১৯৪৪-এর ২১শে মে, এসআরএফ হলিউড মন্দিরে প্রদত্ত “যোগ ও তার বিশ্বজনীনতা” শীর্ষক একটি ভাষণের উদ্ধৃতাংশ। সম্পূর্ণ ভাষণটি ওয়াইএসএস দ্বারা প্রকাশিত পরমহংসজির ভাষণ ও রচনা সংকলন-এর প্রথম খণ্ড, মানুষের চিরন্তন অন্বেষণ-এ পাওয়া যাবে।
দ্রষ্টব্য: পরমহংস যোগানন্দজির পাঠমালা বা অন্যান্য রচনায় পুংলিঙ্গের ব্যবহার ‘নর’ শব্দের মতো সীমিত এবং স্বতন্ত্র অর্থে করা হয়নি, যা মানব জাতির শুধুমাত্র অর্ধাংশকে চিহ্নিত করে, বরং তার সহজাত এবং বৃহত্তর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; সংস্কৃতে একমাত্র মানুষের যুক্তিসমৃদ্ধ বিচারের ক্ষমতাকে প্রকাশ করার জন্য ‘মানস’ বা ‘মন’ যে শব্দমূল থেকে উৎপন্ন হয়েছে, উপরোক্ত শব্দের উৎপত্তি সেই একই শব্দমূল থেকে হয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত যোগ প্রধানত উভয়লিঙ্গ-সম্পন্ন আত্মার দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের চেতনার ওপরে কাজ করে। অত্যধিক সাহিত্যিক জটিলতার মধ্যে না গিয়ে এই মনোবিদ্যাগত এবং আধ্যাত্মিক সত্যকে প্রকাশ করার মতো পারিভাষিক শব্দাবলি ইংরেজিতে না থাকার দরুন মানব বা মানুষ এবং এই জাতীয় শব্দ গুরুদেবের রচনায় বজায় রাখা হয়েছে।
- যোগের উদ্দেশ্য
- যোগ: প্রকৃত ধর্মের বিজ্ঞান
- অন্ধ কখনো অন্ধকে পথ দেখাতে পারে না
- যোগ ধর্মতত্ত্বকে কার্যকরী অভিজ্ঞতায় পরিণত করে
- যোগ বিশ্বজনীন
- আত্মাকে অবশ্যই ঈশ্বরের কাছে পুনরায় ঊর্ধ্বগমন করতে হবে
- আনন্দের গোপন কথা – ঈশ্বর সান্নিধ্যের চেতনা
- ধ্যান যোগীতে পরিণত করে
যোগের উদ্দেশ্য
জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিকেই যোগ বলা হয়। আমরা ঈশ্বরের কাছ থেকে অধঃপতিত হয়েছি, ঊর্ধ্বারোহণ করে আমাদের তাঁর কাছে ফিরে যেতেই হবে। আপাতদৃষ্টিতে বোধ হয় আমরা আমাদের পরমপিতার সঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, তাই সজ্ঞানে আমাদের তাঁর সাথে পুনর্মিলিত হতেই হবে। যোগ আমাদের শেখায় কীভাবে বিচ্ছিন্নতার ভ্রান্তিকে ত্যাগ করে আমরা ঈশ্বরের সাথে আমাদের অবিচ্ছিন্নতাকে উপলব্ধি করতে পারি।
মহাকবি মিল্টন বর্ণনা করেছেন কীভাবে মানবাত্মা পুনরায় স্বর্গরাজ্য লাভ করতে পারে। যোগের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সেই একই — অর্থাৎ হারিয়ে যাওয়া আত্মিক চেতনার স্বর্গরাজ্যকে পুনরুদ্ধার করা, যাতে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে যে, চিরকাল সে যেমন ছিল তেমন আজও সে পরমাত্মারই অবিভাজ্য অঙ্গ।
যোগ: প্রকৃত ধর্মের বিজ্ঞান
পৃ্থিবীর ভিন্ন ভিন্ন ধর্মমত মোটামুটিভাবে মানুষের বিশ্বাসকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু প্রকৃত ধর্মের ভিত্তি হওয়া উচিত এমন এক বিজ্ঞান, যার সাধনার মাধ্যমে যে কোনো ভক্ত আমাদের এক ও অদ্বিতীয় পরমপিতার সঙ্গ লাভ করতে পারে। যোগই হল সেই বিজ্ঞান। বিজ্ঞানসম্মত ধর্মচর্চা করা তাই একান্ত প্রয়োজনীয়।
বিভিন্ন অন্ধবিশ্বাসমূলক ধর্মীয় মতবাদ মানব জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে; জিশুখ্রিস্ট বলতেন, “যে পরিবারে নিজেদের মধ্যে ভাঙন ধরে, সে পরিবার কখনো টিকে থাকতে পারে না” (মার্ক ৩:২৫)। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মধ্যে ঐক্য কেবল তখনই গড়ে উঠতে পারে যখন ওই সব ধর্মীয় মতের অনুসরণকারীরা নিজ নিজ অন্তরে ঈশ্বরের উপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন হয়। আর তাহলে পিতা পরমেশ্বরের অধীনে প্রকৃত মানব ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠা সম্ভবপর হবে।
বিশ্বের সব মহান ধর্মই ঈশ্বরের সন্ধান করা, মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের জাগরণ, ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তার কথা প্রচার করে থাকে; এবং‘দশ মহানির্দেশ’ (Ten Commandments) -এর মতো তাদের সকলের একটা নীতিনির্দেশিকা আছে। তবুও ধর্মে ধর্মে এত বিভেদ সৃষ্টি হয় কী কারণে? এর কারণ হল মানব মনের গোঁড়ামি বা রক্ষণশীলতা। প্রকৃত আত্মজ্ঞানের মাধ্যমেই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছোন যায়, ধর্মীয় গোঁড়ামিতে লিপ্ত থেকে নয়।
বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যে বিশ্বজনীন সত্য আছে, মানুষ যেদিন সেটা উপলব্ধি করতে শিখবে, সেদিন ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে আর কোনো জটিলতা থাকবে না। আমার কাছে ইহুদী, খ্রিস্টান, হিন্দু বলে আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই, তারা সবাই আমার ভাই। সব মন্দিরেই আমি পূজা করি, কেননা ওই সব মন্দির গড়ে উঠেছে আমার পরমপিতার সম্মানে।
যে আদর্শকে ভিত্তি করে সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ [যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া] “সকল ধর্মের উপাসনা মন্দির” (Church of All Religions) প্রতিষ্ঠা করেছে, তারই ওপর ভিত্তি করে বিশ্ব-ঐক্য গড়ে তোলার জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। এর মধ্যে মানসিক ঔদার্যের কোনো প্রশ্ন নেই, এ হল নানা পথে ঈশ্বর সন্ধানে রত সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। সকল ধর্মের আরাধ্য, সেই একমেবাদ্বিতীয়ম ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গ করা এইরূপ মন্দির, সর্বত্র স্থাপন করতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তা একদিন অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।
ঈশ্বরের রাজ্যের এই সঙ্কীর্ণ বিভাজনকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশগুলি অবশ্যই চিরদিনের মতো অবলুপ্ত করবে। যোগসাধনার মাধ্যমে আত্মোপলব্ধি করে মানুষ জানবে যে তারা সবাই একই পরমপিতার সন্তান।
অন্ধ কখনো অন্ধকে পথ দেখাতে পারে না
যাঁদের ঈশ্বরানুভূতি হয়েছে এমন মহাপুরুষদের মধ্যে আত্মিক ঐক্য প্রকটিত হয়ে থাকে। অন্ধ কখনো অন্ধের পথ প্রদর্শক হতে পারে না; একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞানী গুরুই পারেন অন্যকে ঈশ্বরতত্ত্ব শেখাতে। নিজের ঈশিত্ব ফিরে পাবার জন্য সাধকের ঐরূপ একজন গুরুর প্রয়োজন হয়।
যে সাধক বিশ্বস্ততার সঙ্গে সদগুরুকে অনুসরণ করে, সে ওই সদগুরুর সমকক্ষ হয়ে ওঠে; কেননা গুরু সর্বদা শিষ্যকে নিজের উপলব্ধির পর্যায়ে উত্তরণের জন্য সাহায্য করে থাকেন। আমি যখন মদীয় গুরুদেব স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বরজির দর্শনলাভ করি, তখনই আমি মনস্থির করেছিলাম যে আমি তাঁরই আদর্শ অনুসরণ করব: আর সেই আদর্শ হল নিজের হৃদমন্দিরে শুধুমাত্র ঈশ্বরকে অধিষ্ঠিত করা এবং ঈশ্বরীয় ভাবনা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়া।
হিন্দু গুরুমহারাজেরা আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছেন যে, পরমতত্ত্ব জানতে হলে সাধককে সর্বদর্শী অধ্যাত্ম চক্ষুতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। গভীরভাবে মনঃসংযোগ করার সময়, এমনকি যাঁরা যোগী নন তাঁদেরও ভ্রুদ্বয়ের মধ্যবর্তী কপালের অংশটিতে ভাঁজ পড়ে থাকে — এইটিই হল গোলাকৃতি অধ্যাত্মনেত্র ও একাগ্রতার কেন্দ্রবিন্দু, আত্মিক স্বজ্ঞার পীঠ। এই হল আসল স্ফটিক-খণ্ড (crystal ball), যেখানে ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য জানার জন্য যোগীপুরুষ দৃষ্টিকে সংহত করে থাকেন।
গভীর একাগ্রতায় তন্ময় হয়ে সাধক যখন ওই “অধ্যাত্মনেত্র” ভেদ করেন, তখন তাঁর ভগবৎ দর্শনলাভ হয়। ঈশ্বরসন্ধানীর কর্তব্য হল এই শিবনেত্রের মধ্য দিয়ে নিজের দৃষ্টিশক্তিকে প্রসারিত করার ক্ষমতাকে উন্নততর করে উপলব্ধিকে গভীরতর করা। যোগাভ্যাস সাধককে তার স্বতঃলব্ধ জ্ঞানের একক চক্ষুকে উন্মুক্ত করতে সাহায্য করে।
এই স্বতঃলব্ধ বা অপরোক্ষ জ্ঞান ইন্দ্রিয় সংবেদনের ওপর নির্ভরশীল নয়। সেইজন্য স্বজ্ঞা শক্তিকে অনেক সময় “ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়” বলা হয়ে থাকে। এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সকলেরই আছে, তবে বেশিরভাগ মানুষ তার উন্নতিসাধন করে না। অবশ্য প্রায় সব মানুষেরই কিছু না কিছু স্বজ্ঞানুভূতি লাভ হয়ে থাকে, যেমন কোনো একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে, এমন একটা পূর্বানুমান হতে থাকে, যদিও তার জন্য সে কোনো ইন্দ্রিয়জ সংবেদন লাভ করেনি।
এই স্বজ্ঞা বা প্রত্যক্ষ আত্মিক জ্ঞানের উন্নয়ন করা একান্তই আবশ্যক, কারণ ঐশ্বরিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের আত্মবিশ্বাস সুদৃঢ় হয়ে থাকে। সে যে কেবল জানে তাই নয়, নিজের জ্ঞান সম্বন্ধে সে সুনিশ্চিত থাকে। কমলালেবুর স্বাদের ব্যাপারে আমরা যেমন সুনিশ্চিত, ঈশ্বরের উপস্থিতি সম্বন্ধেও আমাদের সেই রকম সুনিশ্চিত হতে হবে। আমার গুরুদেব যখন আমাকে ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের উপায় বলে দিলেন এবং আমি যখন সর্বক্ষণ পরমাত্মার সান্নিধ্য উপলব্ধি করতে থাকলাম, তারপরই আমি সকল মানুষের কাছে তাঁর নামকীর্তনের আধ্যাত্মিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম।
পাশ্চাত্যবাসীগণ বিশাল বিশাল উপাসনা-গৃহ স্থাপনে বিশেষ যত্নবান, অথচ তাদের মধ্যে মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকটি স্থানেই সাধকদের কাছে ঈশ্বরদর্শনলাভের উপায় প্রকাশ করা হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, প্রাচ্যে ব্রহ্মজ্ঞানী মানুষ গড়ে তোলার ওপরেই অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ওইসব ব্রহ্মজ্ঞানীরা অধ্যাত্মসন্ধানীদের কাছে অনভিগম্যই থেকে যান; কেননা প্রত্যন্ত প্রদেশে, একান্তে, নির্জন কুটীরে তাঁরা অবস্থান করে থাকেন।
এমন অধ্যাত্ম কেন্দ্র, যেখানে মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে এবং সেই সঙ্গে অধ্যাত্মমার্গ দেখিয়ে দেবার মতো যোগ্য আচার্যের সহায়তাও পাবে, এই দুয়েরই প্রয়োজন আছে। গুরু যদি নিজে ঈশ্বরকে না জানেন তাহলে আমরা কীভাবে তাঁর থেকে ঈশ্বরতত্ত্ব জানতে পারি? আমার গুরুদেব আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছিলেন যে অন্যকে ঈশ্বরীয় জ্ঞান প্রদানের আগে আমি যেন নিজে পরমেশ্বরকে জানতে ব্রতী হই। তাঁর অধীনে শিক্ষালাভ করেছিলাম বলে আমি নিজেকে কতই না ধন্য মনে করি! সত্যসত্যই তিনি ভগবৎদ্রষ্টা ছিলেন।
ঈশ্বরকে সর্বপ্রথম আপন দেহমন্দিরে উপলব্ধি করতে হবে। সাধককে প্রতিদিন নিজের চিন্তাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে এবং তার ভক্তিমণ্ডিত বনজ কুসুমগুলিকে আত্মবেদীর ওপর স্থাপন করতে হবে।
নিজের হৃৎকন্দরে যে ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করেছে, সে যে কোনো গির্জায় বা মন্দিরে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।
যোগ ধর্মতত্ত্বকে কার্যকরী অভিজ্ঞতায় পরিণত করে
সকল ধর্মে যে সত্য নিহিত, যোগ মানুষকে তা বোঝার মতো উপযুক্ত হতে সহায়তা করে। ভাষা ভিন্ন হলেও সব ধর্মেই ‘দশ মহানির্দেশ’ (Ten Commandments)-এর অনুরূপ নীতি প্রচার করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে এমন দুটি উচ্চকোটির নির্দেশ আছে যার প্রতি স্বয়ং জিশুখ্রিস্ট বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন: “তোমার প্রভু পরমেশ্বরকে সর্বান্তঃকরণে, পরিপূর্ণ অন্তরাত্মা দিয়ে এবং তোমার সমগ্র মন দিয়ে ভালোবাসবে” এবং “তুমি তোমার প্রতিবেশীকে আত্মবৎ ভালোবাসবে” (ম্যাথু ২২:৩৭,৩৯ বাইবেল)।
ঈশ্বরকে “তোমার সমগ্র মন দিয়ে” ভালোবাসার অর্থ হল, ইন্দ্রিয়-চেতনা থেকে মনকে অপসারিত করে ভগবদচরণে তাকে নিবেদন করা; এবং ধ্যানযোগে মনকে পরিপূর্ণ একাগ্রতার সাথে ঈশ্বরের চরণে নিবেদন করা। মনঃসংযোগের শিক্ষালাভ করা প্রত্যেক ভগবৎসন্ধানীর অবশ্য কর্তব্য।
প্রার্থনা করার সময় একই সঙ্গে মনে অন্য বিষয়বস্তুর চিন্তা করাকে কখনোই ঐকান্তিক প্রার্থনা বলা যায় না এবং ঈশ্বর সেই প্রার্থনাকে উপেক্ষা করেন। যোগ এই শিক্ষাই দিয়ে থাকে যে, ঈশ্বরকে পেতে হলে যা একান্তই আবশ্যক, তা হল তাঁকে একমনে, সূচাগ্র তীক্ষ্ণ একাগ্রতার সাথে ডাকতে হবে।
যোগ বিশ্বজনীন
অনেকে বলে থাকেন যে যোগাভ্যাস হিন্দুদের পক্ষেই সম্ভবপর, পাশ্চাত্যবাসীদের জন্য তা উপযোগী নয়। একথা সত্য নয়। বিজ্ঞানের জগতে উন্নতিলাভ করার ফলে পাশ্চাত্যবাসীদের হাতে এখন অনেক বেশি অবসর সময় থাকছে, তাই পাশ্চাত্যবাসীরা বর্তমানে বহু হিন্দু অপেক্ষা যোগাভ্যাসের বেশি করে সুযোগ পাচ্ছে।
জীবনকে আরও অনেক সহজ ও ভারমুক্ত করে তোলার জন্য ভারতবাসীর আরও বেশি করে পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল ভৌত পদ্ধতিগুলির সদ্ব্যবহার করা উচিত; সেই সঙ্গে পাশ্চাত্যবাসীরও কর্তব্য হল ভারতের কাছ থেকে যোগের অধিবিদ্যাগত ব্যবহারিক পদ্ধতি সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করা, যার সাহায্যে মানুষমাত্রেই ভগবৎ সন্ধানের পথটিকে জানতে পারে।
যোগ কোনো ধর্মীয় মতবাদ নয়; যোগ হল এক বিশ্বজনীন প্রয়োগযোগ্য বিজ্ঞান, যার মাধ্যমে আমরা পরমপিতার দর্শনলাভ করতে পারি।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাসী নির্বিশেষে যোগসাধনা সবাই করতে পারে। এমন কথা নিশ্চয় কেউ বলবেন না যে, যেহেতু টেলিফোন ব্যবস্থা পাশ্চাত্যের আবিষ্কার, অতএব প্রাচ্যের লোকেরা তা ব্যবহার করতে পারবে না। সেইভাবে, যোগ সাধনা পদ্ধতি প্রাচ্যের অবদান হলেও তা কেবলমাত্র প্রাচ্যবাসীদের নিজস্ব সম্পত্তি নয়, মনুষ্য সমাজের যে কেউ তার উপযোগিতা ভোগ করতে পারে।
ভারত বা আমেরিকা, যে দেশেই মানুষ জন্মাক না কেন, একদিন তাকে ইহলোক ত্যাগ করতেই হবে। তাহলে সেন্ট পলের মতো ভগবদচিন্তায় মগ্ন হয়ে “দৈনন্দিন মৃত্যুবরণ” করার শিক্ষালাভ কেন করা হবে না? (১ করিন্থিয়ান্স ১৫ : ৩১ বাইবেল) যোগ সেই পদ্ধতি শিখিয়ে থাকে।
মানুষ দেহপিঞ্জরে বন্দীর মতো জীবনযাপন করে; তারপর নির্ধারিত কাল শেষ হলে সেখান থেকে বিতাড়িত হবার অবমাননা তাকে সহ্য করে নিতে হয়। দেহকে ভালোবাসাও যা, কারাগারকে ভালোবাসাও তাই। দীর্ঘকাল দেহাবদ্ধ হয়ে থাকার ফলে স্বাধীনতার মর্ম আমরা ভুলে গিয়েছি। পাশ্চাত্যবাসী বলে স্বাধীনতার সন্ধান করার প্রয়োজন নেই, এমন যুক্তি খাড়া করা অনুচিত। নিজের আত্মাকে জানা, তার অমরত্বকে বোঝা, প্রত্যেক মানুষেরই মহান কর্তব্য। যোগ সেই পথটিকেই চিনিয়ে দেয়।
আত্মাকে অবশ্যই ঈশ্বরের কাছে পুনরায় ঊর্ধ্বগমন করতে হবে
যখন সৃষ্টি ছিল না, তখন মহাজাগতিক চৈতন্য বিরাজ করত: পরম ব্রহ্ম, সদা-বিদ্যমান, সদা-চৈতন্যময়, নিত্য-নবীন আনন্দস্বরূপ এবং অরূপ ও অব্যক্ত। সৃষ্টিকার্যের সূচনা হবার পর মহাজাগতিক চৈতন্য জড় বিশ্বে ‘অবতরণ’ করে খ্রিস্ট চৈতন্য (কূটস্থ চৈতন্য) রূপে প্রকাশিত হলেন: এই কূটস্থ চৈতন্য হল সৃষ্টলোকে অপ্রত্যক্ষ ও সহজাত, সর্বব্যাপী ঐশ্বরিক বোধি ও চৈতন্যের শুদ্ধ প্রতিফলন।
যখন খ্রিস্ট-চৈতন্য মানুষের স্থূল দেহে অবতরণ করে, তখন তা আত্মা বা পরাচেতনায় পরিণত হয়: যা দেহাবরণে আবদ্ধ হয়ে ব্যক্তিসত্ত্বা প্রাপ্ত ঈশ্বরের সেই সদা-বিদ্যমান, সদা-চৈতন্যময়, সদা-নবীন আনন্দ। যখন আত্মা দেহের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়, তখন তা অহংকার রূপে, মর্ত্য চেতনায় প্রকাশ পায়। যোগ শিক্ষা দেয় যে, আত্মাকে অবশ্যই পুনরায় চেতনার সোপান বেয়ে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হতে হবে।
[মন্তব্যঃ যোগ শাস্ত্রে বলা হয় যে জীবাত্মার, অর্থাৎ মানব জীবন ও দিব্য চৈতন্যের পরমধাম হল মস্তিষ্কস্থিত সূক্ষ্ম অধ্যাত্ম কেন্দ্র: “সহস্রার”, এটি এক সহস্র-দলবিশিষ্ট পদ্ম, যার অবস্থান ব্রহ্মতালুতে, এটি মহাজাগতিক চৈতন্যের পীঠ; কূটস্থ হল ভ্রুদ্বয়ের মধ্যবর্তী বিন্দু এবং এটি খ্রিস্ট চৈতন্যের পীঠ; সুষুম্নাশীর্ষক (কূটস্থের সঙ্গে বিপরীত মেরু দ্বারা যুক্ত) হল অতিমানস চেতনার পীঠ। এইসব সর্বোচ্চ অধ্যাত্মদর্শন কেন্দ্রগুলি হতে দেহে (ও দেহ-চৈতন্যে) অবতীর্ণ হয়ে প্রাণ ও চৈতন্য মেরুদণ্ডস্থ পাঁচটি সূক্ষ্ম চক্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে প্রাণ, ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও কর্মের মাধ্যমে বহির্মুখে প্রসারিত হয়ে থাকে।
ঈশ্বরের সঙ্গে নিজের পরমানন্দময় একাত্মতার অনুভূতি পুনরায় ফিরে পেতে হলে মানবাত্মাকে নিজের নিম্নাভিমুখী গতি পরিবর্তন করতে হবে এবং পবিত্র মেরুদণ্ডপথ ধরে দিব্য চেতনার উচ্চতর মস্তিষ্ক কেন্দ্রে, আপন বাসভূমিতে, ব্যুত্থিত হতে হবে। গুরুদত্ত বিজ্ঞানসম্মত যোগীয় ধ্যান প্রক্রিয়া অনুশীলন করলে এতে সিদ্ধিলাভ করা যায়, যোগদা সৎসঙ্গ পাঠমালা থেকে যা শেখা যেতে পারে।]]
আনন্দের গোপন কথা – ঈশ্বর সান্নিধ্যের চেতনা
জীবনকে উপভোগ করার মধ্যে আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে না; তবে সুখানুভূতি লাভ করতে হলে আসক্তি বর্জন করতে হবে। ফুলের গন্ধ উপভোগ করায় আপত্তি নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে তার মধ্যে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করতে হবে।
আমার মধ্যে আমি ইন্দ্রিয়চেতনা বজায় রেখেছি যাতে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমি যেন সর্বদা ঈশ্বরকে দর্শন ও তাঁর কথা মনন করতে পারি। “আমার এই নয়নদ্বয় সর্বত্র তোমার সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করার জন্যই সৃষ্ট হয়েছে। আমার কর্ণদ্বয় নির্মিত হয়েছে তোমার সর্বব্যাপী কন্ঠস্বর শোনার জন্যই।” একেই বলে যোগ, ভগবানের সঙ্গে মিলন।
ঈশ্বরকে পাবার জন্য বনে-জঙ্গলে যাবার দরকার হয় না। যতদিন না আমরা পার্থিব অভ্যাস থেকে নিজেদের মুক্ত করছি, ততদিন যেখানেই যাই না কেন, ওই সব অভ্যাস আমাদের দৃঢ়ভাবে বেঁধে রাখবে। যোগী আপন হৃৎকন্দরে ঈশ্বর দর্শনের প্রযত্ন করে থাকেন। যেখানেই তিনি বিচরণ করুন, সর্বত্র চিদানন্দযুক্ত হয়েই অবস্থান করেন।
মানুষ যে কেবল প্রাণঘাতি ইন্দ্রিয়চেতনায় অধঃপতিত হয়েছে তাই নয়, ঐরূপ চেতনায় যে সব বিকৃতি ঘটে থাকে, যেমন লোভ, ক্রোধ, ঈর্ষা ইত্যাদি, সে তাদেরও বশীভূত হয়ে পড়েছে। ঈশ্বরকে পেতে হলে ঐরূপ বিকৃতি থেকে মানুষকে মুক্ত হতে হবে। প্রাচ্য-প্রতীচ্যবাসী নির্বিশেষে সকলকেই ইন্দ্রিয়পরায়ণতা থেকে মুক্ত হতে হবে।
সকালবেলায় সময়মতো কফি না পেলে সাধারণ মানুষের রাগ হয়, কেন না তাতে তার মাথা ধরে যেতে পারে। সে তার স্বভাবের দাস। একজন উচ্চকোটির যোগী ঐরূপ অভ্যাসের থেকে মুক্ত। যে যেমনই হোক না কেন, সবাই যোগী হতে পারে। কিন্তু যা আমাদের প্রচলিত অভ্যাসের বাইরে, তা করতে যাওয়াকে আমরা সব সময় কঠিন এবং অস্বাভাবিক মনে করে থাকি। আমাদের অভ্যাস নিয়ে অন্যেরা কী ভাবছে, সে ব্যাপারে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই!
যোগ-সাধনা মুক্তির দিশারী। কোনো কোনো যোগী বৈরাগ্যের ব্যাপারটা নিয়ে একটু বাড়াবাড়িই করে থাকেন। কোনো অস্বস্তি বোধ না করে কন্টকশয্যায় শোবার অভ্যাস এবং আরও অন্যান্য ধরণের তপস্যা বা শারীরিক অনুশাসনের শিক্ষা তাঁরা দিয়ে থাকেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে কেউ যদি কণ্টকাসনে বসে ঈশ্বর চিন্তা করতে পারে, তাহলে তার অসাধারণ মনের জোর আছে বলতে হবে। কিন্তু এই সব চমৎকারিত্বের আদৌ কোনো মূল্য নেই। সুন্দর আরামদায়ক চেয়ারে বসে ঈশ্বর চিন্তা করলেও কোনো ক্ষতি হয় না।
পতঞ্জলির মতে যে আসনে বসে মেরুদণ্ড ঋজু করে রাখা যায়, তাই ঈশ্বরের প্রতি নিবিষ্ট যোগীয় ধ্যানের যোগ্য আসন।
“হঠযোগে” বর্ণিত যে সব যোগাসন অভ্যাস করতে হলে শরীরকে নানাভাবে দোমড়াতে হয়, বা যার জন্য অসম্ভব রকমের শারীরিক সহনশীলতা ও নমনীয়তার প্রয়োজন হয়, সেগুলির অনুশীলন করার বিশেষ কোনো দরকার নেই। ঈশ্বরই হলেন আমাদের আরাধ্য; সুতরাং তাঁর উপস্থিতির চৈতন্য লাভ করাই আমাদের অভিপ্রেত কর্ম।
ভগবদগীতায় শ্রীভগবান বলেছেন, “শ্রদ্ধাপূর্বক যে মদগতচিত্তে আমার ভজনা করে, তাকেই আমি যোগীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী বলে মনে করি।” (৬:৪৭)
চরম শৈত্য ও উষ্ণতায় এবং মশকাদি বিভিন্ন কীটপতঙ্গের দংশনে নিরুদ্বিগ্ন থাকার দৃষ্টান্ত হিন্দু যোগীদের মধ্যে প্রায়শই দেখা যায়। দক্ষ ব্যক্তির পক্ষে একে স্বাভাবিক কৃতিত্ব বলে গণ্য করা হলেও, যোগী হবার জন্য এরূপ সিদ্ধাই-শক্তি প্রদর্শন করার কোনো আবশ্যকতা নেই।
বিঘ্ন সৃষ্টিকারী উপাদানগুলিকে দূর করার চেষ্টা করে অথবা অন্তরে বিচলিত না হয়ে, প্রয়োজনে এদের সহ্য করার শিক্ষা নিতে হয়। যেক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন থাকা সম্ভব, সেক্ষেত্রে অহেতুক অপরিচ্ছন্ন থাকার কোনো অর্থ হয় না। রাজপ্রাসাদেই হোক বা কুঁড়ে ঘরেই হোক, যে যেখানে থাকে, সে জায়গার প্রতি তার একটা আসক্তি জন্মায়।
আধ্যাত্মিক সাফল্য লাভের সবচেয়ে বড়ো উপাদান হল সদিচ্ছা। জিশুখ্রিস্ট যথার্থই বলেছেন, “শস্য প্রকৃতই পর্যাপ্ত কিন্তু কর্মী সংখ্যা অতি সামান্য”(ম্যাথু ৯:৩৭)। বিষয়সর্বস্ব মানুষ ঈশ্বরের দানের জন্য লালায়িত হয়, কিন্তু যে প্রজ্ঞাবান সে স্বয়ং দাতাকে পাবার জন্য সচেষ্ট হয়।
যোগী হতে হলে ধ্যানসাধনা অত্যাবশ্যক। যিনি যোগী, তিনি প্রভাতে জাগরণের সঙ্গে সঙ্গেই দেহপোষণের জন্য আহার্যের সন্ধানে ব্যস্ত হন না। তিনি ভগবৎ মিলনের অমৃতসুধায় আত্মিক পুষ্টি লাভ করে থাকেন।
গভীর তপস্যাসিদ্ধ মনের অনুপ্রাণনায় পরিপূর্ণ হয়ে তিনি সানন্দে প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করে থাকেন।
পৃথিবী ঠিক যে রকম, বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই ঈশ্বর তাকে এইভাবে সৃষ্টি করেছেন; সেই পরিকল্পনা অনুসারে ইহজগতকে সুন্দরতর করে তোলার দায়িত্ব মানুষের। নতুন নতুন এবং উন্নত ধরণের জাগতিক সুখসম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে পাশ্চাত্যবাসীগণ সর্বক্ষণ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। অন্যদিকে, যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার বাসনায় প্রাচ্যবাসীরা সব কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন। পাশ্চাত্যের ওই বিপুল কর্মপ্রচেষ্টা এবং প্রাচ্যের শান্ত, সমাহিত ভাব, উভয়েরই একটা আকর্ষণী শক্তি আছে। আমাদের লক্ষ্য হবে এই দুয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্যযুক্ত অবস্থান গ্রহণ করা।
ধ্যান যোগীতে পরিণত করে
ঈশ্বরের দেখা পেতে হলে, সকালে, রাত্রে এবং দিনের বেলায় যখনই কিছুটা অবসর পাওয়া যাবে, তখনই ধ্যান করতে হবে। তাছাড়া, সপ্তাহে একদিন ছয় ঘণ্টা ধ্যান করা খুবই জরুরি। এটা কোনো বাড়াবাড়ি নয়; এমন অনেকে আছেন, যাঁরা প্রতিদিন দশ ঘণ্টা ধরে পিয়ানো বাজানো অভ্যাস করেন এবং এটা তাঁদের কাছে কিছুই না। ব্রহ্মজ্ঞানী হতে হলে দীর্ঘ সময় ঈশ্বর চিন্তায় নিযুক্ত থাকা প্রয়োজন। ঈশ্বর যেন বুঝতে পারেন যে অন্য সব কিছুর চেয়ে আমরা তাঁকেই বেশি ভালোবাসি। ধ্যানে দক্ষ হয়ে উঠে অতিমানসচেতনার গভীরে যেতে শিখে গেলে, তখন পাঁচ ঘণ্টার নিদ্রা যথেষ্ট। রাতের বাকি সময়টা ধ্যানের জন্য রেখে দিতে হবে। রাত্রিবেলা, ঊষাকাল এবং ছুটির দিনগুলি ঈশ্বরের আরাধনার জন্য রাখতে হবে। এইভাবে যে কেউ, এমন কি কর্মব্যস্ত প্রতীচ্যবাসীরাও যোগী হয়ে উঠতে পারেন। অতএব প্রতীচ্যের যোগী হয়ে উঠতে হবে। আর তার জন্য আমার মতো মাথায় পাগড়ি বাঁধা বা লম্বা চুল রাখার কোনো প্রয়োজন নেই।
গির্জা বা মন্দিররূপী মৌচাক যেমন দরকার, তেমনি ওই গির্জা বা মন্দিরগুলিকে আমাদের আত্মানুভূতি-রূপ মধু দিয়ে পরিপূর্ণ করে তোলাও খুব জরুরি। একথা সত্য যে ঈশ্বর গির্জাতে বা মন্দিরেও বিরাজ করেন; তবে সেখানে যাতায়াত করলেই যে ঈশ্বর আত্মপ্রকাশ করবেন, তাও নয়। গির্জাতে, মন্দিরে যাওয়া ভালো, কিন্তু তার চেয়েও ভালো নিত্য ধ্যানসাধনা করা। দুটোই করা আরও ভালো; কেননা, গির্জায়, মন্দিরে যাতায়াত করলে মনে অনুপ্রেরণার সঞ্চার হতে পারে; আর প্রতিদিন ধ্যানমগ্ন হতে পারলে আত্মোন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে। যখন ভক্তহৃদয় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে এবং অবিরাম ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা-বাণ নিক্ষেপ করতে থাকে, তখন ঈশ্বর তাঁর কাছে ধরা দেন। তাঁকে পাওয়ার জন্য এমন দুর্নিবার আকুতি একান্তই প্রয়োজন। একাধারে যোগী হওয়া এবং আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল রাখা, এই দুটোর জন্য প্রয়োজন, ঘরে বসে ধ্যান করা, নিজেকে সংযত রাখা এবং সব কাজকর্ম এমন মনোভাব নিয়ে করা যে, সে সবই ঈশ্বরের সেবা।
আমার ঐকান্তিক বাসনা হল মানুষের অন্তরে ঈশ্বরের জন্য মন্দির রচনা করা; তাদের মুখে দিব্য হাসি ফুটিয়ে তোলা। জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য হল নিজের অন্তরাত্মায় ঈশ্বরের জন্য মন্দির স্থাপনা করা। সেই কাজ সহজেই করা যায়; সেই উদ্দেশ্য নিয়েই সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের পাশ্চাত্য দেশে আগমন।
নিজের মনোমন্দিরে যে ঈশ্বরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সেই যোগী। সে আমার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে পারে যে, যোগ পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ — সব দেশের মানুষের জন্য, তারা সবাই ধর্মীয় মতবাদের অলিগলি দিয়ে এসে, যোগের রাজপথে মিলিত হতে পারে। এই সম্যক পথই শেষ হয়েছে চিদানন্দের মহাপ্রাসাদে। কেউ যদি একবার সেখানে পৌঁছোতে পারে, তাহলে, “সে আর বেরিয়ে আসে না।” (রিভিলেশন ৩:১২ বাইবেল)