যে পৃথিবীতে মানবজাতি যুদ্ধ, দারিদ্র্য, রোগ, উদ্বেগ এবং জীবনে উদ্দেশ্যের অভাব দ্বারা বিধ্বস্ত, সেখানে সহানুভূতিশীল মানুষেরা স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা করেন, “পৃথিবীর সমস্যা কমিয়ে আনার জন্য আমি কি করতে পারি?”
পরমহংস যোগানন্দজি উত্তর দিয়েছেন:
“শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক সচেতনতা–নিজের এবং অন্য প্রতিটি জীবের অন্তরে ভগবানের উপস্থিতি উপলব্ধি করা–পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে। এছাড়া আমি শান্তির আর কোনো সম্ভাবনা দেখি না। নিজেকে দিয়ে শুরু করো। নষ্ট করার মতো সময় আর নেই। পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজ্য নামিয়ে আনার জন্য তোমার কর্তব্যকর্মটি করা তোমার দায়িত্ব।”
যেমন আমরা ঈশ্বরের উপস্থিতি ও প্রেম অন্তরে অনুভব করতে থাকি, আমাদের মধ্যে তা বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা বিকশিত হয়। মানবজাতির সমস্যার এটিই এক ব্যবহারিক সমাধান, কারণ আমাদের চেতনা এবং বিশ্ব-পরিস্থিতির মধ্যে এক সক্রিয় সম্পর্ক রয়েছে।
রাজনৈতিক, সামাজিক বা আন্তর্জাতিক সমস্যা–এই সব অবস্থা হল লক্ষ লক্ষ মানুষের জমে ওঠা চিন্তাভাবনা এবং কর্মের ফল। বিশ্ব-পরিস্থিতির স্থায়ী পরিবর্তন করতে হলে প্রথমে আমাদের চিন্তাধারাকে এবং নিজেদেরকে বদলাতে হবে। যেমন পরমহংস যোগানন্দ বলেছেন, “নিজেকে শোধরাও, দেখবে হাজারো মানুষ শুধরে গেছে।”
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেছেন:
“মানুষ এখন ইতিহাসের এক চরম সংকটপূর্ণ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে নিজের ভ্রান্ত চিন্তার ফল এড়াতে গেলে তাকে ঈশ্বরের দিকে মুখ ফেরাতে হবে। আমাদের প্রার্থনা করতে হবে, শুধু গুটিকয় মানুষকে নিয়ে নয়। আমাদের সরলভাবে, আকুলভাবে, আন্তরিক ভাবে এবং আমাদের বিশ্বাস বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান শক্তির সাথে, অবশ্যই প্রার্থনা করতে হবে…
“প্রার্থনা হল সংশ্লিষ্ট মানুষের ভালোবাসার এক সক্রিয় প্রকাশ, ভগবানের সাহায্যের জন্য মানুষের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। তুমি তোমার প্রার্থনা এবং প্রার্থনামূলক কর্মসূচি দিয়ে পৃথিবীতে পরিবর্তন আনতে সাহায্য করতে পারো।
—দ্যাগ হাম্মারস্কজোল্ড, জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ধ্যানকক্ষের উৎসর্গীকরণের সময়
প্রকৃতিতে যে আকস্মিক বিপর্যয় ঘটে, যা ব্যাপক ধ্বংস এবং গণসংঘাত নিয়ে আসে, তা ‘ভগবানের হাত’ নয়। এই ধরণের বিপর্যয় মানুষেরই চিন্তা ও কর্মের ফল। যেখানেই মানুষের ভ্রান্ত চিন্তা ও অপকর্মের ফলে জড়ো হওয়া ক্ষতিকর স্পন্দন বিশ্বের ভালো এবং মন্দের ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করে সেখানেই তুমি ধ্বংস দেখতে পাবে…
“মানুষের চেতনায় যখন বিষয়াসক্তি প্রাধান্য পায়, তখন এক সূক্ষ্ম বিরুদ্ধ রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়; তাদের সম্মিলিত শক্তি প্রকৃতির বৈদ্যুতিক সাম্যতা ভঙ্গ করে এবং তখনই ভূমিকম্প, বন্যা এবং অন্য সমস্ত বিপর্যয় ঘটে।”
ঈশ্বর-সংযোগ ব্যক্তিগত এবং আন্তর্জাতিক নিরাময় নিয়ে আসে
কিন্তু পরমহংসজি জোর দিয়েছেন যে যদি যথেষ্ট সংখ্যায় মানুষ ধ্যান ও প্রার্থনার দ্বারা ভগবানের দিকে ঝোঁকে তাহলে স্বার্থপরতা, লোভ, এবং ঘৃণার এই বিরুদ্ধ স্পন্দনকে–যা মানুষের কাছে রোগ এবং নিরানন্দ, জাতির কাছে যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নিয়ে আসে–জয় করা সম্ভব। আধ্যাত্মিক জীবনযাপন এবং ঈশ্বরের সাথে সংযোগসাধনের মাধ্যমে নিজেদেরকে পরিবর্তন করে আমরা স্বভাবতই শান্তি এবং সমন্বয়ের স্পন্দন বিকীর্ণ করি, যা অসামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনের নেতিবাচক প্রভাবকে অনেকটাই প্রতিরোধ করে।
“এসো আমরা এক আত্মার মৈত্রীসংঘ এবং একটি ঐক্যবদ্ধ বিশ্বের জন্য হৃদয় দিয়ে প্রার্থনা করি। যদিও জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী এবং রাজনৈতিক মতামতের দ্বারা আমাদের বিভক্ত বলে মনে হতে পারে, তবুও, একই ঈশ্বরের সন্তান রূপে আমাদের প্রাণে আমরা ভ্রাতৃত্ব এবং বিশ্ব ঐক্য অনুভব করতে পারি। আমরা যেন এক সংযুক্ত বিশ্বসংঘ নির্মাণ করার জন্য কাজ চালিয়ে যাই, যেখানে প্রতিটি জাতি মানুষের প্রবুদ্ধ বিবেকের মাধ্যমে ঈশ্বর দ্বারা পরিচালিত হয়ে এক কার্যকর অংশ হবে।
“আমাদের হৃদয়ে আমরা সকলেই ঘৃণা এবং স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত হওয়া শিখতে পারি। এসো আমরা সমস্ত জাতির মধ্যে সমন্বয়ের জন্য প্রার্থনা করি; তারা যেন একটি নতুন, ন্যায়শীল সভ্যতার তোরণ দিয়ে হাতে হাত ধরে এগিয়ে যেতে পারে।”
–পরমহংস যোগানন্দ
অতএব, অপরের জন্য প্রার্থনা হল সর্বোচ্চ সেবার মধ্যে একটি যা ঈশ্বরের নিরাময় ক্ষমতার মাধ্যম হিসাবে আমরা অর্পণ করতে পারি। বস্তুগত দান, সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ, এবং অন্যান্য ধরনের ত্রাণকার্য সাময়িকভাবে মানুষের দুঃখকষ্ট দূর করার জন্য মূল্যবান এবং আবশ্যক, কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত প্রার্থনা বিশ্বের দুঃখকষ্টের যা মূল কারণ–মানবজাতির ভ্রান্ত চিন্তাধারা–তার গোড়াতেই আঘাত হানে।
বিশ্বব্যাপী প্রার্থনাচক্রে অংশগ্রহণ করে আমরা প্রত্যেকেই পৃথিবীতে এবং আমাদের প্রিয়জনদের জীবনে–যাদের সাহায্যের প্রয়োজন–স্থায়ী শান্তি এবং আরোগ্য নিয়ে আসার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ভাবে সাহায্য করতে পারি।
















