যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া শব্দকোশ (প – ফ)

পঞ্চতত্ত্ব: ওঁকারধ্বনি বা প্রণব মানুষের জড়দেহ সহ সমগ্র ভৌতজগতকে পঞ্চতত্ত্বের মাধ্যমে গঠন করে। এই পাঁচটি তত্ত্ব হল: ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম (দ্র)। বোধসম্পন্ন ও স্পন্দনশীল এই শক্তিগুলির প্রকৃতি হল গঠনমূলক। ক্ষিতি বা পৃথ্বী তত্ত্ব ছাড়া কোনো কঠিন বস্তু গঠন করা সম্ভব নয়; তেমনই ‘অপ’ বা জল তত্ত্ব ছাড়া তরল, ‘মরুৎ’ বা বায়ু তত্ত্ব ছাড়া বায়বীয় অবস্থা, ‘তেজ’ বা অগ্নি তত্ত্ব ছাড়া তাপ নির্মাণও সম্ভব নয়। একইভাবে ‘ব্যোম’ বা আকাশ তত্ত্ব ছাড়া এমন কোনো প্রেক্ষাপটও তৈরি করা যায় না, যার ওপর মহাজাগতিক চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা যেতে পারে। প্রাণ সুষুম্নাশীর্ষের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে এবং মেরুদণ্ডের নীচের পাঁচটি চক্রের (দ্র) প্রভাবে পাঁচটি মূল স্রোতে বিভক্ত হয়। এই পাঁচটি চক্রের নাম মূলাধার (ক্ষিতি), স্বাধিষ্ঠান (জল), মণিপুর (অগ্নি), অনাহত (বায়ু) ও বিশুদ্ধ (ব্যোম)। সংস্কৃত ভাষায় এই পঞ্চতত্ত্বের নাম হল: পৃথ্বী, অপ, তেজ, প্রাণ ও আকাশ।

পতঞ্জলি: যোগের সুপ্রাচীন ব্যাখ্যাকার। তাঁর যোগসূত্রে যোগমার্গের তত্ত্বগত রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। পতঞ্জলি যোগমার্গকে আটটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন: (১) যম – নৈতিক আচরণ; (২) নিয়ম – ধর্মীয় আচরণ; (৩) আসন – শরীরের চাঞ্চল্য স্থির করার জন্য সঠিক অঙ্গবিন্যাস; (4) প্রাণায়াম – প্রাণ বা সূক্ষ্ম জীবন প্রবাহকে সংযত করা; (৫) প্রত্যাহার – অন্তর্মুখীনতা; (৬) ধারণা – একাগ্রতা; (৭) ধ্যান ও (৮) সমাধি – অতিচেতনার অনুভূতি।

পবিত্র আত্মা: সৃষ্টির নিজস্ব ভাবের স্পন্দন তৈরি ও বজায় রাখার জন্য ঈশ্বর থেকে নির্গত হওয়া পবিত্র মহাজাগতিক স্পন্দন। এই হল ঈশ্বরের পবিত্র উপস্থিতি, তাঁর বাক্য, বিশ্বজগতে প্রতিটিরূপে সর্বত্র বিদ্যমান, ঈশ্বরের নিখুঁত প্রতিচ্ছবির মাধ্যম, খ্রিস্ট চৈতন্য (দ্র)। সান্ত্বনাদাত্রী, মহাজাগতিক মাতৃ প্রকৃতি, প্রকৃতি (দ্র)। অউম এবং ত্রিত্ব দ্রষ্টব্য।

পরমগুরু: আক্ষরিক অর্থে পরমগুরু বলতে বোঝায় ‘অদ্বিতীয় বা মহান গুরু’; নিজের গুরুর গুরুকেই পরমগুরু বলে। পরমহংস যোগানন্দের শিষ্য যারা, তাদের পরমগুরু হলেন স্বামী শ্ৰীযুক্তেশ্বরজি। আবার পরমহংসজির পরমগুরু হলেন লাহিড়ী মহাশয়। মহাবতার বাবাজি মহারাজ হলেন পরমহংসজির পরম-পরমগুরু।

পরমহংস: একটি আধ্যাত্মিক উপাধি যা কোনো ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ সম্বন্ধেই প্রয়োগ করা হয়। একমাত্র কোনো সদগুরুই তাঁর যোগ্য শিষ্যকে এই উপাধি প্রদান করতে পারেন। পরমহংস শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল ‘সর্বোত্তম রাজহংস’। হিন্দুশাস্ত্রে ‘হংস’-কে আধ্যাত্মিক বিচারবুদ্ধির প্রতীকরূপে গণ্য করা হয়। স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বরজি ১৯৩৫-এ তাঁর প্রিয় শিষ্য যোগানন্দকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন।

পুনর্জন্ম: এই মতবাদ অনুযায়ী মানুষ ক্রমবিকাশ নিয়মের প্রভাবাধীন হয়ে ক্রমশই উন্নততর জীবনে বারবার জন্মগ্রহণ করে — আত্মোপলব্ধি ও ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম না হওয়া পর্যন্ত মানুষ অসৎ কর্ম ও বাসনার দ্বারা পিছিয়ে পড়ে এবং অধ্যাত্ম প্রচেষ্টার দ্বারা এগিয়ে যায়। এইভাবে মানবীয় চেতনার সীমাবদ্ধতা ও অসম্পূর্ণতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হলে আত্মা তার বাধ্যতামূলক পুনর্জন্ম থেকে সম্পূর্ণরূপে বিমুক্ত হয়। “যে বিজয়ী হয়, তাকে আমি আমার দেবতার মন্দিরে একটি স্তম্ভ করে দেব; তাকে কখনই আর বাইরে যেতে হবে না।” (রিভিলেশন ৩:১২,বাইবেল)

প্রকৃতি: মহাজাগতিক প্রকৃতি; সাধারণভাবে আত্মার বুদ্ধিদীপ্ত, সৃষ্টিশীল, কম্পনশক্তি একইসঙ্গে বিশ্বজগতের এবং মানুষের ক্ষুদ্র অস্তিত্বের ত্রিত্ব সত্ত্বাকে (সূক্ষ্ম, কারণ এবং জড়) প্রকাশ করে এবং তাতে পরিণত হয়।

বিশেষভাবে মনোনীত: মহা-প্রকৃতি হল ঈশ্বরের প্রাথমিক নির্গুণ সৃষ্টিশীল বুদ্ধিমত্তা, সৃষ্টিকারী মাতৃ প্রকৃতি বা পবিত্র আত্মা, নিজস্ব সত্ত্বার দিব্য কম্পনের মাধ্যমে যা সমস্ত সৃষ্টিকে মূর্ত করে। পরা প্রকৃতি (শুদ্ধ প্রকৃতি) এবং অপরা-প্রকৃতি (অশুদ্ধ প্রকৃতি) ক্রিশ্চান পরিভাষার সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কে যাকে যথাক্রমে পবিত্র আত্মা এবং শয়তান বলা হয়, সৃষ্টিকারী শক্তি যা সৃষ্টির মধ্যে ঈশ্বরের স্পন্দন রপে বিদ্যমান, ঈশ্বরের সর্বেশ্বরবাদকেই প্রকাশ করে এবং মায়ার অন্ধকার শক্তি ঈশ্বরের পবিত্র সর্বত্র বিদ্যমানতাকে অজ্ঞাত রাখে।

প্রাণ শক্তি: প্রাণ দ্রষ্টব্য।

প্রাণ: পারমাণবিক শক্তির চেয়েও সূক্ষ্ম এমন বোধযুক্ত জীবন গঠনকারী শক্তির স্ফুলিঙ্গ যাদের একত্রে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে ‘প্রাণ’ নামে উল্লেখ করা হয়। পরমহংস যোগানন্দ এদের ইংরেজিতে ‘লাইফট্রনস’ (lifetrons) নাম দিয়ে অনুবাদ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, এই প্রাণই হল ঈশ্বরের ঘনীভূত চিন্তা; সূক্ষ্মলোকের (দ্র) উপাদান এবং ভৌতজগতের মূল জীবনতত্ত্ব। ভৌতজগতে প্রাণ দুই ধরণের: (১) স্পন্দনশীল মহাপ্রাণ যা ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত; এরাই যাবতীয় বস্তুর সৃজন ও পালনকর্তা; (২) প্রতিটি মানবদেহে ক্রিয়াশীল ব্যষ্টি প্রাণ যা পাঁচটি প্রবাহ বা কর্মের মাধ্যমে দেহটিকে পোষণ করে। এদের অন্তর্গত ‘প্রাণ’ বায়ু কেলাসীকরণ, ‘ব্যান’ বায়ু সঞ্চালন, ‘সমান’ বায়ু আত্তীকরণে, ‘উদান’ বায়ু বিপাকীয় কর্মে এবং ‘অপান’ বায়ু নিষ্কাশন কর্মে নিযুক্ত।

প্রাণায়াম: সচেতনভাবে ‘প্রাণ’-এর নিয়ন্ত্রণ (সেই সৃজনশীল স্পন্দন বা শক্তি যা দেহমধ্যে জীবনের ক্রিয়াশীলতা ও পরিপোষণের কারণ)। যে প্রাণক্রিয়া ও ইন্দ্রিয়ানুভূতি মানুষকে দেহচেতনার সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে, তা থেকে সচেতনভাবে মনকে সরাসরি বিচ্ছিন্ন করে আনার বিজ্ঞানসম্মত যোগপন্থাকেই ‘প্রাণায়াম’ বলে। ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের উদ্দেশ্যে ‘প্রাণায়ামই’ মানুষের চেতনাকে মুক্ত করে। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে মিলন ঘটায় এমন সকল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াকেই ‘যোগ’ বলে; আর সেই দিব্য মিলনলাভের সর্বোত্তম পন্থাই হল প্রাণায়াম।

এই শেয়ার করুন