প্রেম: মানবীয় এবং ঐশ্বরিক

Merging of sky and ocean depicting Human and Divine love.ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনেই তুমি সর্বোচ্চ প্রেম অনুভব করতে পারবে। আত্মা এবং পরমাত্মার মধ্যে প্রেম হল পূর্ণাঙ্গ প্রেম, যে প্রেম তোমরা সকলে খুঁজে বেড়াচ্ছ। যখন তুমি ধ্যান করো, প্রেম বৃদ্ধি পায়। তোমার হৃদয়ে লক্ষ লক্ষ রোমাঞ্চের শিহরণ বয়ে যায়…। গভীরভাবে ধ্যান করলে এমন এক প্রেম তোমাকে অভিভূত করে ফেলবে, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না; তুমি তাঁর দিব্য প্রেমকে জানবে, এবং সেই শুদ্ধ প্রেম সকলকে বিতরণ করতে পারবে।

ঐশ্বরিক প্রেমের এক কণামাত্রও অনুভব করতে পারলে তোমার আনন্দ এত বিরাট হবে, এবং তোমাকে তা এমন অভিভূত করে ফেলবে — যে তাকে তুমি নিজের ভিতর ধরে রাখতে পারবে না।

পুরো জগতটাই প্রেম শব্দটির মূল অর্থ ভুলে গেছে। এই শব্দটির এতটাই অপব্যবহার মানুষ করেছে আর তাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে, যে প্রকৃত প্রেম কি তা খুব কম লোকই জানে। যেমন জলপাইয়ের প্রতিটি অংশে তেল থাকে, তেমনই সৃষ্টির প্রতিটি অংশ প্রেমে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। কিন্তু প্রেমের সংজ্ঞা দেওয়া খুবই কঠিন – যেমন একটি কমলালেবুর স্বাদকে পুরোপুরি ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তার জন্য তোমাকে ফলটি খেতে হবে। প্রেমের ক্ষেত্রেও তাই।

সাধারণ অর্থে, সৃষ্টির মধ্যে আকর্ষণের ঐশ্বরিক শক্তি হল প্রেম, যা সুসংগত করে, ঐক্যবদ্ধ করে, একত্রে আবদ্ধ করে…। যাদের জীবন প্রেমের আকর্ষণী শক্তির সাথে সমন্বয় রেখে চলে, তারা প্রকৃতি এবং সমস্ত জীবজগতের সাথে সমন্বয় লাভ করে এবং ঈশ্বরের সাথে আনন্দময় পুনর্মিলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

“সাধারণ প্রেম স্বার্থপর, যার অজ্ঞানতা-উৎপন্ন মূলে রয়েছে বাসনা এবং তার পরিতৃপ্তি,” [শ্রীযুক্তেশ্বর বলেছেন] “ঐশ্বরিক প্রেম শর্তহীন, সীমাহীন, বিকারহীন। মনুষ্যহৃদয়ের চঞ্চলতা শুদ্ধ প্রেমের রূপান্তরকারী ছোঁয়ায় চিরতরে শান্ত হয়।”

অনেকেই আজকে তোমাকে “ভালোবাসি” বলে, আর কালকেই ত্যাগ করে। এ ভালোবাসা নয়। যার হৃদয় ঈশ্বরের প্রেমে ভরা, সে স্বেচ্ছায় কাউকে আঘাত করতে পারে না। যখন তুমি ঈশ্বরকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসো, তখন তিনি সকলের প্রতি তাঁর নিঃশর্ত ভালোবাসা দিয়ে তোমার হৃদয় পূর্ণ করে দেন। সেই প্রেম ভাষায় প্রকাশ করা যায় না…। সাধারণ মানুষ এইভাবে অন্যকে ভালোবাসতে পারে না। “আমি এবং আমার,” এই চেতনায় আত্মকেন্দ্রিত হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষ এখনও তার নিজের অন্তঃস্থিত এবং অন্য সকল প্রাণীর মধ্যে বর্তমান সর্বব্যাপী ঈশ্বরকে আবিষ্কার করতে পারেনি। আমার কাছে দু-জন মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই; আমি সবাইকে একই ঈশ্বরের আত্মিক প্রতিফলনরূপে দেখি। আমি কাউকে পর ভাবতে পারি না, কারণ আমি জানি যে আমরা সবাই সেই একক পরমাত্মার অংশ। যখন তুমি ধর্মের প্রকৃত অর্থ অনুভব করবে, অর্থাৎ ঈশ্বরকে জানবে, তখন তুমি বুঝতে পারবে যে তিনিই তোমার সত্ত্বা এবং তিনি সকল জীবের মধ্যে সমানভাবে এবং নিরপেক্ষভাবে বিদ্যমান। তখন তুমি অন্যদেরও ততটাই ভালোবাসতে পারবে যতটা তুমি নিজেকে ভালোবাসো।

যে ঈশ্বরপ্রেমে ডুবে আছে, তার চেতনায় কোনো ছলনা, কোনো জাতি বা ধর্মের সংকীর্ণতা, কোনোরকমের সীমাবদ্ধতা নেই। যখন তুমি সেই ঐশ্বরিক প্রেম অনুভব করবে, তখন তুমি ফুল এবং পশুর মধ্যে, দুজন মানুষের মধ্যে, কোনো পার্থক্য দেখতে পাবে না। সমস্ত প্রকৃতির সাথে তোমার গভীর যোগাযোগ স্থাপিত হবে এবং তুমি সমস্ত মানবজাতিকে সমানভাবে ভালোবাসবে।

দিব্য উপলব্ধির জন্য সকল জীবের প্রতি করুণা অপরিহার্য, কারণ ঈশ্বর স্বয়ং করুণার সাগর। কোমলহৃদয় মানুষ অন্যের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে নিতে পারে, তার কষ্ট অনুভব করতে পারে এবং তা লাঘব করার চেষ্টা করতে পারে।

স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে, পিতা-মাতা এবং সন্তানের মধ্যে, বন্ধুদের মধ্যে, নিজের এবং অন্য সকলের মধ্যে শুদ্ধ এবং নিঃশর্ত ভালোবাসা গড়ে তোলার শিক্ষাই আমরা এই পৃথিবীতে শিখতে এসেছি।

প্রিয়জনের পূর্ণতার কামনা করা, তার কথা ভেবে বিশুদ্ধ আনন্দ অনুভব করা হল দিব্য প্রেম; এবং এটিই প্রকৃত বন্ধুত্বের প্রেম।

ঈশ্বরের প্রতি প্রেম, পরমাত্মার প্রতি প্রেম, এক সর্বগ্রাসী প্রেম। একবার তুমি এটি অনুভব করলে, তা তোমাকে অনন্তের জগতে অবিরাম নিয়ে যেতে থাকবে। সেই প্রেম তোমার হৃদয় থেকে কখনোই দূরে সরে যাবে না। তা সেখানে জ্বলতে থাকবে এবং তার আগুনে তুমি পরমাত্মার সেই মহান চৌম্বকশক্তিটি খুঁজে পাবে যা অন্যদের তোমার দিকে আকর্ষণ করে এবং তোমার যা কিছু প্রয়োজন বা বাসনা আছে তাও আকর্ষণ করে আনে।

সত্যি বলছি যে আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তরই আমি পেয়েছি — মানুষের থেকে নয় বরং ঈশ্বরের থেকে। তিনি আছেন। তিনি আছেন। তাঁর চেতনাই আমার মাধ্যমে তোমাদের সাথে কথা বলে। আমি তাঁরই ভালোবাসার কথা বলছি। রোমাঞ্চের পর রোমাঞ্চ! মৃদু মলয় বাতাসের মতো তাঁর ভালোবাসা আত্মার উপর ভেসে আসে। দিবারাত্রি, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, বছরের পর বছর, তা বাড়তে থাকে — তার শেষ কোথায় জানা নেই। আর তোমরা প্রত্যেকে এটিই খুঁজছ। তোমরা মনে করো যে তোমরা মানুষের ভালোবাসা চাও আর নিজের সমৃদ্ধি চাও, কিন্তু এসবের পিছন থেকে তোমাদের পরমপিতা তোমাদের ডাকছেন। যদি তোমরা বুঝতে পারো যে তিনি তাঁর সমস্ত দানের চেয়েও মহান, তাহলে তোমরা তাঁকে খুঁজে পাবে।

আমাদের প্রিয়জনেরা আমাদের অনন্তকাল ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে; কিন্তু যখন তারা নিজেদের পার্থিব স্মৃতি ভুলে গিয়ে মহানিদ্রায় ডুবে যায়, তখন তাদের প্রতিজ্ঞার কী মূল্য থাকে? কে আমাদের মুখে না বলেও চিরকাল ভালোবেসে যায়? যখন অন্যেরা আমাদের ভুলে যায়, তখন কে আমাদের মনে রাখে? যখন আমরা এই জাগতিক বন্ধুদের ছেড়ে যাবো, তখনও কে আমাদের সাথে থাকবে? একমাত্র ঈশ্বর!

ঈশ্বর সর্বদা নীরবে তোমার কানে কানে বলছেন:…

“কোনো কথা না বলে আমি চিরকাল তোমাকে ভালোবেসে এসেছি। একমাত্র আমিই পূর্ণ সততার সঙ্গে বলতে পারি, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি;’ কারণ তোমার জন্মের আগে থেকেই আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম; আমার ভালোবাসাই তোমাকে জীবন দিয়েছে, এমন কি এই মুহূর্তেও তোমাকে ধারণ করে রেখেছে; যখন মৃত্যুর দরজা তোমাকে বন্দি করে ফেলবে, যেখানে কেউই, এমন কি তোমার সবচেয়ে বড়ো মানবিক প্রেমীও তোমার কাছে পৌঁছোতে পারবে না, তখন একমাত্র আমিই তোমাকে ভালোবাসা দিতে পারি।”

ঈশ্বরের সাথে প্রেমই তোমার সবচেয়ে বড়ো প্রেম। মানুষের ভালোবাসা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ঈশ্বরের সাথে তোমার প্রেম চিরস্থায়ী। তাঁকে না দেখে একটি দিনও যেন না যায়। এই কারণেই আমি লিখেছিলাম, “জন্ম জন্মান্তর ধরে আমি তোমার নাম ধরে ডেকেছি, আমার সমস্ত রূপোলী স্বপ্নের স্রোতধারাগুলি বেয়ে খুঁজে বেড়িয়েছি।”* আমি সবসময় তাঁকে বলি যে আমাকে বাইরে পাঠানোর জন্য তিনিই দায়ী; কিন্তু অবশেষে আমি বুঝতে পেরেছি যে জীবনের সমস্ত বিভ্রমগুলি আমাকে তাঁর মহিমা আরও বেশি করে বোঝানোর জন্যই ছিল, তাঁকে খুঁজতে উৎসাহিত করার জন্য ছিল। সর্বদা তিনিই ছিলেন, যাঁকে আমি সকল পিতার আড়ালে পরমপিতা, সকল মাতার আড়ালে জগন্মাতা, সকল প্রেমিকের আড়ালে দিব্য প্রেমিকরূপে জন্ম জন্মান্তর ধরে খুঁজতাম। তিনিই হলেন দিব্য প্রেমিক এবং আমাদের আত্মাই হল প্রেমাস্পদ এবং যখন আত্মা মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমিকের সাথে মিলিত হয়, তখনই শুরু হয় চিরন্তন প্রেম। জন্ম জন্মান্তর ধরে সমস্ত মানব প্রেমের মধ্যে তুমি যে প্রেম খুঁজে বেড়িয়েছ, তা অবশেষে তোমার হয়। তুমি কখনও অন্য কিছু আর চাইবে না।

* “Divine Love Sorrows,” – Songs of the Soul.

এই শেয়ার করুন