“কীভাবে নিজ আত্মাকে তৃপ্ত করবেন? সরল জীবনকে উপভোগ করতে শিখুন!” – শ্রী দয়ামাতা

১৬ই নভেম্বর, ২০২২

নীচের অংশটি শ্রীশ্রী দয়ামাতা রচিত “আত্মা দ্বারা পুষ্ট হোন” শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে, যিনি ১৯৫৫ থেকে ২০১০-এ তাঁর জীবনাবসানের আগে পর্যন্ত ওয়াইএসএস/এসআরএফ-এর তৃতীয় অধ্যক্ষ ও সংঘমাতার দায়িত্ব পালন করেন। দয়ামাতার সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি ২০২০-র যোগদা সৎসঙ্গ পত্রিকার এপ্রিল–জুন সংখ্যার ডিজিটাল সংস্করণে পড়া যাবে, যা আমাদের সাইটের যোগদা সৎসঙ্গ পৃষ্ঠায় উপলব্ধ; এছাড়াও এটি যোগদা সৎসঙ্গ পত্রিকার গ্রাহকদের জন্য উপলব্ধ বিস্তৃত অনলাইন গ্রন্থাগারে থাকা অসংখ্য অতীত প্রবন্ধের মধ্যে একটি।

মানবজাতিকে একটি সম্যক আধ্যাত্মিক জীবনের কৌশল আয়ত্ব করতে এবং এক বিশ্ব পরিবার হয়ে সহাবস্থান করতে শিখতে হবে। এই বিস্ফোরণমুখী প্রযুক্তিগত অগ্রগতির যুগে আমরা যে চাপ ও উদ্বেগ অনুভব করছি, তা আমাদের আজ নয়তো কাল এসব পাঠ শিখতে বাধ্য করবে।

পরমহংস যোগানন্দজি বহু আগেই এ কথা উপলব্ধি করেছিলেন এবং আমাদের বহুবার বলেছিলেন: “এমন দিন আসছে, যখন জগতকে সহজ সরল জীবনের দিকে ফিরে যেতে হবে। আমাদের জীবন সহজ করতে হবে যাতে আমরা ঈশ্বরের জন্য সময় বের করতে পারি। আমাদের আরও বেশি করে সচেতন ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে বাঁচতে হবে, কারণ সভ্যতা যত উন্নত হবে, পৃথিবী ততই ছোটো হয়ে আসবে। পক্ষপাতিত্ব, অসহিষ্ণুতা অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে।”

জিশু বলেছিলেন, “একটি গৃহ যদি নিজে থেকে বিভক্ত হয়, তবে তা স্থায়ী হতে পারে না।” বিজ্ঞানের উন্নতি জাতিগুলিকে এত কাছাকাছি এনে ফেলেছে যে এককালে বিশাল বলে মনে হওয়া পৃথিবী এখন অনেকটাই একটি গৃহের মতো, যার প্রতিটি সদস্য পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ও নির্ভরশীল।

আমাদের সময়ের বিচ্ছেদের প্রবণতার মধ্যে একটি ছোটো পরিবারের পক্ষেও একসঙ্গে থাকা যখন এত কঠিন, তখন বৃহত্তর বিশ্বে ঐক্যের আশা কি আছে? আশা আছে — তা ব্যক্তি পরিবার হোক বা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বিশ্ব পরিবারের সম্পর্ক হোক — যদি আমরা সময় বের করে প্রকৃত শান্তি ও আধ্যাত্মিক সহনশীলতার পক্ষে সহায়ক এমন লক্ষ্যে ও মূল্যবোধে মনোনিবেশ করি, তবে একতা সম্ভব…।

আমরা আরো বেশি করে উপলব্ধি করছি, বিশেষত পাশ্চাত্য জগতে, আমরা যে লক্ষ্য এতদিন ধরে অনুসরণ করেছি, সেগুলি আমাদের আত্মাকে সন্তুষ্ট করে না। পরবর্তী প্রজন্মে বা তার কিছু পরেই, আমরা দেখব এই একই উপলব্ধি সেই উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও দেখা দেবে, যেখানে পাশ্চাত্য বস্তুবাদী মূল্যবোধকে অতিরিক্তভাবে পূজিত ও অনুকরণ করা হচ্ছে।

জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য

আমরা বাহ্যিক জীবনের পরিবেশ উন্নত করতে অনেক কিছু অর্জন করেছি, কিন্তু আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনকে অবহেলা করেছি — আমাদের নিজেদের পরিবর্তন ও উন্নয়ন করতে গেলে, নিজেদের জানতে হলে, কেন আমরা জন্মেছি তা বোঝার জন্যে এবং জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে হলে যা একান্ত প্রয়োজন।

পরমহংসজি বলতেন, “জীবনের লক্ষ্য সত্যকে জানা। আমরা হয়তো ভাবতে পারি আমাদের আরও কিছু লক্ষ্য আছে এবং ছোটোখাটো লক্ষ্যও থাকতে পারে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত, এই জীবনে অথবা অন্য কোনো জীবনে, মানুষ এই উপলব্ধিতে পৌঁছোয়, যে তার একটাই মাত্র লক্ষ্য অর্জন করার আছে এবং তা হল নিজেকে সত্যরূপে জানা: আত্মরূপে, ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি রূপে; এবং তাঁকে জানা যিনি সত্য: ঈশ্বর।”…

ধ্যান বাহ্যিক জীবনকে অন্তরের মূল্যবোধের সাথে সুসংগত করে

ধ্যান আমাদের বাহ্যিক জীবনকে আত্মার আন্তরিক মূল্যবোধের সঙ্গে এমনভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে, যেমনটি এই জগতে অন্য কিছু পারে না। এটি পারিবারিক জীবন বা অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে কিছুই কেড়ে নেয় না। বরং, এটি আমাদের আরও ভালোবাসাপূর্ণ, আরও সহানুভূতিশীল করে তোলে — এটি আমাদের মধ্যে স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, প্রতিবেশীদের সেবা করার ইচ্ছে জাগিয়ে তোলে।

প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা তখনই শুরু হয় যখন আমরা কেবল নিজের মঙ্গল কামনা না করে অন্যদের মঙ্গলকেও অন্তর্ভুক্ত করি, যখন “আমি, আমার, আমারটাই।”… এই সঙ্কীর্ণ চিন্তার সীমা ছাড়িয়ে ভাবতে শুরু করি।

অধিকাংশ মানুষ ধ্যান পরিহার করে, কারণ তাদের হাতে সত্যিই সময় নেই তা নয়, বরং এই কারণে যে তারা নিজেদের মুখোমুখি হতে চায় না — যা ধ্যানে অন্তর্মুখী হওয়ার একটি নিশ্চিত ফল। নিজেদের মধ্যে এত বেশি কিছু আছে যা তারা অপছন্দ করে, তাই তারা মনকে বাহ্যিক বিষয়ে ব্যস্ত রাখতেই পছন্দ করে,তাদের যে আত্মোন্নতি করতে হবে সে বিষয়ে কখনও গভীরভাবে চিন্তা করে না। এই ধরনের মানসিক অলসতা থেকে নিজেকে মুক্ত করুন। পতঞ্জলি তাঁর যোগসূত্রতে বলেছেন, মানসিক জড়তা আধ্যাত্মিক অগ্রগতির অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক। এটি আমাদের দিয়ে বলায়, “আচ্ছা, ঈশ্বর, কাল তোমাকে চিন্তা করব। তুমি আমাকে যে সকল দুশ্চিন্তা দিয়েছ তা নিয়ে আজ আমি খুবই ব্যস্ত।”…

এই আত্মতুষ্টির দুঃখজনক পরিণতি হল, অধিকাংশ মানুষ তখনই তাদের আধ্যাত্মিক অবস্থার উন্নতির চেষ্টা শুরু করে, যখন তাদের হৃদয় যন্ত্রণায়, দুঃখে, হতাশায়, কষ্টে বিদীর্ণ হয়ে পড়ে। তখনই তারা ঈশ্বরের সন্ধানে মুখ ফেরায়। কিন্তু কেন এত কষ্ট সইবার অপেক্ষা করা? এখনই ঈশ্বরকে অনুভব করা এতটাই সহজ কেবল যদি আমরা একটু ধ্যান করার চেষ্টা করি।

আনন্দে বাঁচুন

ঈশ্বরে কেন্দ্রীভূত একটি জীবন কী অসাধারণভাবে আলাদা এবং তৃপ্তিদায়ক তা পরমহংস যোগানন্দজি আমাদের দেখিয়েছেন: “জগন্মাতা, আমাকে শেখাও কীভাবে আনন্দে বাঁচা যায়। আমার পার্থিব কর্তব্য ও সৃষ্টির অসংখ্য সৌন্দর্য যেন আমি উপভোগ করতে পারি। আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দাও যাতে আমি প্রকৃতির বিস্ময়কর জগৎ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি ও তার প্রশংসা করতে পারি। সব নিষ্পাপ আনন্দ যেন আমি তোমার উচ্ছ্বাসে উপভোগ করতে পারি। আমাকে অস্বীকৃতি ও অযথা আনন্দ-হন্তা মনোভাব থেকে বাঁচাও।”

আমার মনকে এই কথাটি বিশেষভাবে আকর্ষণ করে: “সব নিষ্পাপ আনন্দ যেন আমি তোমার উচ্ছ্বাসে উপভোগ করতে পারি।” মানুষ ভাবে, যখন ঈশ্বরের সন্ধান করবে, তখন তাকে খুব গম্ভীর হয়ে থাকতে হবে! কিন্তু এই মিথ্যে গাম্ভীর্য আত্মার নয়। আমি যে কয়জন সাধুসন্তের সান্নিধ্যে এসেছি, তাঁদের সঙ্গ করেছি, পরমহংসজিকেও অন্তর্ভুক্ত করে — সবাইকে আমি দেখেছি আনন্দময়, স্বতঃস্ফূর্ত, শিশুর মতো সরল। আমি বলছি না শিশুসুলভ মানে অপরিণত বা দায়িত্বজ্ঞানহীন — বরং বলছি, শিশুর মতো সরলতা, যে সহজ আনন্দ উপভোগ করতে জানে, যে আনন্দে বাঁচে। 

জীবনের প্রকৃত আনন্দ

আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতায় মানুষ জানেই না কীভাবে সহজ বিষয় উপভোগ করতে হয়। তাদের রুচি এতটাই ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছে যে কিছুতেই তৃপ্তি পায় না: বাহ্যিকভাবে অতিমাত্রায় উত্তেজিত, অথচ অন্তরে শূন্য ও অনাহারগ্রস্ত, তাই তারা পালিয়ে যাওয়ার জন্য মদ বা মাদকে আশ্রয় নেয়। সমসাময়িক সংস্কৃতির মূল্যবোধ অসুস্থ, অপ্রাকৃতিক; এই কারণেই এটি প্রকৃতপক্ষে সুসংহত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ এবং ভাঙনমুক্ত পরিবার তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। এবং এই সমস্যাটি কেবল একটি দেশের নয়; এই মূল্যবোধজনিত অসুস্থতা আজ সমস্ত দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে, এমনকি ভারতে পর্যন্ত।

আসুন, জীবনের সহজ সরল আনন্দগুলোর কাছে আমরা আবার ফিরে যাই। উদাহরণস্বরূপ, আপনার ছুটির দিনে কি কখনও, পাহাড়ে গাড়ি চালিয়ে গেছেন অথবা মরুভূমি কিংবা অন্য কোনো নির্জন স্থানে গিয়ে পিকনিক করেছেন, চুপচাপ বসে ঈশ্বরের কথা ভেবেছেন? এইগুলোই প্রকৃত আনন্দ; যখন আপনি প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করার সংবেদনশীলতা অর্জন করেন, তখন এইসব অভিজ্ঞতা কতই না আনন্দ দেয়।

সমুদ্রের ওপর দৃষ্টিপাত করাই হোক অথবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্যপট — এমনকি সুন্দর ঘাস, সুন্দর গাছপালা — আমি এর মধ্যে এক অপূর্ব রোমাঞ্চ অনুভব করি। এটি আমরা প্রত্যেকেই করতে পারি।

আপনি হয়তো বলবেন, “আহ, এটা খুবই বিরক্তিকর লাগবে।” কিন্তু একবার চেষ্টা করে দেখুন, সিনেমা দেখতে যাওয়ার পরিবর্তে, যেখান থেকে আপনি সাধারণত ফিরে আসেন অস্থিরতা ও মনখারাপ নিয়ে। আপনি আনন্দ পেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আপনাকে খুশি করল না। তার পরিবর্তে, প্রকৃতির সৌন্দর্য ও নির্জনতার স্থান খুঁজুন এবং সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের নিঃশব্দ কণ্ঠস্বরকে শোনার চেষ্টা করুন। তা আপনার হৃদয়ে কী গভীর শান্তিই না আনবে!

কীভাবে পরমহংস যোগানন্দ এক আধ্যাত্মিক সরলতাপূর্ণ গভীর আনন্দ ও শান্তিময় জীবনযাপনের জন্য ব্যবহারিক উপায় ও নির্দেশ দিয়েছেন, আপনি যদি সে বিষয়ে আরো জানতে চান তবে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগদা সৎসঙ্গ পাঠমালা পেজটি দেখুন, এটি একটি ঘরে-বসে পাঠ-এর পাঠমালা যা পরমহংসজি ধ্যানের বিজ্ঞান ও সম্যক জীবনযাপন শৈলীর জন্য তাঁর ব্যক্তিগত নির্দেশ প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এই শেয়ার করুন