“ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর বিজ্ঞানসম্মত রাজপথ” পরমহংস যোগানন্দ রচিত

৯ই মে, ২০২৫

নিম্নোক্ত লেখাটি “সেল্ফ-রিয়লাইজেশন: নিজের অনন্ত প্রকৃতিকে জানা” শীর্ষক বক্তৃতা থেকে গৃহীত একটি অংশ, সলভিং দ্য মিস্ট্রি অফ লাইফ-এ যা সম্পূর্ণ ভাবে পাঠ করা যাবে। পরমহংস যোগানন্দের নির্বাচিত বক্তৃতা ও রচনার চতুর্থ খণ্ড — যা শীঘ্রই সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ দ্বারা এবং পরে যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া দ্বারা প্রকাশিত হবে।

সমস্ত মহান ধর্মের শিক্ষাই ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যায়; কিন্তু তাদের বহিরঙ্গ আচরণ হল সেই উপপথ, যা অবশেষে সাধককে ধ্যানের একমাত্র অন্তস্থিত রাজপথে নিয়ে আসে।

দেহ ও সীমাবদ্ধ বিশ্ব হতে চেতনার প্রত্যাহার এবং তাকে ঈশ্বরের সঙ্গে একীভূত করাই হচ্ছে মুক্তির একমাত্র পথ। জিশু ধ্যান করতেন। জনসাধারণকে তিনি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সত্য শিক্ষা দিতেন — যা ঈশ্বরের পথে প্রথম প্রয়োজনীয় ধাপ; কিন্তু তাঁর নিকটতম শিষ্যদের তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে প্রকৃত একতার জন্য ধ্যানের উচ্চতর বিজ্ঞান শেখাতেন।

শুধুমাত্র ধ্যানের পদ্ধতি আপনাকে মুক্তি দেবে না; আপনার চরিত্রও হতে হবে দৃঢ় ও নির্মল। আপনার সম্পূর্ণ জীবন ও আচরণ সত্যের নিয়মাবলীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। ধ্যানের যোগপথের প্রথম নিয়মগুলি হল যম ও নিয়ম — যে কাজ আপনার করা উচিত নয়, যা দশটি আজ্ঞার আদেশের অনুরূপ যেমন (“তুমি হত্যা করবে না,” “তুমি মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না,” “তুমি ব্যভিচার করবে না,” ইত্যাদি); এবং কিছু ইতিবাচক আচরণ যা পালন করতে হবে: পবিত্রতা, তিতিক্ষা, আত্মসমীক্ষণ (স্বাধ্যায়), ঈশ্বরভক্তি ও আত্মসংযম।

ধ্যানে অগ্রসর হতে হলে আপনাকে অহংকার, ক্রোধ, লোভ, ঈর্ষা থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য কাজ করতে হবে। মানুষের প্রতি অসৎ হতে পারবেন না; যা আপনি আন্তরিকভাবে অনুভব করেন না, তা বলবেন না। অন্যের থেকে নিজের স্বার্থে কিছু চাইবেন না; যদি আপনার কোনো প্রত্যাশা না থাকে, তবে মানুষ আপনার কাছ থেকে কী নিতে পারবে? কেউ আমাকে আঘাত করতে পারে না, কারণ ঈশ্বর ছাড়া আমার আর কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। আমি কারও প্রতি রাগ পোষণ করি না এবং কেউ আমাকে রাগ দেখিয়ে উত্তেজিতও করতে পারে না। তাই শান্ত, আত্মসংযমী ও আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করুন। অন্যথায়, অন্যায় আচরণ ধ্যানের শুভ ফলকে নিষ্ক্রিয় করে দেবে।

আপনি যে প্রতিটি আধ্যাত্মিক চিন্তা করেন, তা হবে আপনার চিরন্তন বন্ধু। আর আপনি যে প্রতিটি দুষ্ট প্রবণতা গ্রহণ করেন, তা দীর্ঘ সময়ের জন্য আপনার শত্রু হয়ে থাকবে; তা আপনাকে তাড়া করে বেড়াবে যতক্ষণ না আপনি তাকে ধ্বংস করেন। এটা মনে রাখবেন। আমি আপনাদের ধাপে ধাপে ঈশ্বরপ্রাপ্তির উপায়গুলি বলছি। প্রথমে, ভ্রান্ত চিন্তা ও অভ্যাস থেকে নিজেকে মুক্ত করুন। দ্বিতীয়ত, সৎ অভ্যাস গড়ে তুলুন ও সৎ কর্ম করুন।

তৃতীয় ধাপ হল আসন বা সঠিক ভঙ্গি: গভীর ধ্যান করতে হলে শরীর আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে।

এরপর আসে প্রাণায়াম (প্রাণ বা জীবনীশক্তির নিয়ন্ত্রণ), যা দেহ ও মন, শ্বাস ও হৃদস্পন্দন শান্ত করার একটি প্রক্রিয়া। প্রাণায়াম হল আত্মোপলব্ধির প্রারম্ভিক কলা কৌশল। আপনি শ্বাসকে আয়ত্ত না করলে ঈশ্বরকে পাবেন না। শ্বাস মনকে ইন্দ্রিয় জগতের সঙ্গে বেঁধে রাখে। যখন আপনার শ্বাস শান্ত হয়, তখন মন অন্তর্মুখী হয়। শ্বাসহীন অবস্থাই ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথ। প্রাণায়াম অভ্যাস করুন, তাহলে আপনি জানবেন কীভাবে ধ্যান করতে হয় — কীভাবে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে হয় ও তাঁর সঙ্গে একাত্ম হতে হয়।

প্রাণায়ামের মাধ্যমে মন যে অন্তর্মুখী হয়, তাকে বলে প্রত্যাহার। সেটাই হল পরবর্তী ধাপ: চেতনা ইন্দ্রিয়জগত থেকে সরে ভিতরের দিকে বাঁক নেয়। তখনই শুরু হয় প্রকৃত ধ্যান।

যখন মন শ্বাস, দেহ ও বাইরের অনুভূতির বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়, তখন তা একাগ্রভাবে ঈশ্বরের ওপর কেন্দ্রীভূত হতে পারে। এটিকে বলে ধারণা, একাগ্রতা, যা অষ্টাঙ্গ যোগপথের ষষ্ঠ ধাপ। অন্তরের স্থিরতায় আত্মার বলশালী কন্ঠস্বর শোনা যায় — ‘ওম’ শব্দ, শব্দ ব্রহ্ম বা ‘আমেন’ রূপে।

যখন আপনি সেই মহান, শান্তিদায়ক মহাজাগতিক কম্পন শ্রবণ করেন ও তার সঙ্গে একীভূত হন, তখন আপনার চেতনা তার সঙ্গে সর্বত্র বিস্তৃত হয়। এটিই ধ্যান, — ঈশ্বরের বিশালত্বের উপলব্ধিতে ধ্যান।

এবং ধ্যানের একাগ্রতা ও উপলব্ধি যত গভীর হয়, ততই একজন চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছোয় — সমাধি, যেখানে ধ্যানকারী, ধ্যানের প্রক্রিয়া ও ধ্যানের বিষয় (ঈশ্বর) — একীভূত হয়ে যায়। সমাধিতে আপনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জানেন যে ঈশ্বর ও আপনি এক।

ধ্যানই একমাত্র পথ। জিশু শিখিয়ে গেছেন, “অবিরাম প্রার্থনা করো।” এর অর্থ কী? কেবল পাঁচ মিনিট এলোমেলো প্রার্থনা করে উঠে পড়া নয়; বরং আপনার আত্মার ঈশ্বরকে জানার আর্তির যতক্ষণ না উত্তর আসে, ততক্ষণ ধ্যান করা।

সীমাহীন, নিরাকার পরম সত্তা রূপে তিনি নৈর্ব্যক্তিক। তবুও সকলের পিতা-মাতা-মিত্র রূপে সেই জগদীশ্বর অত্যন্ত ব্যক্তিগত। এই রূপেই তিনি আপনাকে উত্তর দেবেন। শুরুতে তিনি নীরব থাকেন; কিন্তু আপনি যদি অবিরাম প্রার্থনা করেন, তবে তিনি আপনাকে উত্তর দেবেন। আমি অনুভব করতে পারছি, আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ সেই স্থানের কাছাকাছি চলে এসেছেন যেখানে তিনি আপনাকে মৃদু স্বরে ডাক দিতে চলেছেন।

ঈশ্বর সাড়া না দেওয়া পর্যন্ত থামবেন না: “তোমাকে আমার সঙ্গে কথা বলতেই হবে, হে জগন্মাতা। তুমি যদি আমার সঙ্গে কথা না বলো, তবে আমি সহস্র মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করব।” যখন তুমি তাঁকে বিশ্বাস করাতে পারবে যে তুমি পুরোপুরি আন্তরিক, তখন তুমি আমার কথার পরিপূর্ণতা অনুভব করবে।

নিজের ধ্যানকে এত গভীর করুন যেন তার প্রভাব সারাদিনের সব কাজের মাঝে অনুভূত হয়। আপনাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তাঁকে খোঁজার সময় না পাওয়ার মতো ব্যস্ত থাকবেন না। আপনি যদি পৃথিবীর রাজাও হন, তাতে কী? আপনি যদি সব দেশকে জয় করে থাকেন, তাতেই বা কী? একদিন আপনি দেখবেন, আপনি মারা যাচ্ছেন এবং অসহায়ভাবে। আপনি কেন পার্থিব বস্তুর মালিক হতে চান? সেগুলো যে কোনো সময় আপনার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যেতে পারে — এবং নিশ্চয়ই তা হবে, যখন আপনি মৃত্যুর দ্বার পেরিয়ে যাবেন। তার থেকে বরং চেষ্টা করুন সেই সত্তাকে জানার, যাকে কেউ কখনো আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। যারা ধ্যান করে না, তাদের কাছে ঈশ্বর অনিশ্চিত; কিন্তু যোগী জানেন, তিনি সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য নিশ্চিত সত্য। এবং “মহান হবে তাঁদের পুরস্কার” যারা তাঁকে খুঁজে পাবেন।

ভারতের মহান যোগীদের মাঝে আমি প্রকৃত সুখ দেখেছি। তাঁদের পার্থিব বাসস্থান হয়তো শুধুমাত্র একটি সাধারণ গুহা; কিন্তু তাঁরা রাজা, ঈশ্বরের আনন্দে হাস্যোজ্জ্বল রাজার রাজা — সমগ্র সৃষ্টির ওপর নিজ ক্ষমতার নিশ্চয়তায় আশ্বস্ত।

অনুভব করুন, ঈশ্বরচেতনা অর্জন করাই আপনার চূড়ান্ত ও সর্বাধিক মূল্যবান লক্ষ্য; আমি আপনাদের সব ধাপগুলি বলছি যাতে আপনারা কিভাবে সেখানে পৌঁছোতে হয় তা জানতে পারেন।

শুধু চুপ করে বসে কয়েকটি প্রার্থনা বললেই ঈশ্বর সাক্ষাৎ হয় না; প্রার্থনা ও ঈশ্বরপ্রেমের আকাঙ্ক্ষা দিয়ে নীরবতাকে মন্থন করতে হয়। এর ফল হবে অপূর্ব। আপনাকে প্রচেষ্টা করতেই হবে: আমি শুধু কথা দিয়ে আপনাদের পেট ভরাতে আসিনি — আমি এসেছি আপনাদের আত্মাকে ঈশ্বরপ্রেমে পুষ্ট করতে।

এই ব্লগ পোস্টে, পরমহংসজি প্রাণায়াম প্রক্রিয়ার গুরুত্বের কথা বলেছেন, যা ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধির জন্য অপরিহার্য। সর্বোচ্চ প্রাণায়াম প্রক্রিয়া ক্রিয়াযোগ বিজ্ঞানের অংশ, যা যোগদা সৎসঙ্গ পাঠমালার ছাত্রদের শেখানো হয়। পরমহংস যোগানন্দ এই ওয়াইএসএস পাঠমালার প্রতিষ্ঠাপন করেন, যাতে তিনি ক্রিয়াযোগ ধ্যানপদ্ধতির ধাপে ধাপে বিস্তারিত নির্দেশনা এবং “কেমন করে জীবনযাপন করতে হয়” ক্রিয়াযোগ ধ্যানবিজ্ঞানের এই নীতিগুলি সম্পূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।

এই শেয়ার করুন