কার্যকর প্রার্থনার চাবিকাঠি

যোগদা সৎসঙ্গ পাঠমালায়, পরমহংস যোগানন্দ একাগ্রতা এবং ধ্যানের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির মাধ্যমে অন্তর্বাসী ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য ধাপে ধাপে নির্দেশাবলি দিয়েছেন। এই পদ্ধতির অনুসরণকারীরা তাদের সম্প্রসারিত চেতনার দ্বারা সবার মধ্যে ঈশ্বর আছেন সেই অনুভব থেকে এবং সমগ্র বিশ্ব একটি পরিবার তার প্রকৃত উপলব্ধি থেকে অন্যদের সেবা করুক, এটা তাঁর প্রবল ইচ্ছা ছিল।

বিশ্বব্যাপী প্রার্থনামণ্ডলীর কার্যকারিতা কেবলমাত্র অধিকসংখ্যায় সহানুভূতিশীল মানুষের আন্তরিক অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করে না, পরন্তু প্রার্থনামণ্ডলীর প্রতিটি সদস্যের ঈশ্বরসংযোগের গভীরতার ওপরেও নির্ভর করে। প্রার্থনায় ঈশ্বরের সাড়া পাওয়ার জন্য কীভাবে প্রার্থনা করতে হয় তা জানা অত্যাবশ্যক।

কার্যকর প্রার্থনার জন্য এখানে কিছু মূল বিষয় মনে রাখতে হবে:

একাগ্রতা

Lighted candle in Smriti Mandir.সফল প্রার্থনা অনেকটাই নির্ভর করে মনঃসংযোগের ক্ষমতার ওপর — মনকে বিক্ষিপ্ততা থেকে মুক্ত করে আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে সুনির্দিষ্টভাবে স্থাপন করার ক্ষমতার ওপর। ঠিক যেমন সূর্যের বিক্ষিপ্ত রশ্মি একটি আতস কাচের দ্বারা একত্রিত হয়ে তীব্র দহনশক্তি তৈরি করে, তেমনই চিন্তা, অনুভূতি এবং উচ্চারিত শব্দের মধ্যে সুপ্ত, সূক্ষ্ম অথচ প্রবল শক্তি, একটি নির্দিষ্ট মনঃসংযোগের পদ্ধতি দ্বারা একত্রিত হয়ে এক বিরাট শক্তিশালী প্রার্থনায় পরিণত হতে পারে।

একাগ্রতার মাধ্যমে মানসিক শক্তির বিশাল ভাণ্ডারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব, যা যে কোনও বাহ্যিক প্রচেষ্টায় বা ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের অপরিবর্তনীয় সম্পর্ক উপলব্ধি করার জন্য অভ্যন্তরীণভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।

কার্যকর প্রার্থনার জন্য ধ্যানের গুরুত্ব

ঈশ্বরকে জানার জন্য মনঃসংযোগ করাই ধ্যান। পরমহংস যোগানন্দ শিখিয়েছেন – আমরা যে “ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি” রূপে গড়া সেই সচেতনতা লাভের জন্য প্রার্থনার আগে ধ্যান করা ভালো। যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি পাঠমালায় শেখানো একাগ্রতা এবং ধ্যানের প্রক্রিয়াগুলি মনকে অন্তর্মুখী করে, যাতে অন্তরস্থিত পরমাত্মার অস্তিত্ব স্পষ্ট হয়। সেই অভ্যন্তরীণ দিব্য অস্তিত্বের ওপর মনোনিবেশ দ্বারা ঈশ্বরের সঙ্গে সর্বদা একাত্ম আমাদের প্রকৃত সত্তা, বা আত্মার প্রত্যক্ষ উপলব্ধির দিকে আমরা চালিত হই।

পরমহংসজি বলেছেন, “ঈশ্বর চান না যে আমরা ভিখারির মতো প্রার্থনা করি, যা চাই তা পাওয়ার জন্য তাঁর খোশামুদি করি। যে কোনো স্নেহময় পিতার মতো, তিনিও আমাদের উচিত ইচ্ছা পূর্ণ করে আনন্দ পান। তাই ধ্যান দ্বারা প্রথমে তাঁর সঙ্গে তোমার একত্ব স্থাপন করো। তারপর তোমার অনুরোধ গ্রাহ্য হবে জেনে, সন্তানের প্রেমময় প্রত্যাশা নিয়ে তোমার পিতার কাছে তোমার যা প্রয়োজন তা চাইতে পারো।”

ইচ্ছাশক্তির ক্ষমতা

Man praying.ইচ্ছাশক্তি প্রার্থনার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। পরমহংসজি বলেছেন, “ইচ্ছাশক্তির অবিরাম, শান্ত এবং দৃঢ় প্রয়োগ সৃষ্টির শক্তিকে নাড়া দেয় এবং সেই অসীম থেকে একটি প্রতিবেদন নিয়ে আসে। যখন তুমি হার না মেনে সমানে লেগে থাকো, তোমার ইচ্ছার লক্ষ্যবস্তুটিকে মূর্ত হতেই হয়। যখন তুমি অনবরত তোমার চিন্তা এবং কাজের মধ্য দিয়ে ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ চালিয়ে যাও, তখন তুমি যা ইচ্ছা করছ তা সফল হতে বাধ্য। এমন কি যদি পৃথিবীতে তোমার ইচ্ছার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিছুই না থাকে, তোমার ইচ্ছা অবিচল থাকলে, কোনো না কোনো ভাবে তোমার আকাঙ্ক্ষিত ফল প্রকট হবেই। সেই ধরণের ইচ্ছাশক্তির মধ্যেই ভগবানের জবাব নিহিত আছে; কারণ ইচ্ছাশক্তি ভগবানের কাছ থেকে আসে, আর অবিচল ইচ্ছাই ঈশ্বরের ইচ্ছা।”

প্রার্থনায় দুটি ভাবের মধ্যে পার্থক্য করা প্রয়োজন – এক প্রান্তে নিশ্চেষ্ট ভাব যে ভগবান সবকিছু করে দেবেন, আর অপর প্রান্তে নিজের প্রচেষ্টার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা। পরমহংস যোগানন্দ বুঝিয়েছেন যে “সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করার মধ্যযুগীয় ধারণা এবং স্বাভিমানের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরতার আধুনিক রীতির মধ্যে একটি সাম্যতা বজায় রাখা উচিত।”

ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা ভোগের আগে জিশু যখন প্রার্থনা করেছিলেন, “তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক”, তিনি কিন্তু তাঁর নিজের ইচ্ছাকে অস্বীকার করছিলেন না। নিজের জীবনে ঈশ্বরের দিব্য পরিকল্পনার কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য তাঁর নিজের ইচ্ছাশক্তির ওপর সম্পূর্ণ আধিপত্যের প্রয়োজন ছিল। খুব কম মানুষই তাদের ইচ্ছাশক্তির এতটা বিকাশ করতে পারে। কিন্তু ঈশ্বর চান যে তাঁর সন্তান হিসাবে আমরা প্রত্যেকটি কাজেই তাঁর দেওয়া বিচারশক্তি, ইচ্ছাশক্তি এবং অনুভব ক্ষমতাকে যথাসাধ্য প্রয়োগ করি। সাফল্য অর্জনের জন্য আমাদের আয়ত্তাধীন সমস্ত উপায় কাজে লাগানোর সাথে সাথে আমাদের অন্তঃস্থ দিব্য সত্তার পথনির্দেশও আমাদের চাওয়া উচিত। এই সুসমঞ্জস মনোভাব আমাদের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য, বোধশক্তি, মানবিক এবং ঐশ্বরিক কর্মক্ষমতার সমন্বয় এবং আমাদের মানবিক ইচ্ছার সঙ্গে ঈশ্বরের ইচ্ছার সংগতি নিয়ে আসে।

ভক্তি, ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা

Devotee Meditatingভক্তিরঞ্জিত প্রার্থনাই সবচেয়ে কার্যকর প্রার্থনা। ভক্তি, ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা, হৃদয়ের সেই চৌম্বক শক্তি যা ঈশ্বর অগ্রাহ্য করতে পারেন না। পরমহংস যোগানন্দ বলেছেন: “‘হৃদয়ান্বেষী’ কেবল তোমার আন্তরিক ভালোবাসা চান। তিনি একটি ছোটো শিশুর মতো: কেউ তাঁকে নিজের সম্পূর্ণ সম্পদ উৎসর্গ করতে চায় কিন্তু তিনি তা নেন না; আবার আর একজন তাঁর কাছে কেঁদে বলে ‘হে প্রভু, আমি তোমায় ভালোবাসি!’ আর সেই ভক্তের হৃদয়ে তিনি ছুটে চলে যান।”

আমাদের চাওয়ার আগেই তিনি সব জানেন, তাই লম্বা একঘেয়ে প্রার্থনার চেয়ে ভগবান আমাদের ভালোবাসায় বেশি আগ্রহী। জন বুনিয়ান বলেছেন, “প্রার্থনায় হৃদয়হীন শব্দের চেয়ে শব্দহীন হৃদয় থাকা ভালো।” আবেগ এবং মনোযোগহীন যান্ত্রিক প্রার্থনা হল অন্যমনস্ক ভাবে ভগবানকে বাসি ফুলের অঞ্জলি দেওয়ার মতো — যার মাধ্যমে সাড়া পাওয়ার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমরা যদি ভক্তি, একাগ্রতা এবং ইচ্ছাশক্তির সাথে ঈশ্বরকে বারবার ডাকি, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারব যে আমাদের প্রার্থনা তিনি শোনেন এবং সাড়া দেন, যাঁর শক্তি এবং আমাদের জন্য সপ্রেম চিন্তা পরম এবং সীমাহীন।

এই শেয়ার করুন