স্মৃতি মন্দির উৎসর্গের রজত জয়ন্তী উদযাপন

১৬ ডিসেম্বর, ২০২০

Celebrating Silver Jubilee of Smriti Mandir Dedication

স্মৃতি মন্দির উৎসর্গ ভিডিও

যোগদা সৎসঙ্গ শাখা আশ্রম, রাঁচিতে শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ স্মৃতি মন্দির উৎসর্গের ২৫তম বার্ষিকী পালন করতে এই বছরটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। মন্দিরটি আশ্রম প্রাঙ্গণের এক পবিত্র স্থানে অবস্থিত যেখানে ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯২০-তে শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ মানসপটে আমেরিকা যাত্রা দর্শন করেন। এই মানস দর্শন সম্বন্ধে পরমহংসজি তাঁর যোগী-কথামৃত (অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি), পুস্তকে লিখেছেন:

“আমেরিকা! আরে এই লোকগুলো দেখছি তো আমেরিকান!” আমার মানসপটে প্রতীচ্যের লোকেদের কতকগুলো মুখের চলমান দৃশ্যপট যেন ভেসে উঠল।

ধ্যান নিমগ্ন মনে, রাঁচি বিদ্যালয়ের ভাঁড়ার ঘরে কতকগুলো ধুলোমাখা বাক্সর পিছনে বসে আছি। ছেলেদের সঙ্গে ওই সকল ব্যস্ত দিনগুলিতে একটি ব্যক্তিগত স্থান খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন ছিল!

দর্শন চলতে থাকল; এক বিরাট জনতা, আমার মুখের দিকে আগ্রহের সঙ্গে তাকাতে তাকাতে আমার চৈতন্যের মঞ্চে অভিনেতাদের মতো একে একে চলে যেতে লাগল।

এই নবযুগ সৃষ্টিকারী মুহূর্ত পরমহংসজির আমেরিকা যাত্রাকে নির্দিষ্ট করেছে এবং পরবর্তীকালে প্রাচীন ক্রিয়া-যোগ বিজ্ঞানের বিশ্বব্যাপী প্রচারের উদ্দেশ্যে সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের প্রতিষ্ঠা করতে পরিচালিত করেছে। দৃশ্যটির বিশদ বিবরণ এবং পরবর্তী ঘটনাবলি পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে যোগী-কথামৃত পুস্তকে বর্ণনা করা আছে। স্মৃতি মন্দির উৎসর্গ অনুষ্ঠানে ওয়াইএসএস/এসআরএফ এর তৃতীয় অধ্যক্ষ এবং সঙ্ঘমাতা শ্রীশ্রী দয়ামাতা বলেছেন, “সত্যের দূত রূপে গুরুদেবকে পাঠাবার জন্যে আমরা আমাদের প্রিয়তম ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। ভগবানের প্রতি গুরুদেবের গভীর ভালোবাসা এবং সম্পূর্ণরূপে পরহিতে তাঁর নিঃস্বার্থ জীবনযাপনের কথা স্মরণ করে আমরা এই শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ স্মৃতি মন্দির উৎসর্গ করলাম।”

শতবর্ষ পূর্বে যে স্থানটিতে পরমহংসজির এই দিব্যদর্শন হয়েছিল, তা ছিল এক ছোট্ট ভাঁড়ার ঘর। দীর্ঘকাল ধরে ওই পবিত্র স্থানে নির্মিত একটি ধ্যান মন্দির প্রাত্যহিক ধ্যানের জন্য ব্যবহৃত হোত। বহু বছরের নিবেদিত পরিকল্পনার পর এই মার্বেল সৌধটি নির্মিত হয়। 

শত শত মোমবাতির আলোয় দিওয়ালির সময় আলোকিত স্মৃতি মন্দির।

মন্দিরটির আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যের গভীরতার সঙ্গে রয়েছে স্থাপত্যশৈলীর অনুপম সৌন্দর্য। আশ্রমের মধ্যমণি রূপে অবস্থিত মন্দিরটির অনাবিল শ্বেতশুভ্র ভাস্কর্য ও সহজাত সাবলীলতায় যে কেউ তৎক্ষণাৎ মুগ্ধ হবে — নীলাকাশের পটে মর্মর গম্বুজ, সৌধটি নানা রঙের ফুলে ও সবুজ তৃণভূমিতে পরিবেষ্টিত। দীপাবলির সময় যখন শত শত মোমবাতি দিয়ে মন্দিরটিকে সাজানো হয়, তখন এ এক অনন্য সাধারণ রাজকীয় রূপ ধারণ করে। প্রতিটি দর্শনার্থী এই মন্দিরের নান্দনিক জাঁকজমক দেখে বিস্মিত হয়, অনুভব করে অপার শান্তি; এই চিত্তাকর্ষক সৌন্দর্যের দিকে একবার না তাকিয়ে কেউ যেতে পারে না। মন্দির অভ্যন্তরে বেদির ওপর গুরুদেবের এক পূর্ণাবয়ব চমৎকার প্রতিচ্ছবি, যেন ভালোবাসা ও প্রাণপ্রাচুর্যে প্রত্যেক দর্শনার্থী ভক্তকে ভরিয়ে দিচ্ছে — যা মন্দিরের প্রবেশদ্বারের ওপরে খোদাই করা — “একমাত্র ভালোবাসাই আমার পরিবর্ত হতে পারে” লেখাটির জীবন্ত সাক্ষ্য। প্রেমাবতার (প্রেমের অবতার) এই কথার মধ্যে সেই দিব্যপ্রেম আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যাতে আমরা নিজেদের জীবনে এই প্রেমের প্রকাশ ঘটাতে পারি।

১৯৯৫-এর ২০-শে মার্চ থেকে ২৬-শে মার্চ পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী স্মৃতি মন্দির সমর্পণ সঙ্গম অনুষ্ঠানে পরমহংস যোগানন্দের সাক্ষাৎ শিষ্য এবং অতীব শ্রদ্ধেয় ওয়াইএসএস/এসআরএফ-এর সন্ন্যাসী স্বামী আনন্দময় গিরি কর্তৃক ১৯৯৫-এর ২২শে মার্চ মার্বেল প্রস্তরে নির্মিত অষ্টভুজাকার এই সুন্দর চিত্রবত মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রায় ১২০০ ভক্ত উপস্থিত ছিলেন। 

Swami Anandamoy in Smriti Mandir, Ranchi
পরমহংস যোগানন্দ স্মৃতি মন্দির উৎসর্গ অনুষ্ঠানে আরতি করছেন স্বামী আনন্দময়।
devotees in Smriti Mandir Dedication, Ranchi
উৎসর্গ অনুষ্ঠানের পর ভক্তগণ মন্দিরে প্রবেশের জন্য বাইরে সারিবদ্ধ ভাবে অপেক্ষমান।

উৎসর্গ অনুষ্ঠানে শ্রী দয়ামাতাজি বলেন, “পঁচাত্তর বছর আগে এই জায়গায় আমাদের পরম প্রিয় গুরুদেবের বিশ্বব্যাপী মিশনকে বাস্তবায়িত করার মানস দর্শনকে যথাযথ মর্যাদা দিতে রাঁচিতে একটি উপযুক্ত স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করবার ইচ্ছে আমাদের ছিল। আজ সেই ইচ্ছে পরিপূর্ণ হল। আজ আমরা সেই দিব্যসত্ত্ব মানবপ্রেমিক মহান গুরু, শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দকে সম্মান জানাই….এই অপূর্ব সুন্দর মর্মর মন্দিরটি এক দৃশ্যমান স্মৃতির স্মারক হয়ে মনে করিয়ে দেবে যে, গুরুদেব এখানে বাস করতেন, এই মৃত্তিকার ওপর চলে ফিরে বেড়াতেন; যাতে মানবজাতি জীবনের প্রকৃত অর্থ জানতে পারে; যাতে আমরাও ঈশ্বরকে ভালোবাসতে পারি, তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাঁর শাশ্বত প্রেম ও নিত্য-নবীন আনন্দে বিভোর হয়ে দিন কাটাতে পারি। এই শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ স্মৃতি মন্দিরটি উৎসর্গ করা হল, যেখানে ভক্তগণ একাকী শান্তভাবে বসে ঈশ্বর ও গুরুদেবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ধ্যান করতে পারে।”

সাধুরা যে স্থানে বাস করেছেন, নিত্য ধ্যান করেছেন, সেটি বিরাট মাহাত্ম্যপূর্ণ পবিত্র এক স্থান, যুগ যুগ ধরে সেখানে তাঁদের স্পন্দন অনুভূত হয়। গুরুদেব বলেছেন, “কোনো যথার্থ আধ্যাত্মিক জায়গায় গেলে তুমি সেখানকার উন্নীত স্পন্দন অনুভব করতে পারবে আর তাতে তোমার আরও বেশি শুভ পরিবর্তন হবে। এটাই মহান সাধুসন্তদের আবাসস্থলে তীর্থযাত্রার মাহাত্ম্য।” এই পবিত্র স্থানে সারা বছর ধরে অগণিত ভক্তের শ্রীগুরু সান্নিধ্যের এক বিশেষ ঐশী অনুভূতি হয়েছে। স্মৃতি মন্দির প্রতিটি অনুসন্ধিৎসু আত্মাকে তার গ্রহণশীলতার মাত্রানুযায়ী সান্ত্বনা, নির্দেশিকা ও দিব্য প্রেমের পরশ দিয়ে থাকে। 

১৯৯৫-তে প্রথম বার যে সকল ভক্ত স্মৃতিমন্দির পরিদর্শনে এসেছিলেন, তাদের কিছু মন্তব্য এখানে দেওয়া হল:

“বহু বছরের পরিচিত আমাদের এই আশ্রমে প্রবেশ করে এত সুন্দর মার্বেল মন্দির দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। স্মৃতি মন্দিরটি স্থাপত্যের এক সুন্দর নিদর্শন। মন্দিরে আমাদের গুরুদেবের সুশোভন ছবিটি খুবই প্রাণবন্ত; তাঁর প্রেমময় দৃষ্টি এই পবিত্র মন্দিরে প্রবেশকারী ভক্তদের ওপর অবিরাম আশীর্বাদ বর্ষণ করছে।”

para-ornament-1-300x10

“এ যেন গুরুদেব আমার সামনে বসে দেখছেন, আমি কেমন ধ্যান করছি।”

para-ornament-1-300x10

“রাঁচিতে আগেও এসেছি, কিন্তু এবার যেন অন্যরকম। কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত অতি সুন্দর মার্বেল পাথরের নির্মাণ, সবদিকের দেওয়ালে জাফরির কারুকার্য; এক বিশাল গম্বুজ এবং চারপাশের স্তম্ভগুলো প্রথম দর্শনেই মনকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। তারপর এক বিশাল প্রতিচ্ছবি — গুরুদেব যেন এইমাত্র আপনাদের অভ্যর্থনা জানাতে এর থেকে বের হয়ে এলেন। আর মন্দিরের স্পন্দন! কি বলব! মনে হয়, গুরুদেব নিজে অবতরণ করে এখানে অবস্থান করছেন।”

যে সকল ভক্ত বহু বছর ধরে রাঁচি আশ্রমে আসছেন, তাদের কিছু মন্তব্য:

“আশ্রম প্রাঙ্গণে পদার্পণ করামাত্র আমার এক অনুভূতি হয় — আমি চিরকাল এখানেরই। যখন আমি স্মৃতি মন্দিরের শান্ত পরিবেশে বসি, কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে মন — আমার গুরুদেব তাঁর স্বদেশের স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে প্রতীচ্যে গেলেন, তাঁর শিক্ষাকে পৃথিবীর মানুষের কাছে ও আমার কাছে পৌঁছে দিতে।”  

para-ornament-1-300x10

“যদি গুরুদেব তাঁর প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের স্কুল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতেন, আর ওই ভাঁড়ার ঘরে তাঁর ওই দর্শন না হত, তাহলে আমরা এই দিনটি দেখতে পেতাম না, যেখানে হাজার হাজার ভক্ত ক্রিয়াযোগের সুফল উপভোগ করছে।” 

para-ornament-1-300x10

“প্রত্যেকবার যখন আমি স্মৃতি মন্দিরে প্রবেশ করি, সব দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ আমার সত্তা থেকে দূর হয়ে যায়।” 

para-ornament-1-300x10

“সংস্থার এই মহান স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার জন্যে কত বিনীত এই স্থান।”

এই শেয়ার করুন