শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দের লেখা থেকে সংকলিত
- এত যুদ্ধ আর এত প্রাকৃতিক বিপর্যয় কেন?
- ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে নিরাপদ ও নির্ভয় হও
- দুঃসময়ে ভগবানের স্নেহপূর্ণ পথনির্দেশের ওপর নির্ভর করো
- বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতির প্রতি আমাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে?
- পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী আলোছায়ার আড়ালে ঈশ্বরের চিরন্তন প্রেমের সন্ধান করো
- আরও জানতে হলে
এত যুদ্ধ আর এত প্রাকৃতিক বিপর্যয় কেন?
প্রকৃতিতে সমূহ ক্ষতি এবং ব্যাপক আঘাত সৃষ্টিকারী সমস্ত আকস্মিক বিপর্যয় “ভগবানের মার” নয়। এই ধরণের বিপর্যয় মানুষের চিন্তা এবং কর্মের ফলেই ঘটে থাকে। যখনই মানুষের ভুল চিন্তাধারা এবং ভুল কর্মের ফলে ক্ষতিকারক স্পন্দন বৃদ্ধি হয় এবং পৃথিবীতে ভালো এবং মন্দ স্পন্দনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় তখনই তুমি বিপর্যয় দেখতে পাবে….
যুদ্ধ নিয়তিনির্দিষ্ট নয়, বরং ব্যাপক বস্তুগত স্বার্থপরতার কারণে সেগুলি ঘটে থাকে। ব্যক্তিগত, শিল্পসংক্রান্ত, রাজনৈতিক এবং জাতীয় স্বার্থপরতা দূর করো — দেখবে কোনো যুদ্ধ থাকবে না।

সারা বিশ্বে এখন যে বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে তা অধার্মিক জীবনযাপনের ফল। ব্যক্তি এবং জাতি যদি ভ্রাতৃত্বের দিব্য আদর্শ, শিল্প সহযোগিতা এবং পার্থিব পণ্য ও অভিজ্ঞতার আন্তর্জাতিক আদানপ্রদান করে জীবনযাপন করতে রাজি থাকে তাহলে তারা সম্পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।

আমি বিশ্বাস করি যে এমন এক সময় আসবে যখন একে অন্যকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারার ফলে পৃথিবীতে আর কোনো ভৌগোলিক সীমা থাকবে না। পৃথিবীকে আমরা আমাদের দেশ বলব; আর ন্যায়বিচার এবং আন্তর্জাতিক সমাবেশের মাধ্যমে মানুষের চাহিদা অনুসারে নিঃস্বার্থভাবে বিশ্বের পণ্যগুলি আমরা ভাগ করে নেব। কিন্তু বলপ্রয়োগের দ্বারা সাম্য আনা যায় না; তাকে হৃদয় থেকে আসতে হবে… আমাদের এখনই নিজেদের দিয়ে শুরু করতে হবে। আমাদের উচিত সেই মহান আত্মাদের মতো হওয়া যাঁরা আমাদের পথ দেখাতে বারবার পৃথিবীতে এসেছেন। তাঁদের শিক্ষা এবং উদাহরণ মতো, যদি আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি এবং স্পষ্টভাবে বুঝি, তাহলে শান্তি আসতে পারে।
জগতের দুঃখকষ্ট দূর করার জন্য টাকা, ঘরবাড়ি, বা অন্য যে কোনো জাগতিক সাহায্যের চেয়েও বেশি কার্যকরী হল ধ্যান করা এবং ধ্যানের মাধ্যমে ভগবানের যে দিব্য চেতনা আমরা অনুভব করি তা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। আমার ভিতরে যা আছে তা হাজার স্বৈরাচারী শাসকও বিনষ্ট করতে পারবে না। প্রতিদিন ভগবানের দিব্য চেতনা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দাও। সমস্ত আত্মাকে তাঁর নিজের কাছে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে মানবজাতির জন্য ঈশ্বরের পরিকল্পনা বোঝার চেষ্টা করো, এবং তাঁর ইচ্ছার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করো।
ঈশ্বর প্রেমস্বরূপ; সৃষ্টির জন্য তাঁর পরিকল্পনার ভিত্তি একমাত্র প্রেমই হওয়া সম্ভব। পাণ্ডিত্যপূর্ণ যুক্তির বদলে এই সহজ চিন্তাটি কি মানব হৃদয়কে সান্ত্বনা দেয় না? প্রতিটি সাধক যিনি সত্যের মূলে প্রবেশ করেছেন, সাক্ষ্য দিয়েছেন যে একটি দিব্য সর্বজনীন পরিকল্পনা বর্তমান, যেটি সুন্দর এবং আনন্দে পরিপূর্ণ।
ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে নিরাপদ ও নির্ভয় হও
জগতের ঝড়ঝাপটায় ভগবানই একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল। “হৃদয়ের সমস্ত ব্যাকুলতা নিয়ে তাঁর আশ্রয় নাও। তাঁর কৃপায় তুমি পরম শান্তি ও চিরস্থায়ী আশ্রয় লাভ করবে।” তাঁর মধ্যে আমি আমার জীবনের আনন্দ খুঁজে পেয়েছি, আরও পেয়েছি আমার অস্তিত্বের অবর্ণনীয় আশীর্বাদ এবং নিজের ভিতরেই তাঁর সর্বব্যাপীত্বের আশ্চর্য উপলব্ধি। আমি চাই যে তোমরা সকলেই এটি পাও।

যেখানে ভগবান আছেন সেখানে না আছে কোনো ভয়, না আছে কোনো দুঃখ — যোগ আমাদের এই শিক্ষাই দেয়। একজন সফল যোগী তাঁর চতুর্দিকে জগত ভেঙে পড়লেও অবিচলিত থাকেন। “প্রভু, যেখানে আমি সেখানেই তোমাকে আসতে হবে” — এই বিশ্বাসে তিনি নিশ্চিন্ত থাকেন।

নির্ভীকতার অর্থ হল ভগবানে বিশ্বাস: তাঁর সুরক্ষায়, তাঁর ন্যায়বিচারে, তাঁর প্রজ্ঞায়, তাঁর করুণায়, তাঁর ভালোবাসায়, তাঁর সর্বব্যাপীত্বে বিশ্বাস….
ভয় মানুষের কাছ থেকে তার আত্মার অদমনীয় স্বভাবকে কেড়ে নেয়। প্রকৃতির ভিতরের ঐশ্বরিক শক্তির উৎস থেকে নির্গত সুসংগত কার্যকলাপকে ব্যাহত করে ভয় শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক ব্যাঘাত ঘটায়…. দুশ্চিন্তায় লিপ্ত না হয়ে মানুষের দৃঢ়তার সঙ্গে বলা উচিত, “তোমার স্নেহের দূর্গে আমি সর্বদাই নিরাপদ।”

তুমি আফ্রিকার জঙ্গলেই থাকো, বা যুদ্ধক্ষেত্রে থাকো বা রোগ-দারিদ্রে জর্জরিত হও, শুধু ভগবানকে এইটুকু বলো আর বিশ্বাস রাখো — “তোমার বিদ্যমানতার রক্ষাকবচ পরে আমি জীবনের যুদ্ধক্ষেত্র পার হচ্ছি। আমি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত।” এছাড়া নিরাপদ থাকার অন্য কোনো উপায় নেই। নিজের সাধারণবুদ্ধির সাহায্য নাও এবং ভগবানের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখো। আমি অদ্ভূত কিছু বলছি না; আমি তোমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি যে, যাই ঘটুক না কেন, এই সত্যে বিশ্বাস রাখো এবং দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলো — “প্রভু, একমাত্র তুমিই আছ যে আমাকে সাহায্য করতে পারে।”

তোমার সমস্ত সমস্যার সমাধানের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করো। হঠাৎ করে তোমার উপর প্রচণ্ড অসুবিধার পাহাড় ভেঙে পড়লেও তোমার সাহস এবং উপস্থিতবুদ্ধি লোপ পেতে দিও না। তোমার অন্তর্জ্ঞানজাত সাধারণবুদ্ধি এবং ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস জাগিয়ে রাখো এবং পরিত্রাণের কোনো না কোনো উপায় খুঁজে বার করার চেষ্টা করো তা যত অসম্ভবই মনে হোক না কেন, তাহলে সেই উপায়টি তুমি খুঁজে পাবে। শেষ পর্যন্ত সব কিছুই ঠিক হবে, কারণ আমাদের পার্থিব অভিজ্ঞতার আপাত বৈপরিত্যের আড়ালে ঈশ্বর তাঁর মঙ্গলটি লুকিয়ে রেখেছেন।
দুঃসময়ে ভগবানের স্নেহপূর্ণ পথনির্দেশের ওপর নির্ভর করো
ভগবানের উপর ভার দাও যেন তিনি তোমার অন্তরাত্মাকে পথ দেখিয়ে ঠিক রাস্তায় নিয়ে যান এবং রক্ষা করেন। জীবনের অন্ধকারময় পথে চলার সময় ভগবানকে তোমার দিশারি আলো করে নাও। তোমার অজ্ঞানতার রাতে তিনিই চাঁদের আলো। জাগ্রত কালে তিনিই তোমার সূর্য। পার্থিব অস্তিত্বের অন্ধকার সাগরে তিনিই তোমার ধ্রুবতারা। তাঁর পথনির্দেশ চাও। জগত এই ভাবেই তার উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলবে। আমরা দিকনির্দেশ কার কাছে চাইব? আমাদের অভ্যাস, আমাদের পরিবার, আমাদের দেশ বা বিশ্বের পরিবেশ থেকে উৎপন্ন আমাদের পক্ষপাতদুষ্ট প্রবণতার কাছে নয়, বরং আমাদের আভ্যন্তরীণ সত্যের কণ্ঠস্বরের কাছে।
প্রতি মুহূর্তে আমি শুধু ভগবানের কথাই ভাবি। আমার হৃদয় আমি তাঁর আশ্রয়ে রেখেছি। আমার আত্মার দায়িত্ব আমি তাঁর হাতে দিয়েছি। আমার ভালোবাসা, আমার ভক্তি আমি তাঁর নিত্যতার চরণে নিবেদন করি। ভগবান ছাড়া কোনো কিছুকে বিশ্বাস কোরো না। এবং তারপর, ঈশ্বরের অভ্যন্তরীণ দিকনির্দেশনার সাহায্যে তাদের উপর আস্থা রাখো যারা তাঁর আলো প্রকাশ করে। সেই আলোই আমার পথের দিশারি। সেই আলোই আমার প্রেম। সেই আলোই আমার প্রজ্ঞা। এবং তিনিই আমাকে বলেন কিভাবে তাঁর ধর্মের জয় হচ্ছে, এবং সর্বদা হবে।
আমি এই যুদ্ধ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করতাম। কিন্তু অনেক শান্তি পেলাম যখন এই প্রার্থনা করলাম – “ভগবান, আমি বিচার করার কেউ নই। তুমিই মানুষ এবং জাতির বিচারক। তুমি সকলের কর্ম সম্বন্ধে অবহিত। এবং তোমার নির্ণয়ই আমার ইচ্ছা।” এই চিন্তা আমার ভারতবর্ষের জন্য উদ্বেগও দূর করে দিল, কারণ আমি জানি ঈশ্বর তাকে রক্ষা করবেন। আমাদের অবশ্যই ভগবানের সিদ্ধান্তের উপর আরও নির্ভর করতে শিখতে হবে। আর সেই সিদ্ধান্তটি জানা যায় বিশ্বনাটকের প্রতিটি অঙ্ক শেষ হওয়ার পর। যুদ্ধের সময় তাঁর বিচার হয়তো বোঝা যাবে না; কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমরা দেখতে পাব যে এই সংঘর্ষে তাঁর হাত ছিল। এর অব্যবহিত ফলাফল এবং এরপর যা ঘটবে, তা প্রতিটি জাতি এবং সেই জাতির প্রতিটি ব্যক্তির প্রারব্ধ কর্ম অনুসারে তাঁর বিচার অনুসারেই হবে। এই যুদ্ধের আগুন থেকে বেরিয়ে আসবে এক উন্নততর পৃথিবী। মনে রেখো – পাশবিক শক্তি শেষ পর্যন্ত কখনই বিজয়ী হয় না। এই যুদ্ধে তুমি সেটাই দেখবে। ধর্মেরই জয় হবে।
বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতির প্রতি আমাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে?
বিশ্বে এখন যে সংকট দেখা দিয়েছে তার কারণ আমরা এখন দ্বাপর যুগে প্রবেশ করছি; জগতের উন্নতির জন্য অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে হবে। অশুভ শক্তিগুলি নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনবে, ফলে ন্যায়নিষ্ঠ জাতিগুলির বেঁচে থাকা নিশ্চিত হবে। ইতিহাসের গোড়া থেকেই ভালো এবং মন্দের দ্বন্দ চলে আসছে। কিন্তু দ্বাপর যুগ, যা এক বৈদ্যুতিক বা পারমাণবিক যুগ, তার মধ্য দিয়ে পৃথিবী যখন উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে, তখন কেবলমাত্র ভালোর সম্ভাবনা বেশী তা নয়, লোভী এবং ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তিদের দ্বারা প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে ধ্বংসের সম্ভাবনাও বেশি। দ্বাপর যুগের প্রভাবের সাথে তাল মিলিয়ে, প্রযুক্তি দ্রুত সাধারণ জনগণকে সাফল্যের উচ্চ স্তরে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই অগ্রগতি কৃতকার্য এবং অকৃতকার্যদের মধ্যে একটি বৃহত্তর ব্যবধান তৈরি করে। এটি ঈর্ষার সৃষ্টি করে এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাকেও প্ররোচিত করে।
আমি পারস্পরিক ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং সহযোগিতার উপর আধারিত মানব ভ্রাতৃত্ববোধে বিশ্বাস করি। সমস্ত অনুসরণযোগ্য লক্ষ্য এবং মহৎ আদর্শকে আধ্যাত্মিক উদাহরণ এবং উত্তম পদ্ধতির মাধ্যমে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা উচিত, জোরজবরদস্তি বা যুদ্ধের মাধ্যমে নয়। আধ্যাত্মিক নীতি ছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতা বিপজ্জনক। আধ্যাত্মিক নীতি বলতে আমি নির্দিষ্ট ধর্মের মতবাদগুলিকে বোঝাচ্ছি না — যা বিভেদ সৃষ্টিকারীও হতে পারে — বরং ধর্ম বা ন্যায়ের সর্বজনীন নীতিগুলিকে বোঝাচ্ছি যা সমগ্র মানবতার কল্যাণের জন্য প্রযোজ্য। অশুভশক্তির বিস্তার রোধ করার জন্য, কখনও কখনও ধর্মযুদ্ধেরও প্রয়োজন হতে পারে। তুমি বনের বাঘকে অহিংসা এবং সহযোগিতার কথা বোঝাতে যেয়ো না, কারণ তুমি তোমার দার্শনিক ব্যাখ্যা শুরু করার আগেই সে তোমাকে শেষ করে দেবে। তেমনই কিছু কিছু অপরাধীকেও যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝানো যায় না। হিটলারের মতো যারা আগ্রাসী যুদ্ধ চালায়, তারা পরাজিত হয়। যারা অশুভশক্তির বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ লড়তে বাধ্য হয়, তারাই জয়ী হয়। যুদ্ধ ন্যায্য কিনা তা ঈশ্বর বিচার করেন।

আমি এখন একটি ভবিষ্যদ্বাণী করছি — পৃথিবী ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে না। সুতরাং ভয় পেয়ো না। পরমপিতার উপর আস্থা রাখো। তাঁর আদর্শগুলি মনে রাখলে এবং তাঁর উপর বিশ্বাস রাখলে তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন। আমরা উন্নতির দিকে চলেছি। বস্তুগত যুগ, অর্থাৎ কলিযুগের ১২০০ বছর গত হয়েছে, আর পারমাণবিক যুগ, অর্থাৎ দ্বাপরযুগের ২৪০০ বছরের মধ্যে ৩০০ বছর পেরিয়ে গেছে। এর পরে মানসিক এবং আধ্যাত্মিক যুগ, অর্থাৎ ত্রেতা ও সত্যযুগ আসবে। আমরা অবনতির দিকে যাচ্ছি না। যাই হোক না কেন, ঈশ্বরের জয় হবে। আমি এই ভবিষ্যদ্বাণী করছি… যে আগ্রাসনের উদ্দেশ্যে বোমা ব্যবহার করবে, সে বোমার ঘায়েই মরবে; কিন্তু আমি জানি ভারত বা আমেরিকাবাসীদের হৃদয়ে হিংস্রতার কোনো স্থান নেই। যেমন এত শক্তি থাকা সত্যেও হিটলারের পতন ঘটল, তেমনই যে কোনো স্বৈরাচারী শাসক, সে যেখানেই থাকুক না কেন, তার পতন হবে। এটি আমার ভবিষ্যদ্বাণী।

আমার বিশ্ববাসী ভাই ও বোনেরা: মনে রেখো যে ঈশ্বর আমাদের পিতা এবং তিনি এক। আমরা সকলেই তাঁর সন্তান, এবং তাই আমাদের একে অপরকে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে এক বিশ্ব-যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শ নাগরিক হতে গঠনমূলক ভাবে সাহায্য করা উচিত…
যখন প্রতিটি মানুষ প্রকৃত আধ্যাত্মিক উপলব্ধি দ্বারা ক্ষুদ্র বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে আসবে, তখন ঈশ্বরের সার্বজনীনতা এবং মানুষের ভ্রাতৃত্ববোধের উপলব্ধির আগুনে বিশ্বের দুর্দশা ভস্মীভূত হবে।
রেডিও, টেলিভিশন এবং বিমান যাত্রা আমাদের সকলকে আগের চেয়ে অনেক বেশি কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া, ইউরোপীয়দের জন্য ইউরোপ, আমেরিকানদের জন্য আমেরিকা ইত্যাদি যে আর থাকতে পারে না তা আমাদের শিখতে হবে, পরিবর্তে ঈশ্বরের অধীনে এক বিশ্ব-যুক্তরাষ্ট্র হতে পারে, যেখানে প্রতিটি মানুষ দেহ, মন এবং আত্মার পরিপূর্ণতার সব রকমের সুযোগ পাবে এবং বিশ্বের একজন আদর্শ নাগরিক হতে পারবে।
পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী আলোছায়ার আড়ালে ঈশ্বরের চিরন্তন প্রেমের সন্ধান করো
এই পৃথিবীর যত বৈষম্য এবং বিভাজন কোনো মানুষ, কোনো মহাত্মাই, কখনো তা মুছে ফেলতে পারবেন না। কিন্তু যখন তুমি নিজেকে ঈশ্বরের চেতনার মাঝে দেখবে, এই বৈষম্যগুলি মিলিয়ে যাবে, আর তুমি বলবে:
আহা এ জীবন মধুর, মরণ স্বপন এক, যখন নিজের ভিতর বয় তোমার গান। তখন হরষ মধুর, বিষাদ স্বপন এক, যখন নিজের ভিতর বয় তোমার গান। তখন স্বাস্থ্য মধুর, ব্যাধি স্বপন এক, যখন নিজের ভিতর বয় তোমার গান। তখন প্রশংসা মধুর, নিন্দা স্বপন এক, যখন নিজের ভিতর বয় তোমার গান।
এটিই সর্বোচ্চ দর্শন। কোনো কিছুতেই ভয় পেয়ো না। এমনকি যখন ঝড়ে ঢেউয়ের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছ, তখনও তুমি সমুদ্রের বুকেই আছ। সবকিছুর মধ্যে ঈশ্বরের অন্তর্নিহিত উপস্থিতির চেতনাটি সবসময় ধরে রাখো। সব পরিস্থিতিতে মন শান্ত রাখো, আর নিজেকে বলো: “আমি নির্ভীক; আমি ভগবদবস্তু দিয়ে গড়া। পরমাত্মা-অগ্নির আমি এক স্ফুলিঙ্গ। মহাজাগতিক শিখার আমি এক পরমাণু। পরমপিতার অসীম বিশ্ব-শরীরের আমি একটি কোশ। ‘আমি এবং আমার পিতা অভেদ।’”

নিজেকে শুধু ভগবানের পায়ে সঁপে দাও। তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করার এর থেকে আর ভালো সময় নেই….ভগবানকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তোমার সমস্ত আত্মশক্তি প্রয়োগ করো…. তাঁর এবং আমাদের মাঝখানে মায়ার ধূম্রজাল এসে পড়েছে, এবং আমরা যে তাঁকে ভুলে গেছি এতে তিনি খুবই দুঃখিত। নিজের সন্তানদের এত দুঃখ — বোমা পড়ে মারা যাওয়া, ভয়ানক রোগ, জীবনযাপনের নানা বদভ্যাস — দেখে তিনি মোটেই খুশি নন। তিনি অনুতপ্ত, কারণ তিনি আমাদের ভালোবাসেন এবং আমাদের ফিরে পেতে চান। শুধু যদি তুমি রাতে ধ্যান করার এবং তাঁর সাথে থাকার চেষ্টা করতে! তিনি তোমার কথা এত ভাবেন। তুমি পরিত্যক্ত নও। তুমিই তোমার আত্মাকে পরিত্যাগ করেছ। ভগবান কখনোই তোমার প্রতি উদাসীন নন….
সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য হল তোমাকে তার রহস্যের সমাধান করতে এবং সবকিছুর পিছনে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে বাধ্য করা। তিনি চান তুমি অন্য সব কিছু ভুলে যাও এবং কেবল তাঁকেই খোঁজো। একবার প্রভুর আশ্রয় পেয়ে গেলে, জীবন ও মৃত্যুর সত্যতার কোনো সচেতনতা আর থাকে না। তখন তুমি সকল দ্বৈততাকে ঘুমে স্বপ্নের মতো ঈশ্বরের চিরন্তন অস্তিত্বের মাঝে আসা-যাওয়া করতে দেখতে পাবে। এই উপদেশটি ভুলে যেয়ো না — আমার মুখ দিয়ে যা তিনি তোমাদের কাছে প্রকাশ করছেন। ভুলে যেয়ো না! তিনি বলছেন:
“আমি তোমার মতোই অসহায়, কারণ তোমার আত্মারূপে আমি তোমার দেহের সাথে বাঁধা। যতক্ষণ না তুমি নিজের আত্মাকে উদ্ধার করছ, আমি তোমার সাথে খাঁচায় বন্দি। আর ইতস্তত কোরো না; দুর্দশা আর অজ্ঞতার কাদায় মুখ গুঁজে থেকো না। এসো! আমার আলোয় স্নান করো।”

ঈশ্বর চান আমরা এই মায়ার জগত থেকে মুক্তি পাই। তিনি আমাদের জন্য কাঁদেন, কারণ তিনি জানেন যে উদ্ধার পাওয়া কতটা কঠিন। কিন্তু তোমাকে শুধু মনে রাখতে হবে যে তুমি তাঁর সন্তান। হতাশ হয়ো না। ঈশ্বর, জিশু বা কৃষ্ণকে যতটা ভালোবাসেন, তোমাকেও ততটাই ভালোবাসেন। তোমাকে তাঁর ভালোবাসার সন্ধান করতে হবে, কারণ তার মধ্যে শাশ্বত স্বাধীনতা, অফুরন্ত আনন্দ এবং অমরত্ব রয়েছে।

এই জগতের ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ো না। ঈশ্বরের শাশ্বত আলোয় জেগে ওঠো! এমন এক সময় ছিল যখন জীবন আমার কাছে এক ভয়াবহ সিনেমা দেখার মতো ছিল যা আমি অসহায়ভাবে দেখছিলাম, আর আমি সেই সিনেমার বিয়োগান্ত নাটকগুলিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলাম। তারপর, একদিন যখন আমি ধ্যান করছিলাম, তখন আমার ঘরে এক বিরাট আলোর আবির্ভাব হল এবং আমি ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর শুনলাম: “তুমি কী স্বপ্ন দেখছো? দেখো আমার চিরন্তন আলো, যার মধ্যে জগতের অনেক দুঃস্বপ্ন আসে আর যায়। তারা সত্য নয়।” সে এক অসাধারণ সান্ত্বনা ছিল! দুঃস্বপ্ন, যতই ভয়াবহ হোক না কেন, কেবল দুঃস্বপ্নই। সিনেমা, তা উপভোগ্য হোক বা বিরক্তিকর, কেবল সিনেমাই। এই জীবনের দুঃখজনক এবং ভয়াবহ নাটকে আমাদের মনকে এতটা ডুবিয়ে রাখা উচিত নয়। অবিনশ্বর এবং অপরিবর্তনীয় সেই শক্তির উপর মনোযোগ দেওয়াই কি আমাদের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ নয়? এই বিশ্ব-সিনেমার গল্পের অপ্রীতিকর চমক সম্পর্কে কেন চিন্তা করবে! আমরা এখানে কেবল কিছুক্ষণের জন্য এসেছি। জীবননাট্যের পাঠগুলি শেখো এবং নিজের স্বাধীনতা খুঁজে নাও।

এই জীবনের ছায়ার ঠিক আড়ালেই ঈশ্বরের আশ্চর্য আলো রয়েছে। এই মহাবিশ্ব তাঁর বিদ্যমানতার এক বিরাট মন্দির। যখন তুমি ধ্যান করবে, তখন তোমার জন্য তাঁর কাছে পৌঁছবার সব দরজা খুলে যাবে। তাঁর সাথে যোগাযোগ হলে পৃথিবীর কোনো বিপর্যয়ই সেই আনন্দ এবং শান্তি তোমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। সংকল্পবাক্য: “জীবনে, মরণে, ব্যাধিতে, দুর্ভিক্ষে, মহামারীতে, অথবা দারিদ্রে, আমি যেন চিরদিন তোমাকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে পারি। আমাকে এই বুঝতে সাহায্য করো যে আমি অবিনশ্বর আত্মা — শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য ও জড় জগতের উত্থানপতনের কোনো পরিবর্তনই আমাকে স্পর্শ করতে পারে না।”