সংকল্পবাক্যের নির্দেশাবলি

সংকল্প শক্তির ব্যবহারিক অনুমান
শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ রচিত “সংকল্প ও নিরাময়, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি” হতে গৃহিত

মানুষের ভাষাই হল মানুষের আত্মা… শব্দ যখন ঐকান্তিকতা, প্রত্যয়, বিশ্বাস এবং স্বজ্ঞার মতো প্রচণ্ড ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পমান বিস্ফোরকপূর্ণ হয়, তার বিস্ফোরণ ঘটলে পর তা যাবতীয় প্রতিবন্ধকতার পাহাড় ভেঙে দিয়ে অভিলষিত পরিবর্তন আনয়ন করে থাকে।

প্রতিটি বিষণ্ণতা বা সুখচিন্তা, বিরক্তি বা ধীরতার চিন্তা, মস্তিষ্ককোশে সূক্ষ্ম দাগ কেটে যায়; ফলে তা অসুস্থতা নয়ত স্বাচ্ছ্যন্দের চিন্তাকেই শক্তিশালী করে তোলে।

অবচেতনায় শরীর বা অসুখ নিয়ে চিন্তা করার অভ্যাস মনে একটা দারুণ প্রভাব সৃষ্টি করে। তাই দেখা যায় কঠিন মানসিক বা শারীরিক ব্যাধির শেকড় অবচেতনার গভীরে ছড়িয়ে আছে। সেই গোপন শেকড়টিকে উৎপাটন করতে পারলে অনেক ক্ষেত্রে রোগের নিরাময় ঘটে। সুতরাং চেতন মনের সংকল্পে এমন একটা প্রগাঢ়তা আনতে হবে যাতে তা অবচেতন মনেও ছড়িয়ে যায় তার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তার প্রভাব চেতন মনেও পড়ে থাকে।

অতএব দেখা যাচ্ছে—দৃঢ়, সচেতন সংকল্প, অবচেতনার মাধ্যমে দেহ ও মনে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। অতি দৃঢ় সংকল্প কেবল যে অবচেতন মনকেই স্পর্শ করে তাই নয়, তাকেও অতিক্রম করে পৌঁছে যায় অতিমানস চেতনাতেও—অলৌকিক শক্তির যাদুকরী ভাণ্ডার।


‘সত্য’ কথা বলার অভ্যাস স্বেচ্ছায়, নিঃশঙ্কে, বুদ্ধিমত্তা এবং ভক্তির সঙ্গে পালন করে যেতে হবে। মনে একাগ্রতায় কোনোরকম ঘাটতি থাকলে চলবে না। পলাতক শিশুদের মতো বিক্ষিপ্ত ভাবনাচিন্তাকেও বারবার স্বস্থানে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং ধৈর্য ধরে তাদের নির্ধারিত কর্মভার পালন করতে শেখাতে হবে।


ধৈর্যর সঙ্গে একনিষ্ঠ মন ও বুদ্ধির পৌনঃপুনিক প্রয়োগ অসাধ্যসাধন করতে পারে। জটিল, দীর্ঘস্থায়ী দৈহিক বা মানসিক যন্ত্রণা নিরাময়করণের জন্য প্রার্থনা, বারবার গভীরতার সঙ্গে এমনভাবে উচ্চারণ করতে হবে (রোগীর অবস্থার যদি কোনো পরিবর্তন নাও হয়, কিম্বা কোনোরকম বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তা সত্ত্বেও) যাতে তা প্রার্থনাকারীর স্বজ্ঞাজনিত স্থির বিশ্বাসের সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িত হয়ে যায়।


হে প্রদীপ্ত জ্যোতি! আমার হৃদয়কে জাগ্রত করো, আমার আত্মাকে জাগ্রত করো, আমার অন্ধকারকে প্রজ্বলিত করো, নীরবতার আবরণ ছিন্ন করো এবং তোমার মহিমায় আমার মন্দির পূর্ণ করো।


সংকল্পটি স্থির করার পর সব সংকল্পটি প্রথমে জোরে জোরে এবং তারপর ক্রমান্বয়ে আস্তে আস্তে বার বার আবৃত্তি করবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার কণ্ঠস্বরটি মৃদু গুঞ্জনধ্বনিতে পরিণত হচ্ছে। তারপর ঠোঁট বা জিভ না নাড়িয়েই মনে মনে প্রার্থনা জানাতে থাকো। এইভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত না গভীর নিরবচ্ছিন্ন একাগ্রতা আসছে, যা অবশ্যই অচৈতন্য অবস্থা নয়, কিন্তু একরকমের গাঢ় অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক চিন্তা—ততক্ষণ ওই সংকল্প চলতে থাকুক।


এইরকম করে মনে মনে যদি সংকল্পটি চলতে থাকে এবং তুমি তার আরও গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করো, তাহলে তুমি ক্রমশঃ বর্ধিতমাত্রায় শান্তি ও আনন্দ অনুভব করবে। গভীর একাগ্রতাভাব যখন আসবে তখন তোমার সংকল্প অবচেতনার সঙ্গে মিশে যাবে এবং পরে শক্তি সঞ্চয় করে, অভ্যাসের নীতিতে, তোমার চেতন মনকে প্রভাবিত করতে ফিরে আসবে।


যখন তুমি ক্রমবর্ধমান শান্তি অনুভব করবে তখন তোমার সংকল্প আরও গভীরে, অতিমানসলোকে পৌঁছোবে এবং তোমার চেতন মনকে প্রভাবিত করতে ও যাবতীয় বাসনা পূর্ণ করতে অসীম শক্তি নিয়ে ফিরে আসবে। যদি সন্দেহ না করো তাহলে এই বিজ্ঞানসম্মত বিশ্বাসের অলৌকিক শক্তিকে তুমি প্রত্যক্ষ করবেই।

সংকল্পের অভ্যাস কীভাবে করতে হবে

আরও পড়ুন

সংকল্প ও নিরাময়, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি – শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ

এই শেয়ার করুন