শতবর্ষেরও বেশি পূর্বে, জুলাই ১৯১৫-তে ভারতের শ্রীরামপুরে পরমহংস যোগানন্দ তাঁর গুরু স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বরের থেকে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণের পর ভারতের সুপ্রাচীন স্বামী সন্ন্যাসী পরম্পরায় দীক্ষিত হয়েছিলেন। এটা শুধুমাত্র বাইশ বছর বয়সী মুকুন্দলাল ঘোষের জীবনেরই একটা সন্ধিক্ষণ ছিল না — যিনি সদ্য স্বামী যোগানন্দ গিরি হয়েছিলেন — বরং বিংশ শতাব্দী ও তার পরবর্তীকালে বিশ্বের আধ্যাত্মিক জাগরণে তাঁর প্রভাবের পূর্বসূচনা ছিল, তাঁর স্থায়ী উত্তরাধিকাররূপে যে সন্ন্যাসী পরম্পরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শুধু সেকারণেই নয়।
সুপ্রাচীন স্বামী পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত পরমহংস যোগানন্দের ধারা এখন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের সন্ন্যাসীদের নিয়ে গঠিত যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ে প্রতিষ্ঠিত। এই সন্ন্যাসী পরম্পরা ওয়াইএসএস-এর বৃদ্ধি বজায় রেখে ভারতীয় উপমহাদেশে যোগের ব্যাপক প্রসারে সহায়তা করে।

পরমহংসজি তাঁর সৃষ্ট সন্ন্যাসী পরম্পরার বর্ণনায় লিখেছেন: “আমার জন্য স্বামী পরম্পরার একজন সন্ন্যাসীর সম্পূর্ণ আত্মত্যাগই আমার হৃদয়ে সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের জন্য জীবন উৎসর্গ করার ব্যাকুল আকাঙ্খার একমাত্র সম্ভাব্য উত্তর ছিল, কোনও পার্থিব বন্ধনের সঙ্গে আপোষহীনভাবে….
“একজন সন্ন্যাসী হিসেবে, ঈশ্বরের অকপট সেবায় আর হৃদয় হতে হৃদয়ে তাঁর বার্তার আধ্যাত্মিক উন্মেষে আমার জীবন সমর্পিত। যাঁরা ঈশ্বরের অনুসন্ধান ও সেবায় যোগ আদর্শের ধ্যাননিষ্ঠ ও কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মকান্ডে সম্পূর্ণ আত্মত্যাগীর জীবনের ডাক উপলব্ধি করে আমার এই পথের অনুসরণকারী, শুরুতে আমার গুরুদেবের প্রদত্ত শংকর পরম্পরার সন্ন্যাস ধারায় সন্ন্যাসীর যে পবিত্র ব্রত পেয়েছি, সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ /যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ায় সেই সন্ন্যাস ধারা বজায় রেখেছি। ঈশ্বর, আমার গুরু ও পরমগুরুগণ আমার মাধ্যমে যে সংগঠনের কাজ শুরু করেছেন… ঈশ্বরপ্রেম ও ত্যাগের মহোত্তম লক্ষ্যে যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের দ্বারা বাহিত হচ্ছে।”


“স্বামী সম্প্রদায়ে আমার সন্ন্যাস গ্রহণ”
— পরমহংস যোগানন্দ

বহু দিনের আশা হৃদয়ে বহন করে একদিন গুরুদেবকে বললাম, “গুরুদেব, বাবার একান্ত ইচ্ছা যে, বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়েতে একটি কর্মকর্তার পদ গ্রহণ করি। আমি কিন্তু তা একেবারে প্রত্যাখ্যান করে এসেছি; আপনি কি আমাকে স্বামী পরম্পরার সন্ন্যাসী করবেন না?” – বলে অত্যন্ত কাতর নয়নে তাঁর [স্বামী শ্রী যুক্তেশ্বর] দিকে চেয়ে রইলাম। আগে বরাবরই তিনি আমার এ অনুরোধ এড়িয়ে এসেছেন, আমার মনের দৃঢ়তা পরীক্ষা করবার জন্য। আজকে কিন্তু তিনি প্রসন্ন হাসি হাসলেন।
শান্ত স্বরে সহাস্যে তিনি বললেন, “আচ্ছা, কালই তোমায় সন্ন্যাসে দীক্ষা দেবো। সন্ন্যাস নেবার ইচ্ছে যে তোমার অটুট আছে তাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। লাহিড়ী মহাশয় প্রায়ই বলতেন, ‘জীবনের বসন্তেই যদি তুমি ভগবানকে ডেকে না আনো, তবে তোমার জীবনের শীতে তিনি কেন আসবেন, বলো?’”
“পূজনীয় গুরুদেব, আপনার মতো আমিও সন্ন্যাস নেবার ইচ্ছা কখনও পরিত্যাগ করতে পারিনি,” বলে অপরিসীম ভক্তি ও শ্রদ্ধান্বিত হৃদয়ে তাঁর দিকে চেয়ে হাসলাম….
জীবনে ঈশ্বর গৌণ বা অপ্রধান স্থান অধিকার করে থাকবেন, এ চিন্তা আমার কাছে একেবারে অকল্পনীয়। নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের অধিপতি তিনি, তাঁর অযাচিত করুণার দান জন্মজন্মান্তরের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের ওপরে নীরবে বর্ষিত হচ্ছে। প্রতিদানে মানুষের একটি জিনিসই দেবার আছে – যা দেওয়া বা না দেওয়াতে আছে তারই অধিকার – সেটা হচ্ছে তার প্রেম।
তার পরের দিনটি হচ্ছে আমার জীবনের একটি অতীব স্মরণীয় দিন। সেদিনের কথা আজও আমার মনে পড়ে কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে বেরোবার কয়েক সপ্তাহ বাদেই – সেটা ছিল ১৯১৫-র জুলাই মাসের এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল বৃহস্পতিবার। শ্রীরামপুর আশ্রমের ভিতরকার বারান্দায় গুরুদেব একখণ্ড সাদাসিল্ক গৈরিকবর্ণে রঞ্জিত করলেন –চিরকালের সন্ন্যাসীর বসন। শুকিয়ে গেলে পর গুরুদেব সেই গৈরিক বস্ত্র দিয়ে আমার সর্বাঙ্গ ত্যাগীর পোশাকে আবৃত করে দিলেন….
নতজানু হয়ে শ্রীযুক্তেশ্বর গিরিজির পদতলে প্রণাম করতে, সর্বপ্রথম তাঁর মুখ থেকে আমার নতুন নাম শুনে আমার হৃদয় কৃতজ্ঞতায় উদ্বেলিত হয়ে উঠল। কত স্নেহের সঙ্গে, কত অক্লান্তভাবে তিনি পরিশ্রম করে এসেছেন, যাতে করে বালক মুকুন্দ একদিন সন্ন্যাসী যোগানন্দতে পরিণত হতে পারে! সানন্দে আমি শঙ্করাচার্যের স্তোত্র হতে কয়েক ছত্র আবৃত্তি করলাম:
না মন, না বুদ্ধি, না অহংকার আবেগ;
আকাশ নই ভূমি নই ধাতু আমি।
আমি সেই, আমি সেই, পবিত্র আত্মা, আমি সেই!
নেই জন্ম, নেই মৃত্যু, না জাতি আমার;
পিতা নেই মাতা নেই, কিছু আমার;
আমিই সে, আমিই সে, পবিত্র আত্মা, আমি সে!
ভাবের বেগের পারে, আমি নিরাকার,
প্রাণের পাখায় পাখায় ব্যাপ্ত;
নয় বন্ধন ভয় আমার;
আমি মুক্ত, সতত মুক্ত,
আমি সেই, আমি সেই, পবিত্র আত্মা, আমি সেই!
বিশ্বব্যাপী ক্রিয়াযোগের সুপ্রাচীন ধ্যানবিজ্ঞান বিস্তারে পরমহংসজির বিশেষ দৌত্য আমেরিকায় সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক সম্প্রসারণের সাথে একীভূত। যোগানন্দের ক্রিয়াযোগ দৌত্যে সন্ন্যাসের ভিত্তি তাঁর গুরু শ্রীযুক্তেশ্বরের সাথে আধুনিককালে ক্রিয়াযোগ পরম্পরার স্রষ্টা মহাবতার বাবাজির সাক্ষাতের সময়ে দেখা যায়। আধুনিককালে, বহু শতাব্দী ধরে ঢাকা পড়ে থাকা ক্রিয়াযোগের প্রকাশ্য শিক্ষাদানের কার্যপ্রণালী শুরু করার উদ্দেশ্যে বাবাজি প্রথমে ঘরোয়া ও গৃহী লাহিড়ী মহাশয়কে নির্দেশ দেন। শ্রীযুক্তেশ্বর ১৮৯৪-তে এলাহাবাদ কুম্ভমেলায় মহাবতার বাবাজির সাথে সাক্ষাতের সময় পর্যন্ত, তাঁর গুরুদেব লাহিড়ী মহাশয়ের মতই একজন গৃহী (যদিও বিপত্নীক) ছিলেন। সেই সাক্ষাতের যেমন বর্ণনা শ্রীযুক্তেশ্বর দিয়েছেন: বাবাজি সস্নেহে বললেন: “স্বাগত, স্বামীজি।”
আমি জোরালো প্রতিবাদ করে বললাম, “না মশায়, আমায় স্বামীটামি কিছু বলবেন না; আমি ওসব কিছু নই।”
“দৈবাদেশে যাদের আমি স্বামী উপাধি দিই, তারা আর তা পরিত্যাগ করতে পারে না।” সাধুটি নিতান্ত সাধারণভাবে কথাগুলি বললেও কথাগুলির মধ্যে সত্যের গভীর দৃঢ়তা ছিল; সঙ্গে সঙ্গে মনে হল যেন আধ্যাত্মিক আশিসধারায় প্লাবিত হয়ে গেছি।
বাবাজি নবীন স্বামীকে বললেন: “বছরকয়েক বাদে আমি তোমার কাছে একটি শিষ্যকে পাঠাব যাকে পাশ্চাত্যে যোগ প্রচারের কাজে তোমাকে তৈরী করে নিতে হবে।” সেই শিষ্য অবশ্যই পরমহংস যোগানন্দ ছিলেন, পরবর্তীতে স্বয়ং মহাবতার বাবাজি পরমহংসজিকে নিশ্চিত করেছেন। যোগানন্দকে প্রশিক্ষণের জন্য তাঁর কাছে পাঠানোর আগে শ্রীযুক্তেশ্বরকে সন্ন্যাসী ভূষিত করে, বাবাজি নিশ্চিত করেছিলেন যে বিশ্বব্যাপী ক্রিয়াযোগের মুখ্য প্রচার ভারতবর্ষের প্রাচীন সন্ন্যাসী প্রথার অনুমোদিত সন্ন্যাসী দ্বারাই সম্পন্ন হবে।
১৯৫১-র ২৫শে আগস্ট, এসআরএফ-ওয়াইএসএস-এর লস অ্যাঞ্জেলস স্থিত আন্তর্জাতিক সদর দফতরে, জেমস জে. লীন-কে সন্ন্যাসদীক্ষা দানের পরে রাজর্ষি জনকানন্দ নামকরণ করে উত্থিত হস্তে পরমহংস যোগানন্দ তাঁর প্রিয় শিষ্যকে আশীর্বাদ করছেন।


১৯৭০-এ, মাদার সেন্টার-এ স্বামী শ্যামানন্দকে শ্রী দয়ামাতা সন্ন্যাসের গৈরিক বস্ত্র দ্বারা আবৃত করছেন।
পরমহংসজি ১৯২৫-এ লস অ্যাঞ্জেলস-এ সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এর আন্তর্জাতিক সদর দফতর প্রতিষ্ঠার পরে, ঈশ্বর সন্ধানে সম্পূর্ণরূপে জীবন উৎসর্গ করতে ইচ্ছুক নর-নারীকে প্রশিক্ষণের জন্য পর্যায়ক্রমে গ্রহণ করতে শুরু করেন। তাঁর নিজের মধ্যে গ্রহণ করা আশ্রমিক জীবনের ভাব ও আদর্শের দৃষ্টান্ত তিনি শুরুর দিকে আসা শ্রী দয়ামাতা, শ্রী জ্ঞানমাতা ও অন্যান্য প্রগাঢ়ভাবে সমর্পিত শিষ্যদের মধ্যে সঞ্চারিত করেন, তাঁদের আগমনে ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলস-এর মাউন্ট ওয়াশিংটনের পাহাড় চূড়ার আশ্রমটি সর্বত্যাগীদের বিকাশমান আবাসে পরিণত হয়ে যায়। তাঁর শুরু করা বিশ্বব্যাপী আধ্যাত্মিক ও সেবাকার্যের ধারাবাহিকতা এবং তাঁর শিক্ষা বিস্তারের জন্য নির্দিষ্ট নির্দেশিকাও গুরুদেব ঘনিষ্ট শিষ্যদের দিয়েছেন — তাঁর অভিযানের ভবিষ্যত দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। তাঁর জীবনকালে আশ্রমবাসীদের দেওয়া তাঁর সেই একই গভীর আধ্যাত্মিক পরামর্শ ও শৃঙ্খলা আজ ওয়াইএসএস ও এসআরএফ-এর সন্ন্যাসীদের নতুন প্রজন্মে প্রবাহিত হচ্ছে।
এভাবেই পরমহংস যোগানন্দের মাধ্যমে ভারত থেকে সুপ্রাচীন সন্ন্যাসী স্বামী সম্প্রদায় আমেরিকায় গভীর ও স্থায়ী ভিত্তি স্থাপন করে। এর সাথে যোগ্য পাশ্চাত্যবাসীদের দীক্ষিত করে পরমহংসজি সনাতন প্রথাকে অন্যভাবে পরিবর্তিত করেন: সেকালের তুলনায় অস্বাভাবিক হলেও পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও একই পবিত্র সন্ন্যাস ব্রত ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব প্রদান করেন, তাঁর সময়ে যা বিরল ঘটনা। পরবর্তীতে প্রায় অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে ওয়াইএসএস/এসআরএফ-এর আধ্যাত্মিক প্রধান থাকা শ্রী দয়ামাতা তাঁর কাছে প্রথম সন্ন্যাস ব্রত পাওয়া এসআরএফ-এর সর্বত্যাগী নারী শিষ্যা ছিলেন।
শ্রী দয়ামাতা অধ্যক্ষ থাকাকালীন ভারতের স্বামী পরম্পরার বরিষ্ঠ প্রধান — পুরীর পূজ্যপাদ শঙ্করাচার্য স্বামী ভারতী কৃষ্ণ তীর্থ ১৯৫৮-তে তাঁর তিনমাসব্যাপী যুগান্তকারী আমেরিকা ভ্রমণকালে সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এ অতিথি ছিলেন। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো শঙ্করাচার্য (স্বামী সম্প্রদায়ের অষ্টম শতাব্দীর পুনর্গঠক আদিশঙ্করের উত্তরসুরী) পাশ্চাত্য ভ্রমণ করেন। শ্রী দয়ামাতার প্রতি ঋষিতুল্য শঙ্করাচার্যের গভীর শ্রদ্ধা ছিল আর ওয়াইএসএস/এসআরএফ-এ বাবাজির নির্দেশে পরমহংস যোগানন্দের শুরু করা স্বামী পরম্পরার আরও বিস্তারের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আশীর্বাদ করেন। ভারতে ফিরে এসে তিনি প্রকাশ্যে বলেন: “আমি সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এ [যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া] মহোত্তম আধ্যাত্মিকতা, সেবা আর প্রেম দেখেছি। তাঁদের প্রতিনিধিরা শুধুমাত্র এই নীতির প্রচারই করে না বরং এই নীতি অনুসারেই জীবনযাপন করে।”


পরমহংস যোগানন্দকৃত কর্মের অগ্রগতি
যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া-র সন্ন্যাসীগণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেবাপ্রদানের জন্য ভারতব্যাপী বার্ষিক ভ্রমণ, সঙ্গমে বক্তৃতাদান, প্রচার কর্মসূচির পরিচালনা, কার্যালয়ের পরিচালনা, সোসাইটির আশ্রম, কেন্দ্র ও মন্ডলীর পরিচালনা, প্রকাশনার তত্ত্বাবধান এবং ওয়াইএসএস-এর বই ও রেকর্ডিংস-এর পরিবেশন আর অধ্যাত্ম বিষয়ে অন্বেষীদের পরামর্শদান সহ বিভিন্ন দায়িত্বে সেবাদান করে পরমহংসদেবের কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান।









“ঈশ্বর সর্বাগ্রে, ঈশ্বর সর্বক্ষণ, একমাত্র ঈশ্বর”
— শ্রী মৃণালিনী মাতা
ওয়াইএসএস/এসআরএফ আশ্রমিকদের উদ্দেশ্যে যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এর চতুর্থ অধ্যক্ষের (২০১১-২০১৭) মন্তব্যের নির্বাচিত অংশ
প্রিয়জনেরা,
বিগত কয়েক বছরে আমাদের শ্রদ্ধেয় গুরুদেবের সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ [যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া]-র প্রভূত পরিমাণে প্রসার লক্ষ্য করা গেছে; আমাদের কাজ এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। প্রায়শই আমরা স্মরণ করি অনেক বছর আগে সন্ন্যাসব্রতে জীবন উৎসর্গ করতে আসা আমাদেরকে গুরুদেব বলতেন “আমি শরীর ছেড়ে যাবার পর, এই সঙ্ঘই হবে আমার শরীর আর তোমরা সবাই হবে আমার হাত আর পা, আমার কথা”। কি আশীর্বাদধন্য সুযোগ, কি অসাধারণ মুক্তির অভিজ্ঞতা এই উৎসর্গিত জীবনে। সর্বান্তঃকরণে অবলম্বন করা প্রত্যেকেই গুরুদেবের সত্বার এক এক দ্যুতিমান কণায় বদলে গেছে — গুরুদেবের সঙ্ঘকে ঐশ্বরিক প্রেমপূর্ণ চেতনায় পৌঁছে দিতে প্রত্যেকেই তার আবশ্যক অবদান রেখে একাজ পূর্ণ করছে।
বিশ্ব আজ আধ্যাত্মিক আদর্শ ও নৈতিকতার দৃষ্টি হারিয়েছে। সাধারণ বস্তুতান্ত্রিক নিয়মের উর্ধ্বে জীবনযাপনে সক্ষম মানুষ আত্মিক আকাঙ্খায় সাড়া দিয়ে সন্ন্যাসমার্গে জীবন উৎসর্গ করে। তবে, আপেক্ষিক অর্থে খুব অল্পই সন্ন্যাসমার্গের অন্তর্ভুক্ত হলেও, তাঁদের নিয়মনিষ্ঠ জীবনধারণের প্রচেষ্টা সাধারণের মাঝে উচ্চমান বজায় রাখতে সাহায্য করে। সাধারণ মানুষ একে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত পবিত্র জীবন ছাড়াও কিছুটা আলাদা, স্বতন্ত্র বলে অনুভব করে। সরলতা, কর্তব্যপরায়ণতা, ব্রহ্মচর্য ও আনুগত্যের সংকল্পসাধন, ধ্যানে অধ্যবসায় ও বিনম্রভাবে উন্নত হবার চেষ্টা, ভক্তদের মাঝে অসাধারণ পরিবর্তন নিয়ে আসে। এমনকি তাঁর ক্ষুদ্র জৈব শরীরও স্পষ্টতই আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ হয়ে যায়। এব্যাপারে অন্যে কেউ কিছু বলতে না পারলেও তারা অনুভব করে ওই ভক্তের সূক্ষ্ম প্রভা কোনো না কোনোভাবে তাদের উন্নত করে তোলে ও তাদেরকে পরমপিতার কথা বলে। ওই বিনম্র ভক্ত কোনোভাবেই এই বিষয়ে জাহির করেন না; প্রকৃতপক্ষে হয়ত তিনি এ ব্যাপারে সচেতনই থাকেন না।
নিজেকে আধ্যাত্মিক মার্গে উৎসর্গ করার থেকে কোনো বড়ো বিষয় নেই — কারোরই এর থেকে বড়ো কোনো সাফল্য অর্জনের নেই — নিত্যতার নিরিখে এর থেকে বড়ো কীর্তি নেই। যিনি সফল হন, যিনি হৃদয় দিয়ে সেবা করেন, ঈশ্বর ও গুরুর সাথে একাত্ব হয়ে থাকেন, নীরবে ও তার অজান্তেই বিশ্বে হাজারো মানুষের পরিবর্তন সাধন করেন। কোনো একসময় ঈশ্বর সংসর্গে এসে ফিরে তাকিয়ে তাঁকে বলতে হয়, “ওহ জগন্মাতা, ওহ গুরুদেব এই তুচ্ছ সামান্য প্রাণকে কি করে দিয়েছ !” এই কয়েক বছরে গুরুদেবের কীর্তির এই বিস্তার হয়েছে তাঁর আধ্যাত্মিক পরিবারের কারণে — যার অন্তর্গত গুরুদেবের শিক্ষা ও তাঁর ভাবের জীবন্ত উদাহরণ হওয়ার উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করা সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের সাথে সাথে প্রচুর একনিষ্ঠ গৃহী শিষ্যগণ।
গুরুদেব সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এর [যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া] অস্তিত্ব ও হৃদয়। তাঁর এই আশ্রমে আমাদের নিত্য দিনযাপনের মধ্যে তাঁরই শক্তি নিহিত। কর্তব্য যেমনই থাকুক না কেন — গুরুদেবের সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা তাদের ব্যবহারে, তাদের আচরণে, তাদের চিন্তা-ভাবনায়, তাদের পরিপূর্ণ সচেতনতায় সর্বদা মনে রাখতে শেখেন: “এক আদর্শে, আমার গুরুদেবের সেই একই আধ্যাত্মিক বিচারধারায় নিজেকে সমর্পণ করেছি: ঈশ্বর সর্বাগ্রে, ঈশ্বর সর্বক্ষণ, একমাত্র ঈশ্বর।” সেই আদর্শে যথার্থভাবে উৎসর্গীকৃত জীবনই এমন যাকে গুরুদেবের আশীর্বাদ প্রতিনিয়ত ছুঁয়ে থাকে, তাঁর সেবাকর্মে যিনি এক উপযুক্ত সাধন হয়ে ওঠেন, যার জীবনদর্শনে তিনি প্রকাশ করেন ঈশ্বরপ্রেম, ঈশ্বরবোধ, পরিচর্যা, জিশুর ক্ষমা, কৃষ্ণের আত্মজ্ঞান — তাঁর নিজের জীবনের আর সব দিব্যগুণ এত সুন্দরভাবে, আনন্দঘনরূপে তিনি ফুটিয়ে তোলেন। শুধুমাত্র নিজেদের মুক্তির জন্যই নয়, সবার মুক্তি ও মানবতার উন্নয়নে গুরুদেবের উপনীত দৈব বিধানকে স্থায়িত্ব দিতে তাঁর গড়ে তোলা এই আশ্রমে সুযোগ পেয়ে আমরা সবাই কত ধন্য।

আমন্ত্রণ
ঈশ্বরসন্ধান ও ঈশ্বরসেবায় সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের একজন ত্যাগব্রতী হয়ে নিজেকে উৎসর্গ করতে আন্তরিকভাবে ইচ্ছুক পারিবারিক বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত অবিবাহিত ব্যক্তিগণ বিশদ তথ্যের জন্য রাঁচিস্থিত যোগদা সৎসঙ্গ শাখা আশ্রমে যোগাযোগ করতে আমন্ত্রিত।