যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া শব্দকোশ (য – ল)

যুগ: প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত সৃষ্টিপর্বের একটি চক্র বা তার একটি অংশ। স্বামী শ্ৰীযুক্তেশ্বর (দ্র) তাঁর “দ্য হোলি সায়েন্স” (The Holy Science) পুস্তকে ২৪,০০০ বছরের বিষুবীয় চক্র বর্ণনা করেছেন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে মানুষের অবস্থানকাল নির্ণয় করেছেন। প্রাচীন শাস্ত্রসমূহে একথা উল্লিখিত আছে যে, ঋষিগণের গণনানুযায়ী সুদীর্ঘ কালব্যাপী এক বিশাল ব্রহ্মাণ্ডীয় চক্রের অন্তর্গত হল এই চক্র। যোগী-কথামৃত গ্রন্থে (১৬ পরিচ্ছেদ) আলোচিত।

যোগ: সংস্কৃত ‘যুজ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন। যোগের অর্থ পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলন; অধিকন্তু, যে সকল বৈজ্ঞানিক ধ্যান পদ্ধতি দ্বারা এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যায়, তাদেরও যোগ বলে। হিন্দু দর্শনশাস্ত্রের বিশদ ব্যাখ্যা অনুসারে ষড়দর্শনের অন্তর্গত অন্যতম দর্শন হল যোগ; অন্যগুলি হল – বেদান্ত, মীমাংসা, সাংখ্য, বৈশেষিক ও ন্যায়। যোগপদ্ধতির আবার নানা প্রকারভেদ আছে, যেমন – হঠযোগ, মন্ত্রযোগ, লয়যোগ, কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও রাজযোগ। যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এ এই রাজযোগ-ই শেখানো হয়। ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় শিষ্য অর্জুনের কাছে এই যোগ সম্বন্ধে প্রশংসা করে বলেছেন: “কৃচ্ছ্রসাধনকারী তপস্বী অপেক্ষা যোগী শ্রেষ্ঠ, এমনকি জ্ঞান কিংবা কর্মযোগের পথ যাঁরা অবলম্বন করেন, তাঁদের অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ; অতএব, হে অর্জুন, তুমি যোগী হও!” (ভগবদ্গীতা ৬:৪৬) । যোগশাস্ত্রের প্রখ্যাত প্রবক্তা মহর্ষি পতঞ্জলি রাজযোগের পথ অবলম্বন করে সমাধিলাভের জন্য সুনির্দিষ্ট অষ্টাঙ্গিক মার্গের কথা উল্লেখ করেছেন, যথা (১) যম – নৈতিক আচরণ; (২) নিয়ম – ধর্মীয় আচরণ; (৩) আসন – শরীরের চাঞ্চল্য স্থির করার জন্য সঠিক অঙ্গবিন্যাস; (৪) প্রাণায়াম – প্রাণ বা সূক্ষ্ম জীবন প্রবাহকে সংযত করা; (৫) প্রত্যাহার – অন্তর্মুখীনতা; (৬) ধারণা – একাগ্রতা; (৭) ধ্যান ও (৮) সমাধি – অতিচেতনার অনুভূতি, ঈশ্বর সংযোগ।

যোগদা সৎসঙ্গ পাঠমালা: এ হল ঘরে বসে অধ্যয়নের জন্য পরমহংস যোগানন্দের শিক্ষাসম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ ধারাবাহিক পাঠমালার সংকলন যা ভারতীয় উপমহাদেশের নিষ্ঠাবান সত্যসন্ধানীদের জন্য উপলব্ধ করা হয়েছে। পরমহংস যোগানন্দের শেখানো যৌগিক ধ্যানপ্রক্রিয়াসমূহ এই পাঠমালাতে যেমন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তেমনই যারা নির্দিষ্ট কিছু আবশ্যিক শর্ত পূর্ণ করবেন, তাদের জন্য ক্রিয়াযোগ (দ্র) প্রক্রিয়াও দেওয়া হয়েছে।

যোগদা সৎসঙ্গ ম্যাগাজিন: পরমহংস যোগানন্দের ভাষণ ও রচনা ছাড়াও অন্যান্য আধ্যাত্মিক ও বর্তমান যুগের উপযোগী ব্যবহারিক ও তথ্যবহুল প্রবন্ধ সমন্বিত যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা।

যোগদা সৎসঙ্গ সন্ন্যাসী পরম্পরা: প্রথম শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন স্বামী সম্প্রদায়ের অংশ, তাঁদের জন্য যারা যোগ ধ্যানের আদর্শ এবং কর্তব্যকর্মের মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ ত্যাগের মাধ্যমে ঈশ্বর লাভ এবং ঈশ্বর সেবা করতে চান। এই সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা সোসাইটির আশ্রম কেন্দ্রে বসবাস করেন এবং বিভিন্ন পদানুসারে পরমহংস যোগানন্দজির বিশ্বব্যাপী কাজে সেবাদান করেন যার মধ্যে আছে, নিভৃতাবাস ও ক্লাস পরিচালনা এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক এবং সাংগঠনিক কাজ করা, প্রতিমাসে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে আধ্যাত্মিক উপদেশ দেওয়া ও তাঁর শিক্ষার বিষয়ে পথনির্দেশ দেওয়া, সোসাইটির বিভিন্ন দাতব্য কাজ পরিচালনা করা। বিভিন্ন বয়স এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার সন্ন্যাসীরা সারা দেশের সমস্ত অংশ থেকে আসেন।

যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এর গুরুগণ: এই গুরুগণ হলেন — ভগবান কৃষ্ণ, জিশু খ্রিস্ট এবং আধুনিক কালের কয়েকজন উচ্চকোটি মহাপুরুষের পরম্পরা। এঁরা হলেন যথাক্রমে, মহাবতার বাবাজি, লাহিড়ী মহাশয়, স্বামী শ্ৰীযুক্তেশ্বর ও পরমহংস যোগানন্দ। ভগবান কৃষ্ণের মূল যোগতত্ত্ব ও জিশু খ্রিস্টের শিক্ষাবলির মধ্যে যে একটি সমন্বয়বোধ ও মূলগত অভিন্নতা বর্তমান, তা প্রতিপন্ন করাই হল ওয়াইএসএস/এসআরএফ-এর অধ্যাত্মসাধনার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিশ্বের সব মানুষের কাছে ঈশ্বরানুভূতিলাভের বাস্তবসম্মত অধ্যাত্মবিজ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার যে ব্রত যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ গ্রহণ করেছে, এই গুরুগণ তাঁদের দিব্য উপদেশ ও সহায়তার মাধ্যমে ওই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সাহায্য করেন। গুরুর আধ্যাত্মিক অধিকার একজন মনোনীত শিষ্যর হস্তান্তরিত করা যিনি গুরু যে ঐতিহ্যের অংশ তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন একে গুরু পরম্পরা বলা হয়ে থাকে। এইভাবে পরমহংস যোগানন্দর গুরু পরম্পরা হল মহাবতার বাবাজী , লাহিড়ী মহাশয় এবং স্বামী শ্রী যুক্তেশ্বরজি। দেহত্যাগের আগে পরমহংসজি বলে গেছেন ঈশ্বরের ইচ্ছা এই যে তিনিই যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ পরম্পরার শেষ গুরু হবেন। এই সোসাইটির পরবর্তীকালীন কোনো শিষ্য বা নেতা কখনই গুরুর পদ গ্রহণ করবেন না। তিনি বলেছেন “আমি যখন থাকব না শিক্ষাই গুরু হবেন…।শিক্ষার মধ্যে দিয়েই তোমরা আমার সঙ্গে এবং সেই মহান গুরু যারা আমায় পাঠিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।”যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ-রিয়লাইজেশন সোসাইটির অধ্যক্ষর উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পরমহংস যোগানন্দজি বলেছেন: “অবশ্যই উপলব্ধি হয়েছে এমন কোনো নারী বা পুরুষ এই সংস্থার অধ্যক্ষ হবেন। ঈশ্বর এবং গুরু তাঁদের জানেন। তাঁরা আমার আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী এবং মুখপাত্ররূপে সকল আধ্যাত্মিক এবং সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করবেন।”

যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া: পরমহংস যোগানন্দ প্রতিষ্ঠিত সোসাইটি ভারতে এই নামেই পরিচিত। ১৯১৭-তে তিনি এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতার কাছেই দক্ষিনেশ্বরে গঙ্গার ধারে এই সোসাইটির হেডঅফিস, যোগদা মঠ, অবস্থিত। সোসাইটির শাখা আশ্রমগুলি আছে ঝাড়খন্ডের রাঁচিতে, উত্তরাখন্ডের দ্বারহাটে এবং উত্তরপ্রদেশের নয়ডাতে এবং অন্যান্য শাখা কেন্দ্র। ভারতবর্ষের জনহিতৈষী কাজকর্মে সেবা প্ৰদান করার জন্য সারা ভারতে ছড়ানো এর বিভিন্ন ধ্যানকেন্দ্র এবং মন্ডলী ছাড়াও প্রাথমিক স্তর থেকে কলেজ পর্যন্ত বাইশটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। পরমহংস যোগানন্দ উদ্ভাবিত যোগদা শব্দটির মূলে আছে ‘যোগ’ অর্থাৎ “মিলন, সমন্বয়, সমতা” এবং ‘দা’ অর্থাৎ “যা প্রদান করে”। সৎসঙ্গ কথাটির অর্থ হল “দিব্য সাহচর্য” বা “সত্যের সাহচর্য”। পাশ্চাত্যের অধিবাসীদের সুবিধার জন্য পরমহংসজি এই ভারতীয় নামটিকে রূপান্তরিত করে নাম রাখেন “সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ”।

যোগী: যিনি যোগ (দ্র) অভ্যাস করেন। ঐশী অনুভূতিলাভের ইচ্ছায় যিনি বিজ্ঞানসম্মত কোনো প্রক্রিয়া অনুশীলন করেন, তিনিই একজন যোগী। বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত, পার্থিব দায়িত্বপালনে ব্যস্ত কোনো গৃহী অথবা কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত সন্ন্যাসী – যে কেউ যোগী হতে পারেন।

রাজযোগ: ঈশ্বর সঙ্গে যোগাযোগের “রাজকীয়” বা সর্বোচ্চ পন্থা। ঈশ্বরানুভূতিলাভের চূড়ান্ত উপায় হিসেবে বিজ্ঞানসম্মত ধ্যান (দ্র) পদ্ধতির কথাই এতে বলা হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য যোগপদ্ধতির প্রয়োজনীয় সর্বোত্তম অংশকেও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ-এ যে রাজযোগ শেখানো হয়, তা ক্রিয়াযোগ (দ্র) সাধনাকে ভিত্তি করেই রচিত। এতে এমন এক জীবনযাপন পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে যার সাহায্যে দেহ, মন ও আত্মার পূর্ণ বিকাশ হয়। যোগ দ্রষ্টব্য।

রাজর্ষি জনকানন্দ (জেমস জে. লিন): পরমহংস যোগানন্দজির উন্নত শিষ্য এবং ১৯৫৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দেহত্যাগের আগে পর্যন্ত যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ এর অধ্যক্ষ ও আধ্যাত্মিক প্রধান রূপে তাঁর প্রথম উত্তরাধিকারী। মিঃ লিন ১৯৩২ সালে পরমহংসজির থেকে প্রথম ক্রিয়া দীক্ষা লাভ করেন; তাঁর আধ্যাত্মিক উন্নতি এত দ্রুত ছিল যে গুরুদেব ১৯৫১ সালে তাঁকে সন্ন্যাস উপাধি রাজর্ষি জনকানন্দ দেওয়ার আগে পর্যন্ত ভালবেসে “সন্ত লিন” বলে উল্লেখ করতেন।

লাইফট্রনস্: প্রাণ দ্রষ্টব্য।

লাহিড়ী মহাশয়: শ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ীর (১৮২৮-১৮৯৫) পারিবারিক উপাধি ছিল লাহিড়ীমহাশয়, সংস্কৃতে একটি ধর্মীয় উপাধি, যার অর্থ “উদার চিত্ত”। ইনি ছিলেন মহাবতার বাবাজির শিষ্য এবং স্বামী শ্ৰীযুক্তেশ্বর গিরির (পরমহংস যোগানন্দের গুরু) গুরুদেব। এই লাহিড়ী মহাশয়ের কাছেই মহাবতার বাবাজি সেই সুপ্রাচীন বিস্মৃতপ্রায় ক্রিয়াযোগ বিজ্ঞান (দ্র) প্রকাশ করেন এবং প্রকৃত সত্যসন্ধানীদের ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত করার আদেশও দেন। তিনি যোগাবতার নামেও পরিচিত ছিলেন এবং আধুনিক ভারতবর্ষে যোগের নবজাগরণের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তাঁর কাছে আগত অগণিত ঈশ্বরসন্ধানীদের পরামর্শ ও আশীর্বাদ প্রদান করেন। ঈশ্বরদ্রষ্টা এই মহাপুরুষ যেমন বহুবিধ অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী ছিলেন, তেমনি গৃহীর জীবনযাপন করেও নানা সাংসারিক দায়িত্ব তিনি একইভাবে পালন করে গেছেন। তাঁর ব্রত ছিল এমন এক যোগসাধনা প্রচার করা, যেখানে আধুনিক কালের মানুষ তার পার্থিব দায়িত্বভার সঠিকভাবে পালন করার সঙ্গে ধ্যানসাধনার একটা সামঞ্জস্যতাও গড়ে তুলতে পারবে। যোগী কথামৃত গ্রন্থে শ্রীশ্রী লাহিড়ী মহাশয়ের জীবনকাহিনি বর্ণিত হয়েছে।

এই শেয়ার করুন