
পরমহংস যোগানন্দের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে নেওয়া
পরমহংস যোগানন্দ লিখেছেন:
ঈশ্বরের চিন্তার সাথে একসুর হয়ে নিত্যতার নির্ভুল চিন্তার হাতুড়ি দিয়ে মায়ারূপী পেরেকটিকে আঘাত করলে তুমি মায়া কাটিয়ে উঠতে পারবে।
অবিনশ্বরতার চিন্তা দিয়ে সমস্ত নশ্বরতার চিন্তা সরিয়ে তাদের নাশ করো।”
পরমহংসজির বক্তৃতা এবং লেখা থেকে নেওয়া এই সংকলনে তির্যক অক্ষরে লেখা অংশগুলি তাঁর “অবিনাশিতার চিন্তাভাবনা” সম্পর্কিত সংকল্পবাক্য এবং আত্মিক উপলব্ধি। এগুলি আপনি নিজের অভ্যন্তরে এবং সমস্ত সৃষ্টিতে পরিব্যাপ্ত শাশ্বত আনন্দময় সত্য সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজে লাগাতে পারেন।
দিবারাত্র, তোমার প্রকৃত সত্তার স্বরূপ দৃঢ়তার সঙ্গে সংকল্প করো
অবিরত নিজেকে এই সত্যটি বলতে থাকো:
আমি সেই পরিবর্তনহীন, আমিই সেই অনন্ত। আমি এক ক্ষুদ্র মরণশীল, ভঙ্গুর অস্থিযুক্ত, নশ্বর দেহধারী প্রাণীমাত্র নই। আমি সেই মৃত্যুহীন, পরিবর্তনহীন অনন্ত।”

যদি কোনো রাজপুত্র মাতাল অবস্থায় বস্তিতে যায় এবং নিজের আসল পরিচয় সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে, “আমি কত গরীব” বলে বিলাপ করতে শুরু করে, তার বন্ধুরা হেসে উঠবে, বলবে, “চোখ খোলো, তুমি এক রাজপুত্র তা কি ভুলে গেছ?” তুমিও সেরকমই এক ভ্রমের মধ্যে আছো, নিজেকে এক সংগ্রামরত, দুঃখী, অসহায়, নশ্বর মানুষ বলে ভাবছ। প্রতিদিন শান্তভাবে বসে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলো:
আমার জন্ম নেই, আমার মৃত্যু নেই, আমার কোনো জাতি নেই; আমার পিতাও নেই, মাতাও নেই। আমিই পরমাত্মা। আমিই সেই অনন্ত আনন্দ।”
তুমি যদি দিনরাত বারবার এই চিন্তাই করতে থাকো, তাহলে তুমি যে আসলে কী তা অবশেষে বুঝতে পারবে — তুমি এক অমর আত্মা।
যে সীমাবদ্ধকারী চিন্তা তোমার প্রকৃত সত্তাকে সুপ্ত রাখে তাদের সরিয়ে দাও
তুমি কে তা নিজেই জানো না এটা কি আশ্চর্য নয়? যে তুমি নিজের সত্তাকেই জানো না? তোমার চেহারা এবং পার্থিব ভূমিকা অনুযায়ী নিজেকে তুমি কতরকম উপাধি দিয়ে থাকো…। তোমাকে নিজের আত্মার থেকে সেই উপাধিকে অবশ্যই খুলে ফেলতে হবে।
“আমি চিন্তা করি, কিন্তু আমি চিন্তা নই। আমি অনুভব করি কিন্তু আমি অনুভূতি নই। আমি ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করি কিন্তু আমি ইচ্ছাশক্তি নই।”
কী পড়ে থাকল? সেই তুমি, যে জানে যে সে আছে; সেই তুমি, যে আত্মার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃশর্ত জ্ঞান বা অন্তর্দৃষ্টি থেকে পাওয়া প্রমাণ থেকে অনুভব করে যে সে আছে

সারাদিন ধরে তুমি সবসময় নিজের শরীর দিয়ে কাজ করছ, তাই তুমি শরীরের সাথে অভিন্নতা বোধ করো। কিন্তু সেই ভ্রম যা তোমাকে বন্দি করে রেখেছে, প্রতি রাতে ভগবান সরিয়ে নেন। গত রাতে, গভীর স্বপ্নহীন ঘুমের মধ্যে তুমি পুরুষ ছিলে না নারী? আমেরিকান, না হিন্দু? গরীব, না বড়োলোক? না, তুমি ছিলে শুদ্ধ আত্মা…। গভীর ঘুমের অর্ধ-অতিচেতনের স্বাধীনতায় ভগবান তোমার সমস্ত জাগতিক উপাধিগুলি সরিয়ে নেন, আর তোমাকে এই অনুভূতি দেন যে তুমি শরীর এবং তার সমস্ত বাধা-বন্ধন থেকে আলাদা—শুদ্ধ চৈতন্য, মহাকাশে বিশ্রামরত। সেই বিরাটত্বই তোমার প্রকৃত সত্তা।

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় এই সত্যটি নিজেকে মনে করাও:
“আমি সবেমাত্র আমার প্রকৃত স্বরূপকে উপলব্ধি করে এসেছি। আমি দেহ নই। আমি দৃষ্টির অগোচর। আমি আনন্দ। আমি জ্যোতি। আমি প্রজ্ঞা। আমি প্রেম। আমি এক স্বপ্ন-দেহে বাস করি যার মাধ্যমে এই পার্থিব জীবনের স্বপ্ন দেখছি; বস্তুত আমি চিরন্তন আত্মা।”
পরাজয়ের সময়ই হল সাফল্যের বীজ বপনের উপযুক্ত মুহূর্ত। পরিস্থিতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেও তুমি তোমার মাথা উঁচু রাখো। যতবারই ব্যর্থ হও না কেন, আবার চেষ্টা করো। যখন মনে হবে আর লড়াই করতে পারছ না তখনও লড়াই করে যাও, অথবা যখন মনে হবে তুমি ইতিমধ্যেই যথাসম্ভব চেষ্টা করে ফেলেছ, বা যতক্ষন না তোমার প্রচেষ্টায় সাফল্য পাচ্ছ, তখনও লড়াই করে যাও।

বিজয়ীর মনোভাব গড়ে তুলতে শেখো। কেউ কেউ উপদেশ দেন — “ব্যর্থতার কথা একেবারেই বলবে না।” কিন্তু শুধু তাতে কাজ হবে না। প্রথমে তোমার অসাফল্য এবং তার কারণগুলি বিশ্লেষণ করো, সেই অভিজ্ঞতা থেকে শেখো, আর তারপর এ নিয়ে চিন্তা করা ছেড়ে দাও। অনেক অসাফল্যের পরেও যে নিজের প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় — যে নিজের অন্তরে অপরাজিত থাকে — সেই সত্যকারের বিজয়ী ব্যক্তি।

জীবন অন্ধকার হতে পারে, প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে, সুযোগের সদ্ব্যবহার করার আগেই তা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে, কিন্তু নিজেকে কখনো বোলো না, “আমি শেষ হয়ে গেছি। ভগবান আমাকে ত্যাগ করেছেন।” এমন মানুষের জন্য কে কি করতে পারে? তোমার পরিবার তোমাকে ত্যাগ করতে পারে, এমন মনে হতে পারে যে তোমার সৌভাগ্যলক্ষ্মী তোমাকে ছেড়ে গেছেন। মানুষ ও প্রকৃতির সমস্ত শক্তি তোমার বিরুদ্ধে দল বাঁধতে পারে; কিন্তু তুমি অতীতের ভুল কর্মজনিত দুর্ভাগ্যের প্রতিটি আক্রমণকে তোমার ভিতরকার ঈশ্বরপ্রদত্ত উদ্যমের গুণে পরাজিত করতে পারো, এবং বিজয়ী হয়ে তোমার বাঞ্ছিত স্থানে পৌঁছোতে পারো।

নিজের আত্মাকে ভগবানের থেকে অবিচ্ছেদ্য বলে জানো
আত্মোপলব্ধি, অর্থাৎ আত্মাকে ভগবানের থেকে নিত্য অবিচ্ছেদ্যরূপে জানাই হল সর্বোচ্চ জ্ঞান…। সেই একক সত্তাই সকল অস্তিত্বের অন্তরতম কেন্দ্রে বর্তমান আছেন। “হে অর্জুন! আমিই সর্বভূতের হৃদয়ে অবস্থিত আত্মা: আমা হতেই তাদের উৎপত্তি, আমাতেই স্থিতি এবং আমাতেই তাদের লয়।” (গড টক্স উইথ অর্জুন: ভগবদগীতা ১০:২০)

সকল মহান গুরুগণ ঘোষণা করেন যে এই দেহের মধ্যেই অবিনশ্বর আত্মা বর্তমান, যা সেই ঈশ্বরেরই একটি স্ফুলিঙ্গ, যিনি সমস্ত সৃষ্টিকে ধারণ করে আছেন। যিনি নিজের আত্মাকে জানেন, তিনি এই সত্যটি জানেন:
“আমি সমস্ত সসীমের পারে…। আমিই নক্ষত্রসকল, আমিই তরঙ্গরাজি, আমিই সর্বভূতে প্রাণ; আমি ফুলের মুখে হাসি এবং প্রতিটি জীবের অন্তরের হাসি। আমিই সেই প্রজ্ঞা ও শক্তি যা সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে ধারণ করে রাখে।”
নিজের দিব্যতার কথা ভাবো, দৃঢ়তার সঙ্গে তা বলো, তাকে উপলব্ধি করো
আমরা দুর্বল মানুষ—যুগ যুগান্তরের এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করো। আমরা যে ঈশ্বরের সন্তান সে কথা আমাদের প্রতিদিন চিন্তা করতে হবে, ধ্যান করতে হবে, দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে নিজেকে বলতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে।

তুমি বলতে পারো “সে তো শুধু এক চিন্তা।” কিন্তু ভেবে দেখো চিন্তা আসলে কি? যা কিছু দেখছ সবই একটি ধারণার পরিণাম…। চিন্তা অদৃশ্য থেকেও সবকিছুকে তাদের বাস্তবতা দেয়। অতএব তোমার চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে তুমি যে কোনো জিনিসকে বাস্তবে ফুটিয়ে তুলতে পারো, তোমার মনঃসংযোগের শক্তি দিয়ে তাকে বাস্তবায়িত করতে পারো…।
গুরুপ্রদত্ত বিজ্ঞানসম্মত ধ্যানের প্রক্রিয়ার সাহায্যে চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং মনকে অন্তর্মুখী করা শিখে আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে ক্রমশ তুমি এগিয়ে যাবে: তোমার ধ্যান আরও গভীর হবে এবং তোমার অদৃশ্য সত্তা, যা তোমার অন্তরে ভগবানের প্রতিবিম্ব, তোমার কাছে সত্য হয়ে উঠবে।

যে চিন্তাগুলিকে তুমি নাশ করতে চাও, সেগুলিকে সদর্থক চিন্তা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে মন থেকে দূর করে দাও। এটিই স্বর্গের চাবিকাঠি যা তোমার নিজের হাতেই আছে…।
আমরা নিজেকে যা মনে করি, তাই হয়ে যাই…। নিজের চেতনাকে নশ্বরচেতনা থেকে দিব্যচেতনায় পরিবর্তিত করো।

“আমি অসীম। আমি দেশহীন, আমি কালহীন; আমি দেহ, চিন্তা ও বাক্যের অতীত; সকল বস্তু এবং মনের অতীত। আমি অসীম পরমানন্দ।”
অবিরত নিজের মনকে দিব্য সত্যের দ্বারা প্রভাবিত করো
জরা, ব্যাধি, মৃত্যু ইত্যাদি মনুষ্যজীবনের যত সীমাবদ্ধতা, তাদের প্রতি সব ইঙ্গিত এড়িয়ে চলো। পরিবর্তে অবিরত নিজের মনকে এই সত্যটি দ্বারা প্রভাবিত করো:
“আমি সেই অসীম যিনি দেহের রূপ নিয়েছেন। ঈশ্বরের অভিব্যক্তি হিসেবে এই দেহ সদা-পূর্ণাঙ্গ, সদা-তারুণ্যময় আত্মা।”

দুর্বলতা বা বার্ধক্যের ভাবনার সীমাবদ্ধতা মেনে নিও না। তোমাকে কে বলেছে তোমার বয়স হয়েছে? তোমার বয়স হয়নি। তুমি আত্মা, চিরতরে তরুণ। তোমার চেতনায় এই ভাবনাটি গেঁথে দাও:
“আমি আত্মা, চিরতরুণ পরমাত্মার একটি প্রতিবিম্ব। আমি তারুণ্যে, উচ্চাকাঙ্ক্ষায়, এবং কৃতকার্য হওয়ার শক্তিতে প্রাণবন্ত।”


মহাজাগতিক শক্তির সঙ্গে সুর মেলাও। কারখানা বা ব্যবসার জগতে তুমি যেখানেই কাজ করো না কেন, সবসময় দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে বলো:
“আমার মধ্যে অসীম সৃজনশক্তি রয়েছে; কিছু কাজের কাজ না করে আমি মরব না। আমি এক দেব-মানব, এক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী। আমিই পরমাত্মার শক্তি , আত্মার শক্তির উৎস। আমি ব্যবসার জগতে, চিন্তাভাবনার জগতে, জ্ঞানের জগতে বিপ্লব সৃষ্টি করব। আমি এবং আমার পিতা এক। আমার সৃজনশীল পিতার মতো আমিও যে কোনো কাঙ্ক্ষিত বস্তু সৃষ্টি করতে পারি।”

এসআরএফ পাঠমালা তোমাকে মহাপ্রাণ…ঈশ্বরের মহাজাগতিক শক্তিসমুদ্রের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের উপায় শেখায়। সবচেয়ে ভালো উপায় হল ওষুধ, আবেগ ইত্যাদি থেকে কৃত্রিম উদ্দীপনার সাহায্য না নিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরাসরি সেই শক্তি গ্রহণ করা। তখন তুমি বলতে পারবে:
“রক্তমাংসের ঠিক আড়ালেই একটি প্রচণ্ড স্রোত বয়ে চলেছে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম, এখন আত্মোপলব্ধির গাঁইতি দিয়ে খোঁড়ার পরে, আমি সেই জীবনীশক্তিকে আবার আবিষ্কার করেছি…। আমি শুধু রক্তমাংস নই। আমি সেই দিব্য বিদ্যুতের আধার, যা এই শরীরে পরিব্যাপ্ত।”
দুঃখদুর্দশা তোমার আত্মার ক্ষতি করতে পারে না
নিজেকে অবিনশ্বর বলে জানো। জীবনযুদ্ধের পরীক্ষায় বিধ্বস্ত না হয়ে, বরং তার থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের অমরত্বকে অভিব্যক্ত করো, আর হাসো। বলো:
“আমি অবিনশ্বর। সেই পাঠ শিখতে এবং আমার অবিনশ্বরতাকে ফিরে পেতে আমাকে এক নশ্বর পাঠশালায় পাঠানো হয়েছে। পৃথিবীতে শুদ্ধিকরণের সমস্ত অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হলেও আমিই আত্মা, আমাকে ধ্বংস করা যায় না। আগুন আমাকে পোড়াতে পারে না, জল আমাকে ভেজাতে পারে না, হাওয়া আমাকে শুকোতে পারে না, পরমাণুশক্তি আমাকে খণ্ডবিখণ্ড করতে পারে না; আমি সেই অবিনশ্বর, অবিনশ্বরতা পাঠের স্বপ্ন দেখছি — চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার জন্য নয়, বরং মনোরঞ্জনের জন্য।”


অনেক জন্ম ধরে অনেক ভূমিকায় তুমি অভিনয় করেছ। এই ভূমিকাগুলি কিন্তু মনোরঞ্জনের জন্য তোমাকে দেওয়া হয়েছিল, ভয় দেখাবার জন্য নয়। তোমার অবিনশ্বর আত্মাকে কেউ ছুঁতে পর্যন্ত পারে না। তোমার জীবনের চলচ্চিত্রে তুমি হাসতে পারো, কাঁদতে পারো, অনেক ভূমিকায় অভিনয় করতে পারো; কিন্তু অন্তরে সব সময় তোমার বলা উচিত, “আমি আত্মা।” এই জ্ঞানের উপলব্ধি থেকে প্রভূত সান্ত্বনা পাওয়া যায়।

“আমি মধুর অমরত্বের আশীর্বাদধন্য সন্তান যাকে এখানে জন্মমৃত্যুর নাটক করতে পাঠানো হয়েছে — কিন্তু সর্বদা নিজের অমরত্বের কথাটি মনে রেখে।
“পরমাত্মার সাগর আমার আত্মায় এক ক্ষুদ্র বুদ্বুদ রূপে প্রকাশ পেয়েছে। মহাচৈতন্যের অসীম সাগরের সাথে একীভূত, আমি এই জীবনের বুদ্বুদ। আমি কখনও মরতে পারি না। জন্মে ভেসে থাকি বা মৃত্যুতে লীন হয়ে যাই, পরমাত্মার অবিনশ্বরতার বুকে সুরক্ষিত আমি অবিনাশী চেতনা।”
কোনোকিছুকে ভয় পেয়ো না, কারণ তুমি ঈশ্বরের সন্তান
ধ্যানের সময় যখন চোখ বন্ধ করো তখন তোমার চেতনার বিরাটত্বকে তুমি অনুভব করতে পারো, তুমি দেখতে পাও যে তুমি অনন্তের কেন্দ্রে রয়েছ। সেইখানে মনঃসংযোগ করো; সকাল এবং সন্ধ্যায় কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে বলো:
“আমি সেই অসীম; আমি ঈশ্বরের সন্তান। তরঙ্গ সমুদ্রেরই স্ফীতি; আমার চেতনা বিরাট মহাচৈতন্যেরই স্ফীতি। আমি কোনো কিছুকেই ভয় পাই না। আমি আত্মা।”

সর্বদা ভগবানের অন্তর্নিহিত উপস্থিতির চেতনাকে ধরে রাখো। মনের সমতা বজায় রাখো আর বলো:
“আমি নির্ভয়; আমি ভগবদবস্তু দিয়ে গড়া। আমি পরমাত্মা-অগ্নির একটি স্ফুলিঙ্গ। আমি মহাজাগতিক শিখার একটি কণা। আমি পরমপিতার অসীম বিশ্ব-শরীরের একটি কোশ। ‘আমি এবং আমার পিতা অভেদ।’”

এই চেতনায় নির্ভয় থাকো:
“জীবনে এবং মরণে সর্বদা ভগবানের মধ্যেই আমি রয়েছি।”
তুমি ধ্যানের প্রক্রিয়াগুলি অভ্যাস করতে থাকলে এই চেতনা দিনে দিনে তোমাকে প্রভাবিত করবে। যখন ধ্যানে গভীর অন্তর্মুখী শান্তিতে প্রবেশ করো, তখন দেহচেতনার বন্ধন থেকে তুমি মুক্ত হয়ে যাও। তখন আর তোমার কাছে মৃত্যু কি? ভয় কোথায়? তোমাকে ভয় দেখাবার কারো সাধ্য নেই। এই ভাবটিকেই তো তুমি খুঁজছ। ওম-এ মনঃসংযোগ করো। গভীর ধ্যানে ওম-এর সঙ্গে মিশে যাও; মহাজাগতিক স্পন্দনে ভগবানের পরিব্যাপ্ততা উপলব্ধি করে তুমি “ঈশ্বরে উপনীত হবে” — অসীম অতীন্দ্রিয় নির্বিকল্পের পরমানন্দ-চেতনা। তুমি বলবে:
“আমি ও আমার পরমানন্দ-ঈশ্বর এক। এই জগতে আমার যা কিছু চাই, সবই আমার আছে। মৃত্যু, ব্যাধি, প্রলয়, অগ্নি, কোনো কিছুই সেই আনন্দকে কেড়ে নিতে পারে না!”
তুমি স্বয়ং আত্মা: নিজের আধ্যাত্মিক গুণগুলিকে ফুটিয়ে তোলো

তোমার জীবনের সমস্ত সুন্দর এবং ভালো গুণগুলি মনে রাখার এবং তার ওপর মনোনিবেশ করার চেষ্টা করো, নিজের ত্রুটির ওপর জোর দিও না।

যে যোগী হতে চায়, কখনও রাগ হলে তাকে মনে করতে হবে — “এ আমি নই!” কাম বা লোভের শিকার হয়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালে তার নিজেকে বলা উচিত — “ও আমি নই!” যখন কুৎসিত আবেগের মুখোশ দিয়ে ঘৃণা তার সত্য প্রকৃতিকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করে, তখন জোর করে তার নিজেকে সরিয়ে নেওয়া উচিত — “ও আমি নই!” যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুকেরা ভিতরে বাসা বাঁধতে চায় তাদের মুখের ওপর সে চেতনার দরজা বন্ধ করে দিতে শেখে। আর যখন অন্যেরা তাকে অন্যায়ভাবে কাজে লাগালে বা নির্যাতন করলেও সে অন্তরে ক্ষমা ও ভালোবাসার পবিত্র ভাবের আলোড়ন অনুভব করে, তখন সে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলতে পারে, “এই আমি! এই আমার সত্য প্রকৃতি।”
ধ্যানযোগ মানুষের সত্য প্রকৃতিকে বিকশিত করা এবং তাকে স্থায়ী করার প্রক্রিয়া। ধ্যানযোগে সুনির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক ও মনোদৈহিক পদ্ধতি এবং নিয়মের মাধ্যমে সংকীর্ণ অহং (উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ত্রুটিপূর্ণ মানবচেতনা) আত্মার চেতনা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।

প্রিয়জনেরা, কাউকে বলতে দিয়ো না যে তুমি পাপী। তোমরা ঈশ্বরের সন্তান, কারণ তোমাদের তিনি নিজের প্রতিরূপে সৃষ্টি করেছেন…। নিজেকে বলো:
“আমার পাপ সমুদ্রের মতো গভীর বা নক্ষত্রের মতো উঁচুই হোক না কেন, তবুও আমি অপরাজিত কারণ আমি স্বয়ং আত্মা।”
তুমিই জ্যোতি, তুমিই আনন্দ
হাজার হাজার বছর ধরে একটি গুহার মধ্যে অন্ধকার রাজত্ব করতে পারে, কিন্তু আলো নিয়ে এলে অন্ধকার এমন অদৃশ্য হয় যেন কোনোকালেই তা ছিল না। একই ভাবে, তোমার যত দোষই থাকুক না কেন, তুমি সদগুণের আলো নিয়ে এলে তোমার দোষগুলি আর থাকে না। আত্মার জ্যোতি এতই মহান যে জন্মজন্মান্তরের পাপও তাকে ধ্বংস করতে পারে না। কিন্তু তোমার সৃষ্ট অশুভ কর্মের অস্থায়ী অন্ধকার তোমার আত্মাকে পীড়া দেয়, কারণ সেই অন্ধকারে তুমি কষ্ট পাও। গভীর ধ্যানে তোমার দিব্যনেত্র উন্মীলিত করে, তার সর্বপ্রকাশকারী দিব্যজ্যোতি দিয়ে তোমার চেতনাকে পূর্ণ করে, তুমি সেই অন্ধকার দূর করতে পারো।
তুমি ছাড়া আর কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারে না। তুমি নিজেই তোমার ত্রাণকর্তা হয়ে যাবে যেই মুহূর্তে তুমি উপলব্ধি করবে:
“আমি স্বয়ং জ্যোতিস্বরূপ। অন্ধকার কখনোই আমার জন্য ধার্য ছিল না; অন্ধকার কখনোই আমার আত্মার জ্যোতিকে ঢেকে রাখতে পারবে না।”

এখনকার সমস্ত সীমাবদ্ধতার দুঃস্বপ্ন ভুলে যাও। রাতে ঘুমানোর আগে এবং ভোরবেলা জেগে উঠে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলো:
“জিশু ও সন্তগণের মতো আমিও ঈশ্বরের সন্তান। অজ্ঞানতার পর্দার আড়ালে তাঁর কাছ থেকে আমি আর লুকিয়ে থাকব না। আমি জ্ঞানের আলোয় ঝলমল করব যাতে আমার ক্রমবর্ধমান আধ্যাত্মিক স্বচ্ছতার মাধ্যমে তাঁর পরম জ্যোতি সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে পারি। তাঁর আলো সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করে আমি নিজেকে ঈশ্বরের সন্তান রূপে জানব — তাঁর প্রতিমূর্তিতে গড়া হওয়ার ফলে আমি সর্বদাই যা ছিলাম।”

“আমি সদা সর্বদা ঈশ্বরের সন্তান। আমার শক্তি আমার সমস্ত পরীক্ষার চেয়ে বড়ো। অতীতে আমি যা ভুল কাজই করে থাকি না কেন, সৎকর্ম এবং ধ্যানের দ্বারা এখন আমি সেগুলি শোধরাতে পারি। আমি তাদের বিনষ্ট করব। আমি চির অবিনশ্বর।”

প্রতি রাতে ধ্যান করো যতক্ষণ না তুমি তোমার সমস্ত জাগতিক চিন্তাভাবনা এবং আকাঙ্ক্ষাগুলিকে নির্মূল করতে পারো…। তোমার সমস্ত অস্থির চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিগুলি থেকে দূরে সরে দাঁড়াও এবং তোমার আত্মার মন্দিরে গিয়ে বসো, যেখানে ঈশ্বরের অসীম আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে এই জগতকে নিজের মধ্যে গ্রাস করে নেয় আর তুমি উপলব্ধি করো যে তিনি ছাড়া আর কিছুই নেই। তখন তুমি বলবে:
“আমি ঈশ্বরের অনন্ত জ্যোতির সাথে একীভূত, যে জ্যোতি খ্রিস্টের শাশ্বত আনন্দ। সৃষ্টির সমস্ত ঢেউ আমার মধ্যে আছড়ে পড়ছে। আমার দেহতরঙ্গকে আমি পরমাত্মার মহাসাগরে বিলীন করেছি। আমি পরমাত্মার মহাসাগর। আমি আর দেহ নই। পাষাণের মধ্যে আমার আত্মা ঘুমিয়ে আছে। ফুলের মধ্যে আমি স্বপ্ন দেখছি আর পাখিদের মধ্যে আমি গান গাইছি। মানুষ হয়ে আমি চিন্তা করছি এবং মহামানব হয়ে উপলব্ধি করছি যে আমি আছি।”
এই অবস্থায় তুমি বুঝতে পারো যে, আগুন তোমাকে ধ্বংস করতে পারে না; তুমি এও বুঝতে পারো, যে মাটি, ঘাস, আকাশ এই সবের সঙ্গেই তোমার রক্তের সম্পর্ক আছে। তখন সৃষ্টির উত্তাল তরঙ্গকে ভয় না পেয়ে তুমি নিজের আত্মস্বরূপে পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াতে পারো।
তুমিই প্রেম
“আমার পরমপিতাই প্রেম, আর আমি তাঁর প্রতিরূপে গড়া। আমি প্রেমের সেই বৃত্ত যার মধ্যে সকল গ্রহপুঞ্জ, সকল নক্ষত্ররাজি, সকল প্রাণী এবং সকল সৃষ্টি ঝিকমিক করছে। আমি সেই প্রেম যা সম্পূর্ণ বিশ্বজগতকে পরিব্যাপ্ত করে আছে।”

যখন তোমার সেই দিব্য প্রেমের অনুভূতি হবে, তখন তুমি ফুল এবং পশুর মধ্যে, বা দু-জন মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখবে না। সমস্ত প্রকৃতির সাথে তোমার গভীর যোগাযোগ স্থাপিত হবে এবং সম্পূর্ণ মানবজাতিকে তুমি সমানভাবে ভালোবাসবে। তুমি শুধু একটি জাতিই দেখতে পাবে — ঈশ্বরের সন্তান — তাঁর সূত্রে তোমার ভাইবোন — এবং তুমি নিজেকে বলবে:
“ঈশ্বরই আমার পিতা। আমি তাঁর বিরাট মানব পরিবারের অংশ। আমি সবাইকে ভালোবাসি কারণ তারা সবাই আমার আপন। আমার ভাই সূর্য এবং বোন চন্দ্র এবং সমস্ত প্রাণী যাদের আমার পিতা সৃষ্টি করেছেন এবং যাদের মধ্যে তাঁর প্রাণশক্তি প্রবাহিত হচ্ছে তাদেরকেও আমি ভালোবাসি।”

“আমি জলপাই, সাদা, কালো, হলুদ, লাল, সবরকম রঙের মানুষকে আমার হৃদয়স্থিত তাদের গৃহে — আমার ভাইয়ের মতো থাকতে স্বাগত জানাই, যারা সকলেই পিতামাতা আদম এবং ইভ থেকে পার্থিব জন্ম নিয়েছে আর পরমপিতা ঈশ্বর থেকে দিব্য জন্ম নিয়েছে।”
“মাটি, জল, হাওয়া, আগুন এবং ইথারকে আমার নিজের আত্মীয়ের মতো আমি আলিঙ্গন করি। একই জীবনস্রোত সমস্ত প্রাণীতে এবং আমার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। সমস্ত প্রাণী, গাছপালা, প্রিয় পরমাণু এবং শক্তিদের আমার জীবনমন্দিরে আমি আলিঙ্গন করি; কারণ আমিই প্রেম, আমিই জীবন।”
“তুমিই সেই”
“অহং ব্রহ্মাস্মি (আমিই ব্রহ্ম),” অথবা “তত্ত্বমসি (তুমিই সেই),” আত্মার এই উপলব্ধিই হল প্রকৃত জ্ঞান। ধ্যানের আসনে মেরুদণ্ড সোজা করে বসে প্রাণবায়ুর স্রোতকে কূটস্থে (দুই ভ্রূর মধ্যস্থলে) পাঠানোই প্রকৃত তপস্যা, আধ্যাত্মিক কৃচ্ছ্রতা যার অভ্যাস অন্তরের দিব্য শক্তিকে আয়ত্তে আনে।

যখন তুমি দেহ বা মন নও এই জেনে জগতের চেতনার বাইরে চলে যাও, কিন্তু তবুও আগের চেয়েও বেশি সচেতন থাকো যে তুমি আছো — তখনকার সেই দিব্য চেতনাই তুমি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর মূল যাঁর মধ্যে নিহিত, তুমিই সেই।

তোমার আত্মাকে পরমাত্মা থেকে আলাদা করে রাখে এমন সীমাবদ্ধতার কাঠামো ভেঙে ফেলো।
“আমি কি মহাসাগর? ও যে বড্ড ছোটো,
স্বপ্নের শিশিরবিন্দু এক, আকাশের নীল ঘাসের ওপর।
আমি কি আকাশ? ও যে বড্ড ছোটো,
অনন্তের বুকে যেন এক সরোবর।
আমি কি অনন্ত? ও যে বড্ড ছোটো,
এক নামের গণ্ডীতে বাঁধা।
নামহীনতার অসীম প্রদেশে ভালোবাসি করতে আবাস,
স্বপ্ন, নাম, ধারণার সীমাকে ছাড়িয়ে।
আমি তাই, যা আমি সর্বদাই —
সতত-বর্তমান অতীতে,
সতত-বর্তমান ভবিষ্যতে,
সতত-বর্তমান এইক্ষণে।”

আরও জানতে হলে:
- সংকল্প ও নিরাময়, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি — পরমহংস যোগানন্দ
- আধ্যাত্মিক ধ্যান — পরমহংস যোগানন্দ
- “অদৃশ্য মানুষ,” মানুষের চিরন্তন অন্বেষণ — পরমহংস যোগানন্দ
- “Remolding Your Life” in Journey to Self-realization — Paramahansa Yogananda
- “The Mind: Repository of Infinite Power” in The Divine Romance — Paramahansa Yogananda