নিম্নলিখিত পোস্টটি “ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিপথ” শীর্ষক আলোচনার একটি উদ্ধৃতাংশ, যা পরমহংস যোগানন্দের কালেক্টেড টক্স অ্যান্ড এসেজ-এর চতুর্থ খণ্ড সলভিং দ্য মিস্ট্রি অফ লাইফ-এ সম্পূর্ণভাবে পাঠ করা যাবে — এই বইটি যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক শীঘ্রই হার্ডব্যাক, পেপারব্যাক এবং ইবুক সংস্করণে প্রকাশিত হবে।

কে এই মহাজাগতিক প্রাচুর্যের ভাণ্ডার সৃষ্টি করেছেন, যেখানে অজস্র রূপ মহাবিশ্বকে সজ্জিত করতে এবং পৃথিবীতে প্রাণ সঞ্চার করতে একের পর এক খেলা করছেন?
যখন আমরা একটি ঘড়ির কার্যপ্রণালী দেখি, তখন বুঝতে পারি যে মানুষই তার জটিল অংশসমূহ তৈরি করেছে এবং একত্রে জোড়া দিয়েছে। কিন্তু যখন আমরা এক টুকরো ঘাসে ঢাকা উঠোন দেখি, তখন প্রশ্ন করি, “বীজে সেই শক্তি কে স্থাপন করেছে, যা মাটিকে সবুজ ঘাসে ভরিয়ে তুলেছে?” আর এই সৃষ্টির আশ্চর্য রহস্য দেখবার জন্য কে আমাদের সৃষ্টি করেছেন? স্রষ্টা নিজেকে আড়ালে রেখেছেন, যেন কোনো একদিন আমরা তাঁকে খুঁজে বের করি…।
ঈশ্বরের গুপ্ত উপস্থিতিকে আবিষ্কার করতে হলে, তোমাকে অবশ্যই তাঁকে ভালোবাসতে হবে; কিন্তু তখন আমার মনে হল ঈশ্বরকে না জেনে তুমি কীভাবে তাঁকে ভালোবাসবে? তুমি এমন কিছু কখনোই ভালোবাসতে পারো না যা তোমার অজানা। তুমি কি কখনো এমন এক ফুলকে ভালোবাসতে পারো যাকে তুমি কখনো দেখোনি? তুমি কি সাগরকে ভালোবাসতে পারো যদি তা তোমার কাছে কেবল একটি শব্দ হয়? তুমি কি কাউকে ভালোবাসতে পারো যদি তার সম্পর্কে কখনো কিছু শোনোনি বা জানো না? তুমি কি এমন কাউকে বন্ধু হিসেবে ভালোবাসতে পারো যার সঙ্গে তোমার কখনো দেখা হয়নি? তুমি কি এমন কিছু ভালোবাসতে পারো যার সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই? তাহলে, ঈশ্বরকে ভালোবাসা কীভাবে সম্ভব, যাঁকে কখনো দেখোনি? আমি আর তা কখনই বলতে পারি না। আমি তাঁকে সর্বদা দেখি। তুমি এই মুহূর্তে যে প্রতিটি চিন্তা করছ, আমি সেগুলোও সেই জ্যোতি থেকেই নির্গত হচ্ছে বলে দেখি।
যখন তুমি কোনো পাহাড়চূড়া থেকে শহরের ঝিকিমিকি আলো দেখো, কতই না সুন্দর তা, তখন ভুলে যাও যে সেই বাতিগুলোকে আলোকিত করছে এক ডায়নামো যা তাদের তড়িৎ শক্তি যোগাচ্ছে। তেমনই, যখন তুমি মানুষের মধ্যে প্রাণবন্ত সজীবতা দেখো কিন্তু জানো না কী তাকে প্রাণবন্ত করে তুলছে, তখন তুমি আধ্যাত্মিকভাবে অন্ধ। সেই শক্তি, যদিও চোখে দেখা যায় না, তবু অত্যন্ত স্পষ্ট। তা সব সময় আমাদের চিন্তার আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। ঈশ্বর নিজেই যেহেতু গোপনে থাকতে চান, সেই কারণেই তাঁকে নিয়ে ভাবা এবং তাঁকে ভালোবাসা এত কঠিন হয়ে পড়ে।
পরস্পরবিরোধী সত্যটি হল — ঈশ্বরকে জানার সবচেয়ে সহজ উপায় হল ভালোবাসার পথ। তাঁকে জ্ঞানমার্গের (জ্ঞান যোগ) দ্বারা জানা যায়: যেখানে বিবেক যুক্ত বিচারের মাধ্যমে যা কিছু ঈশ্বর নন, তা পরিত্যাগ করতে হয় — “নেতি, নেতি,” এটি নয়, ওটিও নয়। নিজেকে শুদ্ধ করার আর একটি উপায় হল, কেবল সৎ কর্ম সম্পাদন করা এবং তার ফল ত্যাগ করা (কর্মযোগ)।
আরও একটি পথ আছে যা ভক্তির পথ (ভক্তিযোগ), যেখানে সাধক নিরন্তর ঈশ্বরকে ভাবতে ভাবতে শেষপর্যন্ত সমস্ত কিছুতেই তাঁকে দেখতে পায়। যদি আমরা ভক্তির দৃষ্টিতে খুঁজি, তবে ঈশ্বর ততটাই প্রতীয়মান। আমাদের তাঁকে জানাতে হবে যে আমরা তাঁকে চাইছি, যাতে তিনি আর আমাদের থেকে লুকিয়ে থাকতে না পারেন। যদি আমরা আমাদের চিন্তায়, আমাদের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় তাঁকে চাপ দিই, তবে তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে বাধ্য; তিনি সাড়া দিতে বাধ্য।
ঈশ্বরের উপস্থিতি এতটাই কাছাকাছি; যেন কেউ অন্ধকার ঘরে তোমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। তুমি তাকে দেখতে পাও না, তবু অনুভব করো যে সে যেন ঠিক তোমার আশেপাশেই আছে। ঈশ্বরও ঠিক তেমনই, কেবল তোমার চোখের অজ্ঞানতার দৃষ্টির ওপাশেই তিনি আছেন। তিনি জ্ঞানী ব্যক্তির মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন মহাপুরুষদের মাধ্যমে — যেমন খ্রিস্ট, কৃষ্ণ ও গুরুগণ।
তিনি আছেন, কিন্তু কোথায় তিনি? এই প্রশ্নের উত্তর ভক্তি দেয়: তোমরা তাঁকে না দেখেও তাঁর ভক্ত হতে পারো। ভক্তির অর্থ তুমি জানো, তিনি তোমার সর্বত্র বিরাজমান, মহাবিশ্বের অন্ধকার ধাঁধার মধ্যে তোমার সঙ্গে এক ঐশ্বরিক লুকোচুরির খেলা খেলছেন। তৃণলতার আড়ালে, বাতাসের পেছনে, সূর্যের উষ্ণ কিরণের পেছনে — তিনি লুকিয়ে আছেন, কিন্তু তিনি সেখানে আছেন। তিনি বহু দূরে নেই; আর সেই কারণেই তাঁকে ভালোবাসা সহজ হয়ে যায়।
ঈশ্বর আমাদের সবচেয়ে বড়ো প্রেমিক যা আমাদের হৃদয় জানতে পারে। তিনি চান আমরা যেন তাঁকে খুঁজি, কারণ তাঁর একমাত্র আকাঙ্ক্ষা হল তাঁর সন্তানদের প্রেম লাভ করা। এই সৃষ্টিকে তিনি প্রকাশ করেছেন তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল আমাদের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। তিনি নিজেই সমস্ত কিছুতে পরিপূর্ণ, একমাত্র আমাদের প্রেম ছাড়া। তিনি আমাদের মুক্ত ইচ্ছা দিয়েছেন যে, আমরা চাইলে তাঁকে ভালোবাসতে পারি, চাইলে না-ও পারি। কিন্তু তিনি আমাদের খুব ভালোবাসেন। এই কারণেই তিনি তাঁর সন্তদের পাঠান তাঁর কাছে ফিরিয়ে আনার পথ দেখানোর জন্য।