমি ওমর খৈয়াম রচিত রুবাইয়াতের পাতাগুলির ওপরে গভীরভাবে একাগ্র ছিলাম, হঠাৎ আমি দেখলাম তার বাহ্যিক অর্থের প্রতিবন্ধকগুলি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল, এবং অন্তর্বর্তী হিরণ্ময় আধ্যাত্মিক সম্পদের বিশাল সংরক্ষিত ধনাগার আমার স্থির দৃষ্টির সামনে উন্মোচিত হয়ে গেল।

“সেই সময় থেকে, আমি রুবাইয়াতে বর্ণিত পূর্বে অদৃশ্য আন্তর জ্ঞানের দুর্গের সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছি। আমি বুঝেছি যে, যাদের বিরুদ্ধে অজ্ঞানতার শত্রুসৈন্য হানা দিয়েছে, সত্যের এই স্বপ্নিল-প্রাসাদ সেই সব আশ্রয়-প্রত্যাশী জীবাত্মাদের আশ্রয়স্থল; অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন যে কোনো মানুষই তা দেখতে পারে…।

“রুবাইয়াত-এর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার কাজ যখন আমি করছিলাম, এটি আমাকে সত্যের এক অন্তহীন গোলকধাঁধায় নিয়ে গেল, যতক্ষণ না আমি বিস্ময়ে আনন্দে বিভোর হয়ে হারিয়ে গেলাম।” খৈয়ামের কবিতায় অধিবিদ্যামূলক এবং ব্যবহারিক দর্শনকে আবরিত করে রাখা, আমাকে ‘ধর্মোপদেষ্টা সেণ্ট জনের উদ্ঘাটিত রহস্যসমূহ’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। রুবাইয়াতকে ‘ওমর খৈয়ামের উদ্ঘাটিত রহস্যসমূহ’ বললে কিছু ভুল হবে না।

পরমহংস যোগানন্দ রচিত ওয়াইন অফ দ্য মিস্টিক থেকে কিছু উদ্ধৃতি

ধ্যান এবং ঈশ্বর-আলাপনের বিষয়ে…

এখানে, এই তরুশাখার তলে
কিছু রুটি, এক মদিরা পাত্র, কবিতার একটি বই আর তুমি,
আমার পাশে; এই বিজন প্রান্তরে বসে গাইছি তুমি আর আমি;
আর কি চাই, এই প্রান্তর এখন অমরধাম।

গভীর ধ্যানের নীরবতায় মগ্ন হয়ে, মন আমার মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডগত জীবনবৃক্ষ এবং আধ্যাত্মিক চেতনায় সমাহিত, আমি প্রশান্তির তরুছায়ায় বসে বিশ্রামরত। প্রাণরূপী খাদ্যের (প্রাণশক্তির) জীবনদায়ী প্রভাবে আমি পুষ্ট, আমার অন্তরাত্মার ভৃঙ্গার পরিপক্ব মদিরায় পরিপূর্ণ, যা স্বর্গীয় মৌতাত আনে, আর আমি তাতে দীর্ঘ চুমুক লাগাই। আমার হৃদয় দিব্য প্রেমের অনন্ত প্রেরণাদায়ী বাণী অবিরত আবৃত্তি করে চলেছে। সুগভীর অন্তরাত্মার এই স্তব্ধতা, যে বিজন প্রান্তর থেকে বাসনার জটলা এবং আলোড়ন মিলিয়ে গেছে, সেখানে আমি তোমার সাথে প্রেমালাপ করি, ওগো প্রিয়তম; তুমি আমার কাব্যরচনার দিব্য আশীর্বাদ। সকল বাসনাকে তৃপ্ত করে এমন সুশ্রাব্য প্রজ্ঞার কথা মিষ্টি, সুরেলা স্বরে আমাকে শোনাও। ওগো বিজন প্রান্তর, তুমি বস্তুকেন্দ্রিক বাসনা এবং আবেগের কলরব থেকে মুক্ত, এই একাকিত্বের মধ্যে আমি কিন্তু নিঃসঙ্গ নই। আমার অন্তরের নীরবতা ও নির্জনতার মধ্যে আমি অসীম আনন্দময় স্বর্গরাজ্য খুঁজে পেয়েছি।

অন্তরের প্রশান্তি এবং পরিতৃপ্তির বিষয়ে…

 A man behind woman (depicting worldly desires).

যে বিষয়বাসনার আকাঙ্খা মানুষ করে থাকে
সে সব হয়ে যায় ভস্ম – অথবা তা শ্রীবৃদ্ধিলাভ করায়, আর অবিলম্বে,
মরুভূমির ধুলিধূসর বুকে যখন তুষারপাত হয়,
দু এক ঘণ্টা তা ঝকমক করে, আর তারপরই হয় উধাও।

সব কিছু নিখুঁত হওয়া এবং দীর্ঘস্থায়ী পরিতৃপ্তি শুধুমাত্র মূর্খেরাই এই জগতের কাছে আশা করে; আর আশাভঙ্গ অবস্থাতেই সে মৃত্যুর দুয়ারে গিয়ে পৌঁছোয়। এই জগতের ভ্রান্তিময় চরিত্র জানেন বলেই জ্ঞানী মানুষেরা এই দুনিয়ার কাছে কিছু প্রত্যাশা করেন না। পার্থিব বাসনার দ্বারা বিচলিত না হয়ে তাঁরা চিরস্থায়ী সত্যের খোঁজ করেন,এবং অনন্ত পরিতৃপ্তির বিশাল জগতে স্থানলাভ করেন।

আহা, আমার প্রিয়তম, সেই পানপাত্র পূর্ণ করো যা পরিষ্কার করে
আজকের দিনটিকে অতীতের অনুশোচনা এবং ভবিষ্যতের ভয় থেকে—
আগামীকাল? —কেন, আগামীকাল আমি হয়তো
গতকালের সাত হাজার বছরের সাথে একাকার হয়ে যাব।

হে আমার অন্তরাত্মা, তুরীয়ানন্দের ভৃঙ্গার থেকে প্রবহমান যে পরমানন্দের অমৃত, তাই দিয়ে আমার চেতনাকে ভরে দাও। অতীতের ভুলভ্রান্তির দুর্দমনীয় স্মৃতি এবং ভবিষ্যতে অপরাধ করে ফেলার আশঙ্কা আর ফলস্বরূপ যে অশুভ পরিণতি, দিব্য আলাপন ছাড়া আর কোনো কিছুই তা দূর করতে পারে না।

মানব জীবনের দায়িত্ব পূরণের জন্য যে সব কাজ, তা সুসমঞ্জস বা কঠোরতাপূর্ণ যাই হোক না কেন, তার কষ্ট উপশমের জন্য চিরস্থায়ী পটভূমি হতে পারে ধ্যানলব্ধ স্থায়ী আন্তরিক শান্তি। একদলা বালি সমুদ্রের ঢেউয়ের ক্ষয়কর প্রভাব সইতে পারে না। যে মানুষের অবিচলিত আন্তরিক শান্তির অভাব আছে, মানসিক দ্বন্দ্ব উপস্থিত হলে সে স্থির থাকতে পারে না। কিন্তু, যেমন এক হিরকখণ্ডের চারপাশে যতগুলি ঢেউয়ের ঘূর্ণিই থাকুক না কেন, তার কোনো পরিবর্তন হয় না, তেমনি প্রশান্তির দ্বারা কেলাসিত একজন মানুষ, চারপাশ থেকে যতই দ্বন্দ্ব তাঁকে ঘিরে ধরুক না কেন, তিনি আনন্দোদ্ভাসিত এবং প্রশান্ত থাকেন। আসুন, নিত্য পরিবর্তনশীল জীবনের এই জলপ্রবাহ থেকে সবাই মিলে ধ্যানের দ্বারা অপরিবর্তনীয় আত্ম-চেতনার হিরকখণ্ড, যা চিরস্থায়ী ব্রহ্মানন্দে ঝকমক করে, তা উদ্ধার করি।

আধ্যাত্মিক অন্বেষণের বিষয়ে…

সেগুলি দিয়ে, আমি প্রজ্ঞার বীজ বপন করেছি,
নিজহাতে কৃচ্ছ্রসাধন করেছি তাকে বড়ো করে তুলতে:
আর এই সব ফসল আমি উপার্জন করেছি—
“জলের মতো বয়ে এসে, আমি হাওয়ার মতো উড়ে যাই।”

একজন ব্রহ্মজ্ঞানী গুরু বা একজন আত্মজ্ঞানী আচার্যই প্রজ্ঞার বীজ দিতে পারেন; কিন্তু সেই বীজের জন্য উপযুক্ত জমি ও সেই বীজকে গ্রহণ করার ক্ষমতা ভক্তকেই যোগাতে হবে এবং সেই বীজকে চাষও করতে হবে তাকেই। আত্মনিয়ন্ত্রণের অর্থ নিজেকে যন্ত্রণা দেওয়া নয়; এ হল মনের অবাধ্য গতিকে একাগ্র এবং সংগঠিত করে জীবনযাত্রার সেই সব অভ্যাসের সাথে যুক্ত করা, যা আমাদের প্রকৃত আনন্দ দিতে পারে। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের নিয়ম পালন করে আমরা নিজেদের অস্থিরতা, বদভ্যাস, এবং দুঃখ-দুর্দশা টেনে আনে এমন সব বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত সুখী হতে পারি। যখন আমরা দুর্বল ও অস্থির থাকি এবং আমাদের মানসিকতা দৃঢ়-প্রতিষ্ঠিত থাকে না, তখন আমরা জলের মতো পৃথিবীর অভিমুখী থাকি; কিন্তু যখন আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং গভীর ধ্যানের দ্বারা আমরা চিন্তায় বা অনুভূতিতে উচ্চ স্তরের সংস্কৃতিসম্পন্ন হয়ে পড়ি, তখন আমরা হাওয়ার মতো ঊর্ধ্বগামী হয়ে আমাদের অন্তরাত্মার যে স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, সেই সর্বত্র বিদ্যমানতার স্থিতিতে পৌঁছে যাই।

Woman flying like wind in the omnipresence of her true soul nature.

কর্মফলকে অতিক্রম করার বিষয়ে…

Humans on checkerboard represent limitations behind the prison walls of past, present, and future.

এ যেন এক দাবার ফলক রাত্রি আর দিনের,
যেখানে নিয়তি খেলে মানুষ নিয়ে ঘুঁটির মতো:
এদিক-ওদিক চালে, কিস্তিমাত করে, হনন করে,
আর একে একে সকলকে সিন্দুকে রেখে দেয়।

দাবার বোর্ডে যেমন পালা-অনুসারে সাদা আর কালো চৌখুপি থাকে, যেখানে রাজা এবং তার অধীনস্থ ঘুঁটিদের চালনা করা হয়, সেই রকম, ঘূর্ণায়মান এই পৃথিবী, তার পালা করে আসা দিন এবং রাত নিয়ে ঠিক যেন এক দাবার বোর্ড; যেখানে দাবার ঘুঁটি হল মানুষ আর তার জীবন নিয়ে খেলা হয়। সারা জীবন মানুষকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়, এবং অনেক সময় তাদের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করা হয়; তারা আর নিজেদের পরিকল্পনা মতো কাজ করতে পারে না। অবশেষে মৃত্যু নামক এক সংক্রমণের দ্বারা তাদের জীবনকালকে সংক্ষিপ্ত করে দেওয়া হয়।

অদৃষ্ট যখন সুকৌশলে উন্নতি করিয়ে বা অচল অবস্থা সৃষ্টি করে আর নয়তো পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে, জীবনের রঙ্গভূমিতে পরিবর্তন আনে, তখন মনে রাখতে হবে যে এই ঘটনাগুলি যে সব কারণে হয়েছে, সেগুলি আপনারা নিজেরাই অতীত-জীবনে সৃষ্টি করেছেন। নিয়তিকে কখনো দোষারোপ করতে নেই বা অদৃষ্ট আপনার সৌভাগ্যের সৃষ্টিকর্তা ভেবে তাকে ধন্যবাদ জানাতে নেই; আপনার জীবনে ঘটনার যে পরিবর্তন হয়েছে, তা আপনার নিজের হাতে তৈরি বলে জানবেন। আপনার নিজ হাতে তৈরি ভাগ্য নিয়ে যদি আপনি খুশি না থাকেন, তাহলে মনে রাখবেন যে ঈশ্বর আপনাকে নিজের ইচ্ছামতো ভাগ্য পরিবর্তন করার ক্ষমতা দিয়েছেন। সঠিক কাজে দীর্ঘস্থায়ী কঠোর প্রচেষ্টা সময় মতো সুফল আনে; তবে তার ওপরেও, আপনি যদি গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে নিজের ইচ্ছাশক্তিকে ঈশ্বরের প্রজ্ঞার সাথে যুক্ত করেন, তাহলে, মুক্তি কাকে বলে তা আপনি অবিলম্বে জানতে পারবেন।

সময় এবং অদৃষ্ট, যারা একের পর এক আমাদের জীবনের প্রাণপ্রাচুর্যকে প্রচণ্ড চাপে চূর্ণ করে, আমাদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে না দিয়ে, ঈশ্বরকে তাঁর স্বর্গীয় স্পর্শে আমাদের অমরত্ব প্রদান করতে দেওয়া হোক না কেন? তাহলে আমাদের আর বুকে হেঁটে পরলোকের কোলে গিয়ে সাময়িক নিবৃত্তি খুঁজতে হয় না। ঈশ্বরের সাথে থাকলে আমরা নিজেরাই হয়ে উঠব অনন্ত-জীবন; তাহলে অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতের কারাগারে বদ্ধ হয়ে সীমাবদ্ধতার দাসত্ব আমাদের কোনোদিনই আর করতে হবে না।

মায়ার নাটকের অর্থের বিষয়ে…

Man sees the end of the Cosmic Drama directed by God.

আহা, প্রেম! যদি তুমি এবং আমি নিয়তির সাথে মিলিত হয়ে
এই দুঃখময় বিশ্বের সমগ্র পরিকল্পনাকে আয়ত্ত করতে পারতাম,
তাহলে কি আমরা তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতাম না—এবং তারপর
হৃদয়ের কামনার আরও নিকটবর্তী করে তাকে নতুন রূপে গড়ে তুলতাম!

এইভাবে কখনো কখনো প্রতিটি মানুষই কামনা করে যে জগৎস্রষ্টার ভূমিকাটা সে নিয়ে এই জগৎটাকে নিজের মনের মতো করে গড়ে তুলতে পারবে। অবিমিশ্র আনন্দের জন্য এই যে আকাঙ্খা, সেটা অন্তরাত্মার মর্মস্থল থেকে নির্গত হয়; আত্মার মধ্যেই গুপ্ত আছে সেই দিব্য সহজাত পূর্ণাঙ্গ রূপ এবং তার প্রকৃত অস্তিত্বের চিরস্থায়ী পরমানন্দ।

এই জগৎ হল এক দিব্য প্রহেলিকা, শুভের সাথে অশুভ মেশানো, দুঃখের সাথে আনন্দ, জীবনের সাথে মৃত্যু…। আমরা যদি বিশ্বজগতে এই শুভ এবং অশুভ, সুখ এবং দুঃখ, ধনী এবং নির্ধন, স্বাস্থ্য এবং ব্যাধি, বোধশক্তি এবং মূঢ়তা, শান্তি এবং যুদ্ধ, দয়া এবং নৃশংসতা, এগুলির আপাতদৃষ্টিতে সত্যবিরোধী নাটকের অর্থ বুঝতে না পারি, তাহলে আমাদের মাত্রাধিক মাথা ঘামানোও উচিত নয় আবার এই সৃষ্টির পিছনে ঈশ্বরের যে পরিকল্পনা, তাতে অবিশ্বাসী হওয়াও উচিত নয়। একটা সফল নাটকে থাকে অনিশ্চয়তা, যা পাঠকের কৌতূহলকে ধরে রাখে, পাঠককে হতবুদ্ধি করে বা বিহ্বল করে, আর তা শেষ হয় পরিতৃপ্তিকর, সাড়ম্বর নাটকীয়তায়। সেইরকম, সময় হলেই‌, ঈশ্বর অপ্রত্যাশিত ভাবে প্রতিটি ঊর্ধ্বগামী জীবাত্মার চোখের সামনে থেকে আবরণ সরিয়ে দেন, এবং মহাজাগতিক নাটকের অন্তিম ভাগ তাঁর সামনে উন্মোচিত করেন; এই নাটক বহুকাল ধরে যে সব বিয়োগান্তক এবং মিলনাত্মক দৃশ্য দেখিয়ে আসছিল, তার বিস্ময়কর, মহান সমাপ্তি তিনি দেখিয়ে দেন।

ঈশ্বরের প্রেমের বিষয়ে…

একজন বললেন—“লোকেরা এক রূঢ় সুরাবিক্রেতার কথা বলে,
এবং তাঁর মুখমণ্ডল নরকের ধোঁয়ায় কলঙ্কিত করে;
তারা আমাদের কঠোর পরীক্ষার কথা বলে—ছি!
তিনি একজন সদয় সত্তা, এবং সবকিছুই মঙ্গলজনক হবে।”

অনেকে তাদের স্রষ্টাকে বর্ণনা করে এমন করে যে তিনি যেন এমন একজন যিনি স্বেচ্ছাচারীর মতো অর্থহীনভাবে মানুষের অজ্ঞতার পরীক্ষা নেন এবং কঠিন শাস্তির ভয় দেখান এবং তিনি মানুষের কাজকর্মকে হৃদয়হীনভাবে পরীক্ষা করে তাদের বিচার করেন। এইভাবে তারা ঈশ্বর সম্বন্ধে যে প্রকৃত ধারণা, যে তিনি একজন স্নেহশীল, করুণাময় দিব্য পিতা, তা বিকৃত করে, মিথ্যা করে তাঁকে একজন কঠোর নিয়মানুবর্তী, ক্ষমাহীন, প্রতিহিংসাপরায়ণ, অত্যাচারী রূপে দেখায়। কিন্তু ভক্তেরা, যারা তাঁর সাথে কথোপকথন করে, তারা জানে যে ঈশ্বরকে করুণাময় এবং অসীম প্রেম ও সদগুণের অধিকারী ছাড়া আর কিছু ভাবাই মূর্খতা। যেহেতু এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পিতা, ঈশ্বর হলেন মঙ্গলময়, তাঁর সন্তানদের সাথে অন্তিমে সব কিছুই ভালো হবে; তারা এবং সমগ্র সৃষ্টি এক উজ্জ্বল পরিণতির দিকে এবং তাঁর সাথে পুনর্মিলনের দিকে এগিয়ে চলেছে।

পরমহংস যোগানন্দের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা সমেত ওয়াইন অফ দ্য মিস্টিক: দ্য রুবাইয়াত অফ ওমর খৈয়াম বইটিও পড়বেন

এই শেয়ার করুন