যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া শব্দকোশ (ই – খ)

ইথার (Ether): সংস্কৃত শব্দ “আকাশ”, যা “ইথার” ও “স্থান” (space) উভয় অর্থেই অনূদিত হয়, এটি মূলত সেই কম্পনশীল উপাদানকে বোঝায় যা ভৌত জগতের মধ্যে সবচেয়ে সূক্ষ্ম। (দ্রষ্টব্য: পঞ্চতত্ত্ব)। “আকাশ” শব্দটি এসেছে “আ” (অর্থ: “দিকে”) এবং “কাশা” (অর্থ: “দেখা যায়,” “প্রকাশিত হওয়া”) থেকে। আকাশ হল এক সূক্ষ্ম “পটভূমি” যার বিপরীতে বস্তুজগতের সব কিছু অনুভবযোগ্য ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। পরমহংস যোগানন্দ বলেছেন: “স্থান বস্তুকে মাত্রা দেয়; ইথার চিত্রগুলোকে পৃথক করে।” তিনি আরও ব্যাখ্যা করেছেন: “ইথারে পূর্ণ স্থান হল স্বর্গ বা সূক্ষ্ম জগত এবং পৃথিবীর মধ্যকার সীমারেখা।” ঈশ্বর সৃষ্ট সমস্ত সূক্ষ্ম শক্তিগুলোই আলো বা চিন্তার রূপে গঠিত, এবং সেগুলো কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট কম্পনের আড়ালে লুকানো থাকে—এই কম্পনই ইথার হিসেবে প্রকাশিত হয়।

উপনিষদ: উপনিষদ বা বেদান্ত (শাব্দিক অর্থ: “বেদের সমাপ্তি”) চারটি বেদের নির্দিষ্ট অংশে অন্তর্ভুক্ত এমন সারসংক্ষেপমূলক গ্রন্থসমূহ, যা হিন্দু ধর্মের দর্শন ও তত্ত্বের মৌলিক ভিত্তি গঠন করে।

ঋষি: সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ, উচ্চকোটির সাধুমহাত্মা যাঁরা দিব্যজ্ঞানের অধিকারী; বিশেষ করে প্রাচীন ভারতের সেই সকল প্রজ্ঞাদীপ্ত সাধকগণ যাদের স্বজ্ঞায় বেদ প্রকাশিত হয়েছিল।

একাগ্রতার প্রক্রিয়া: যোগদা সৎসঙ্গ পাঠমালায় শেখানো যোগদা সৎসঙ্গের একাগ্রতার প্রক্রিয়া (হং-স প্রক্রিয়াও বলা হয়)। এই প্রক্রিয়াটি যাবতীয় চিত্তবিক্ষেপকারী বিষয়সমূহ থেকে বৈজ্ঞানিকভাবে মনকে প্রত্যাহার করে এক বারে কেবল একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে শেখায়। সুতরাং ধ্যান বা ঈশ্বরের ওপর মনঃসংযোগের জন্য এর অবদান অপরিসীম। হং-স প্রক্রিয়া ক্রিয়াযোগ (দ্র) বিজ্ঞানের একটি অপরিহার্য অঙ্গ।

কর্ম (বিধান): ইহজন্ম বা পূর্বজন্মকৃত অতীত ক্রিয়ার ফল। শব্দটি সংস্কৃত ‘কৃ’ ধাতু থেকে উৎপন্ন যার অর্থ করা। হিন্দুশাস্ত্রের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কর্মের সমতামূলক বিধান বলতে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, কার্য-কারণ, বীজ রোপণ অনুযায়ী ফসল প্রাপ্তি বোঝায়। স্বাভাবিক ন্যায়নিষ্ঠা অনুযায়ী প্রতিটি মানুষ নিজ চিন্তা ও কর্মের দ্বারা নিজ ভাগ্য রচনা করে থাকে। যেমন একটি বৃত্ত যেখান থেকেই শুরু হোক না কেন, অনিবার্যভাবে নিজের উৎস বিন্দুতে ফিরে আসে, তেমনি বিচক্ষনতা বা অবিচক্ষনতা প্রসূত যে শক্তিই সে গতিশীল করে থাকুক না কেন তা বৃত্তাকারে তারই কাছে ফিরে আসবে যেখান থেকে তা শুরু হয়েছিল। তাই, মানুষ যদি কর্ম কে ন্যায়ের বিধান বলে গণ্য করে, তবে তার মনে আর ঈশ্বর ও মানুষের প্রতি কোনো ক্ষোভ জন্মায় না। মানুষের কর্ম, পূর্ণতা প্রাপ্তি বা আধ্যাত্মিকভাবে তার অতিক্রম না হওয়া পর্যন্ত জন্ম থেকে জন্মান্তরে তাকে অনুসরণ করে চলে। পুনর্জন্ম দ্রষ্টব্য। গোষ্ঠী, জাতি বা পৃথিবীর সব মানুষের মিলিত কর্মকেই ‘গণকর্ম’ বলে। এই কর্মের প্রভাব শুভ বা অশুভ কর্মের পরিমাণ অনুযায়ী, সাময়িক কিংবা সুদুরপ্রসারী হতে পারে। সুতরাং প্রতিটি মানুষের চিন্তা এবং কর্ম এই জগত ও তার সমস্ত অধিবাসীর শুভ বা অশুভ ফলে নিজস্ব অবদান রাখে।

কর্মযোগ: আসক্তিহীন কর্ম ও সেবাই ঈশ্বরলাভের পথ। নিঃস্বার্থ সেবা, ঈশ্বরের চরণে যাবতীয় কর্মফলের সমর্পণ এবং ঈশ্বরকেই একমাত্র কর্তা জ্ঞান করা — এইভাবেই ভক্ত অহংচেতনা থেকে মুক্ত হয়ে ঈশ্বরানুভূতি লাভ করে। যোগ দ্রষ্টব্য।

কারণ জগৎ: পার্থিব জড়জগত (পরমাণু, প্রোটন, ইলেকট্রন) এবং জ্যোতির্ময় প্রাণশক্তির সূক্ষ্মজগতের (লাইফট্রনস) অন্তরালে আছে কারণলোক বা চিন্তালোক (থটট্রনস)। অভিব্যক্তিবাদের পথ ধরে মানুষ যখন জড় ও সূক্ষ্মলোকের ঊর্ধ্বে উৎক্রমণ করে, তখন সে কারণ জগতে অবস্থান করতে থাকে। কারণ জগতের অধিবাসীদের চেতনায় জড় ও সূক্ষ্মজগৎ কেবল চিন্তারূপে অবস্থান করে। পার্থিব মানুষ যা কিছু কেবল কল্পনা করে, কারণদেহীরা বাস্তবে তাই করতে পারে — তাদের চিন্তাই তাদের একমাত্র সীমাবদ্ধতা। শেষপর্যন্ত মানুষ তার আত্মার শেষ আবরণটিও — তার কারণদেহ — একদিন ত্যাগ করে এবং সকল স্পন্দনশীল জগতের ঊর্ধ্বে সর্বব্যাপী পরমাত্মায় লীন হয়ে যায়।

কারণশরীর: আত্মা হিসেবে মানুষ কারণশরীরী একটি সত্তা। তার কারণশরীর সূক্ষ্ম ও জড় দেহের ভাবাত্মক এক ছাঁচ। সূক্ষ্ম শরীরের উনিশটি উপাদান ও জড় শরীরের ষোলটি মৌলিক উপাদান অনুযায়ী কারণ শরীর পঁয়ত্রিশটি ভাবাত্মক উপাদানে গঠিত হয়েছে।

কুণ্ডলিনী: সৃষ্টিশীল জীবন শক্তির শক্তিশালী স্রোত যা মেরুদন্ডের গোড়ার সূক্ষ্ম কুণ্ডলীকৃত পথে অবস্থান করে। সাধারণ জাগ্রত চেতনায় শরীরের জীবনী শক্তি মস্তিষ্ক থেকে মেরুদন্ডে প্রবাহিত হয় এবং এই কুণ্ডলীকৃত পথ ধরে তা জড়দেহ কে জীবন্ত রাখে এবং সূক্ষ্ম শরীর এবং কারণ শরীর কে বেঁধে রাখে এবং তার মধ্যস্থিত আত্মাকে নশ্বরদেহে ধরে রাখে। উচ্চতর চেতনায় ধ্যানের লক্ষ্য হল এই যে কুণ্ডলিনী শক্তিকে মেরুদন্ডের মধ্যে দিয়ে উপর দিকে পাঠান যাতে তা চক্রে নিহিত ঘুমন্ত আধ্যাত্মিক শক্তি কে জাগরিত করতে পারে। যাকে তার কুণ্ডলীকৃত আকৃতির জন্য “সারপেন্ট ফোর্স” বলা হয়ে থাকে।

কূটস্থ কেন্দ্র: দুই ভ্রূর মধ্যবর্তী স্থানে কূটস্থ বা আজ্ঞা চক্র সরাসরি বিপরীত দিকে মেডুলার (দ্র) সঙ্গে যুক্ত; এটি ইচ্ছাশক্তি, একাগ্রতা এবং কূটস্থ চৈতন্যের (দ্র) কেন্দ্র; অধ্যাত্ম নেত্রের (দ্র) স্থান।

কূটস্থ চৈতন্য: খ্রিস্ট চৈতন্য (দ্র)। সংস্কৃতে কূটস্থ অর্থে “যার কোনো পরিবর্তন হয় না” চৈতন্য অর্থ “চেতনা”।

কৃষ্ণ চৈতন্য: খ্রিস্ট চৈতন্য; কূটস্থ চৈতন্য। খ্রিস্ট চৈতন্য দ্রষ্টব্য।

ক্রিয়াযোগ: এটি একটি পবিত্র অধ্যাত্মবিজ্ঞান, বহু সহস্রাব্দ আগে ভারতবর্ষে যার উদ্ভব হয়েছিল। ধ্যানের কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যেগুলো নিষ্ঠা ও ভক্তির সঙ্গে অনুশীলন করলে ভক্তের ঈশ্বরানুভূতি লাভ হয়। পরমহংস যোগানন্দ ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, ক্রিয়া শব্দটি সংস্কৃত ‘কৃ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে যার অর্থ কোনো কিছু করা; সেইসঙ্গে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ কিছু করাকেও বোঝায়; এই “কৃ” ধাতু থেকেই কর্ম শব্দটি এসেছে, যা কার্যকারণের স্বাভাবিক তত্ত্বকেই প্রকাশ করে। সুতরাং ক্রিয়াযোগ-এর অর্থ হল “কোনো কাজ বা ক্রিয়ার মাধ্যমে পরমাত্মার সঙ্গে সংযোগস্থাপন বা যোগ।” ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও যোগসূত্র গ্রন্থে পতঞ্জলি যার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, সেই ক্রিয়াযোগ হল রাজযোগেরই একটি রূপ। বর্তমান যুগে মহাবতার বাবাজি (দ্র) কর্তৃক পুনরুজ্জীবিত এই ক্রিয়াযোগ সাধনার ধারা যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/ সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের গুরুদের দ্বারা দীক্ষার মাধ্যমে ভক্তদের প্রদান করা হয়। পরমহংস যোগানন্দের মহাসমাধির (দ্র) পর থেকে তাঁর নিযুক্ত আধ্যাত্মিক প্রতিনিধি অর্থাৎ যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/ সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের অধ্যক্ষ (অথবা অধ্যক্ষ মনোনীত কোনো প্রতিনিধি) মারফৎ এই দীক্ষাদান সম্পন্ন হয়ে থাকে।

খ্রিস্ট চৈতন্য: সমগ্র সৃষ্টিতে যে ঐশী চেতনা অনুস্যূত হয়ে আছে, তাকেই বলে “খ্রিস্ট” অথবা “খ্রিস্ট চৈতন্য”। খ্রিস্টীয় শাস্ত্রে একেই ‘নিজের একমাত্র পুত্র’ বলা হয়; অর্থাৎ যা জগতে পরমপিতার একমাত্র শুদ্ধ প্রতিফলন। হিন্দুশাস্ত্রে একেই ‘কূটস্থ চৈতন্য’ বা ‘তৎ’ বলা হয় অর্থাৎ পরমাত্মার বৈশ্বিক প্রজ্ঞা যা সৃষ্টির সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। ঈশ্বরের সঙ্গে একীভূত এই সেই বৈশ্বিক চেতনা যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, জিশু খ্রিস্ট এবং অন্যান্য অবতারগণের মধ্যে প্রকাশিত। মহাত্মা ও যোগীগণ একে ধ্যান সমাধির একটি অবস্থারূপে জানতে পারেন, যখন তাঁদের চেতনা সৃষ্টির প্রতি অণুপরমাণুর অন্তস্থিত প্রজ্ঞার সঙ্গে এক হয়ে যায়; তখন তাঁরা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ডকে নিজ দেহরূপে অনুভব করতে থাকেন। ত্রিত্ব দ্রষ্টব্য।

খ্রিস্ট: জিশুর সম্মানসূচক উপাধি: জিশু খ্রিস্ট। এই পরিভাষাটি সৃষ্টিতে অন্তর্নিহিত ঈশ্বরের বিশ্বজনীন বুদ্ধিমত্তাকে বোঝায় (কখনও কখনও তাঁকে মহাজাগতিক খ্রিস্ট বা অসীম খ্রিস্ট বলা হয়ে থাকে) বা মহান গুরুদের বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয় যারা দিব্য চেতনার সঙ্গে একাত্মতা অর্জন করেছেন। (গ্রীক ভাষায় ক্রিস্টোস কথার অর্থ “অভিষিক্ত ব্যক্তি,” হিব্রু ভাষায় যেমন মসীহ) খ্রিস্ট চৈতন্য এবং কূটস্থ চৈতন্য দ্রষ্টব্য।

এই শেয়ার করুন