যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এর
অধ্যক্ষ, শ্রীশ্রী স্বামী চিদানন্দ গিরির বার্তা
আমেরিকা তথা সারা বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে স্বামী চিদানন্দজি জাতিগত অবিচার ও বিভেদের গভীর সমস্যা ও মানবতার এই অসুখের উপসর্গ ছাড়াও এর কারণ আলোচনা করেন। ধ্যানের মাধ্যমে নিজেদের মাঝে শান্তি প্রসারিত করে আধ্যাত্মিক কর্মের মাধ্যমে সেই শান্তি সবার মাঝে সঞ্চারিত করে আমাদের সমাজে বদ্ধমূল জাতিগত বিদ্বেষ দূরীভূত করে ধ্যানীদের প্রকৃত শান্তিস্থাপক হতে উৎসাহ দেন।

নিচে দেওয়া স্বামী চিদানন্দজির বার্তা:
আধ্যাত্মিক মার্গের দিব্য বন্ধুদের, অভিনন্দন ও প্রণাম।
আমি জানি, আমেরিকা ও সারা বিশ্বের অনেক শহরে উদ্ভূত জাতিগত দাঙ্গার ঝঞ্ঝা নিয়ে আমার মতো আপনারাও গভীরভাবে চিন্তিত। এই বিষয়ে আপনাদের সাথে আমার কিছু ভাবনা ভাগ করে নিতে চাই।
প্রথমে সমস্যাটির সম্বন্ধে পরিষ্কার হয়ে নেওয়া যাক। জাতিগত অবিচার ও বিভেদ মানুষের হৃদয় ও মনের একটা রোগ — আমাদের মধ্যে যারা এখনো নিজের হৃদয় ও মনে ঈশ্বরের আসন পাতিনি। বর্তমান সময়ে আমরা সমগ্র আমেরিকা জুড়ে নতুন করে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখছি। আর শুধুমাত্র আমেরিকা নয়: কোনো না কোনো ভাবে জাতি, বর্ণ আর কোনো কোনো জায়গায় অবশ্যই ধর্মের নামে বৈষম্য ও ঘৃণায় সারা পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশই সংক্রামিত।
আমরা যেমন পুরাতন রোগের ক্ষেত্রে উপসর্গের চিকিৎসা করতে পারি — আর নিঃসন্দেহে এটা খুব সহায়ক হলেও রোগের কারণের ওপরেও নজর দিতে হবে।
এমত অবস্থায়, সকল অধ্যাত্মমণ্ডিত হৃদয় ও মনের ব্যক্তি নিজেদেরকে প্রশ্ন করে, আমি সাহায্যের জন্য কি করতে পারি? এই পৃথিবীতে আমাদের সবারই বিভিন্ন প্রতিভা ও যোগ্যতায় আলাদা আলাদা ভূমিকা পালন করার আছে; এর মানে আমরা যে কোনও সময়ে মানবজাতির সামনে আসা নির্দিষ্ট সংকট বা সমস্যায় বিভিন্নভাবে অন্যদের সেবাদানের জন্য যোগ্য।
আমি জানি আমাদের অনেক এসআরএফ ও ওয়াইএসএস সদস্যই আছেন যারা ব্যক্তিগত বা বৃত্তিগত প্রতিভার জোরে অথবা শুধুমাত্র উদার সেবা বা সহায়তায় অন্যদের জীবন তথা আমাদের সমাজ ও আমাদের বিশ্বকে উন্নত করতে সাহায্য করছেন। ভগবান তাদের সবাইকে আশীর্বাদ করুন! বিশ্বজুড়ে দারিদ্র দূর করতে, জাতিগত বৈষম্য আর মানুষের অজ্ঞতার অন্যসব পরিণাম দূর করতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে ঈশ্বর আশীর্বাদ করুন।
যদিও একটি বিশেষ পথ যেখানে পরমহংস যোগানন্দের সকল অনুসারী, ধ্যান-ভিত্তিক আধ্যাত্মিক শিক্ষার সকল অনুসারীরা বিশেষভাবে অনুসরণ করে আর করা উচিতও। আর সেটা শান্তিস্থাপকও হয়। ধ্যান অভ্যাসের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে শান্তির বিকাশ ঘটিয়ে আমাদের থেকে বিচ্ছুরিত শান্তির অনুরণন, সম্প্রীতি, প্রার্থনা আর ঈশ্বরের প্রেম আমাদের চারপাশের প্রত্যেকের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সেবা করো।
আমাদের গুরুদেব বারবার জোর দিয়ে বলেছেন, মানবতার মর্মবেদনা এই নাছোড়বান্দা সামাজিক সমস্যার একমাত্র স্থায়ী প্রতিকার আমাদের নিজেদের পরিবর্তনেই আছে, আমাদের নিজেদেরকে আরও শান্তিপূর্ণ, প্রেমময়, ঈশ্বরমুখী মানুষ করে গড়ে তোলার মধ্যে। এব্যাপারে কাজ করা মানেই মূল কারণের সমাধানের পথে হাঁটা। অন্য সবকিছু প্রয়োজনীয় হলেও শুধুমাত্র উপসর্গের নিরসন হয়ে থাকে।
তাই আসুন, এখনই আমরা সবাই একসাথে কিছুটা সময় কাটাই, শান্তির বিকাশ ঘটিয়ে আর চতুর্দিকে তা প্রসারিত করে আমাদের এই আপৎকালের নিরাময়ে অবদান রাখি।
তবে শুধুমাত্র কথাই যথেষ্ট নয়। এই সময় — অনেক মতানৈক্য, শঙ্কা ও ক্রোধের সময় — আমরা একে অন্যকে যাই বলিনা কেন, তার সীমিত প্রভাব থাকে। অনেক সময় এগুলোর নেতিবাচক প্রভাবও থাকে, কারণ খুব সহজেই অন্য মানুষকে বলা আমাদের কথার অপব্যাখ্যা হয়ে থাকে। তবে প্রার্থনা, ধ্যান আর ঈশ্বর সংযোগের সময় হৃদয়ের গভীর থেকে পরমপিতার জন্য আকুল আর্তি — এর শক্তি মানুষের কথোপকথনের যে কোনও গুণের ঊর্ধ্বে।
আমার প্রার্থনা দ্বিমাত্রিক: আমাদের যুগের সহৃদয় সংস্কারকদের — সকল জাতি ও ধর্মের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমন্বয়কারকদের কথা শ্রদ্ধা ও তৎপরতার সাথে আমরা সবাই যেন শুনি এই প্রার্থনা করি। আর তারপর একে অন্যের কথা শোনার অসামান্য আধ্যাত্মিক আচরণ থেকে কথাগুলির মহৎ আদর্শ অনুধাবন করে তা সর্বোত্তমভাবে অনুভবনীয় কাজে বদলে দিয়ে আরোগ্য বর্ধন করি।
তবে, এমনকি এর থেকেও বেশি আমি প্রার্থনা করি, এই বিভেদের সময়ে আমাদের আন্তরিক কথাগুলো যেন ঈশ্বরের কাছে পৌঁছোয়: আমাদের প্রকৃতির যা কিছু শুভ, সত্য ও মহান তার আদি ও উৎস।
আসুন আমরা আবশ্যক সময় নিয়ে আমাদের বলা ও শোনা কথাগুলি গোচরে এনে ধ্যানের অন্তরস্থ নিস্তব্ধতায় পাওয়া শান্তি ও বিচারবুদ্ধির শক্তিকে গ্রহণ করে আত্মার মাঝে প্রয়োজনীয় নিগূঢ়তা খুঁজে নিই। আমাদের একে অপরের সাথে কথোপকথনের পাশাপাশি, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আমাদের কথা ও প্রার্থনা, বর্তমান দ্বন্দ ও বিরোধিতায় আমাদের একে অন্যকে আঘাত করার এই পরিস্থিতিতে তিনি আমাদের প্রতিক্রিয়ার নির্ধারক ও উদ্ভাবক হন।
বর্ণবৈষম্যের প্রতিকারে প্রার্থনা
হে পরমপিতা, জগন্মাতা, সখা, প্রিয়তম ভগবান,
আমেরিকা তথা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া আক্রোশ, ভীতি, মতানৈক্য ও ক্ষোভ তৎসহ বর্ণবৈষম্য ও ভেদাভেদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য কার্যকরী মনোভাবের পথ দেখান।
আমাদের সকলের পরম স্রষ্টা — তোমার সৃষ্ট ভ্রাতা আর ভগিনীস্বরূপ পবিত্র সমধর্মী অপত্য আত্মাদের শেখাও — শ্রবণ, অনুভব আর প্রজ্ঞা-নির্দেশিত কর্মের মাধ্যমে কিভাবে বর্ণবৈষম্যে আক্রান্ত আমেরিকা ও অন্যান্য অনেক দেশে ক্লেশের উপশম করা যায়।
প্রেম, দয়া ও নিরাময়ের হে পরমপিতা, সর্বোপরি ধ্যানের মাধ্যমে ও আমাদের হীন প্রবৃত্তির আত্মসংযমের মাধ্যমে আমাদের সত্তায় তোমার উপস্থিতির সার্বজনীন প্রেমের ধারায় আমরা যেন জাগরিত হয়ে উঠতে পারি; আর আমাদের প্রার্থনায় অবদানের সংকল্পে, নিজেদের পরিবর্তনে আমাদের প্রয়াসে এবং সেইসাথে আমাদের বিশ্বজাগতিক পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মঙ্গল, সমৃদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতিতে আমাদের জন্য উপলব্ধ যা কিছু বাহ্যিক সেবা জাগরিত হয়ে ওঠে।
ওম। শান্তি। আমেন।
[স্বামী চিদানন্দজির পরিচালনায় একটি ধ্যানসভা।]
কর্মফল জনিত সমস্যার সমাধান
প্রিয় বন্ধুগণ, আমাদের মনে রাখতে হবে: আরোগ্য পেতে হলে শুধুমাত্র উপসর্গ নয়, সমস্যার কারণের সত্যতা স্বীকার করে তা নিরসনে আমাদের আধ্যাত্মিক পূর্ণতার সন্ধান করতে হবে।
আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনচক্র কর্মের নিয়ম মেনে চলে। আর বর্তমানের সকল আলোড়ন সত্যসত্যই গভীর অন্তর্নিহিত কারণের লক্ষণ। আমি বলব আমাদের কেউই এগুলো ছোট ভাবার বা যুক্তি দিয়ে বিচার করার ভুল করবেন না। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে বা সমাজে গেঁড়ে বসে থাকা যে কার্মিক অবস্থা, আমরা তাদের সমাধান না করা পর্যন্ত তারা দূরীভূত হবে না, তাদের কাজ সম্পূর্ণ করুন আর তারা আমাদের যা শেখাতে চায় সেই অধ্যাত্ম শিক্ষা নিন।
আমাদের গুরুদেব পরমহংস যোগানন্দ আমেরিকাকে ভালোবাসতেন। তিনি প্রায়ই এর ভবিতব্য সম্বন্ধে বলেছেন। তিনি বলেছেন, বহুজাতিক পরিজনবর্গের উর্ধ্বগামী ক্রমবিকাশে আমেরিকার এক বিশেষ ভূমিকা ছিল, আর বিশ্বের জন্য তার সব ভালো কাজের ফলে অসাধারণ সুকর্মও আছে। তাহলেও, আফ্রিকান আমেরিকান ও আমেরিকান আদিবাসীদের সাথে এই গোষ্ঠীর লজ্জাজনক আচরণের ইতিহাসের কারণে সৃষ্ট বেদনাদায়ক কার্মিক পরিণতির কথা তিনি আত্মিক দর্শনশক্তির দূরদর্শিতায় স্পষ্টভাবে বলেছেন। শুধুমাত্র আমেরিকানরা সর্বশ্রেষ্ঠ ও উদার গুণে পূর্ণ বিকশিত হোক অথবা একজন কৃষ্ণাঙ্গ বিদেশী হিসাবে তাঁর নিজের অবমাননার অভিজ্ঞতার জন্যই নয়, বরং মানবজাতির জন্য তাঁর খ্রিস্টতুল্য প্রেমের কারণে এবং তাঁর ঐশ্বরিক উপলব্ধি ও পরমপিতায় তাঁর দৃঢ়প্রত্যয়ের কারণে, তিনি তাঁর পরিগৃহীত দেশকে এই কদর্যতা অতিক্রম করতে সহায়তা করার মহৎ দায়িত্ব অনুভব করেছেন — শুধুমাত্র বাহ্যিক ধর্ম-নিরপেক্ষতা বা সামাজিক সংস্কারসাধনে নয়, এই সমস্যার মূল সমাধান আধ্যাত্মিকতায় নিহিত আছে।
এবার তাঁর জ্ঞান ও প্রেরণাদায়ক আবেশপূর্ণ বার্তা দিয়ে শেষ করতে চাই। এই বার্তার মাঝে অধ্যাত্ম শক্তি অনুধাবন করুন আর আমাদের জন্য, আমাদের বিশ্বজোড়া সমস্ত জাতির ভাই বোনদের জন্য আমাদের প্রত্যেকের মাঝে আশা ও সম্ভাবনার নতুন বোধের সাথে সেই প্রেমের শক্তি সঞ্চারিত হোক।
তিনি বলেছেন:
“যখনই আমরা ধ্যানে ঈশ্বরপ্রেম শিখবো, নিজের পরিজনকে যেমন ভালোবাসি, সেভাবেই সমগ্র মানবজাতিকে ভালোবাসতে পারব। আত্ম-উপলব্ধির মাধ্যমে ঈশ্বরের খোঁজ যাঁরা পেয়েছেন — যাঁরা ঈশ্বরকে প্রকৃতই উপলব্ধি করেছেন — তাঁরাই মানবজাতিকে ভালোবাসতে পারেন; উদাসীনভাবে নয় বরং একই পিতার সন্তান, আপন রক্তের সম্পর্কের ভাই হিসাবে।”

“উপলব্ধি করো একই রক্ত সমস্ত জাতির শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। যে জাতিরই হোক না কেন, যখন পরমাত্মা সকলের মধ্যে প্রাণবন্ত ও ব্যক্ত, কিভাবে একজনের অপর একজন মানুষকে ঘৃণা করার ধৃষ্টতা থাকতে পারে? মাত্র কিছু বছরের জন্যই আমরা আমেরিকান বা হিন্দু অথবা অন্য কোনো জাতীয়তার, তবে আমরা চিরকালের জন্যই ঈশ্বরের সন্তান।”

“তোমার নিজের মধ্যে ঈশ্বরের সাথে সংযোগ করে দেখো, তুমি জানতে পারবে সবার মাঝেই তিনি আছেন, তিনিই সব জাতির মধ্যে সন্তান হয়ে আছেন। তাই তুমি কারোরই শত্রু হতে পারো না। সমস্ত বিশ্ব যদি বিশ্বজনীন প্রেমকে আপন করে নিত, মানুষের একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্রসজ্জার দরকার হোত না। আমাদের নিজেদের খ্রিস্টসুলভ দৃষ্টান্তের মাধ্যমে সকল ধর্ম, সকল দেশ, সকল জাতির মধ্যে ঐক্য আনতে হবে।”

তাহলে বন্ধুরা, এই বার্তা থেকে উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলা আমাদের সাধ্যের মধ্যেই আছে জেনে সেই কামনাই করব। যেমন আমরা প্রতিদিন ঈশ্বরের ধ্যান করতে থাকব, প্রার্থনায় ও প্রার্থনা-নির্দেশিত কাজে শান্তি ও প্রেমের যথাযথ অনুভূতিকে সারা বিশ্বে সঞ্চারিত করে দেব।
ঈশ্বর আপনাদের সবাইকে আশীর্বাদ করেন, ভালোবাসেন।