১৯২৫-এ মাদার সেন্টার উৎসর্গকালীন পরমহংস যোগানন্দের অনুপ্রাণনা থেকে — “যেখানে সত্যের সার বিরাজ করবে”

৩ অক্টোবর, ২০২৫

২০২৫ সালটি চিহ্নিত হয়েছে পরমহংস যোগানন্দের সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের আন্তর্জাতিক সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী — যেখানে তিনি ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করতেন, শিক্ষা দিতেন আবার ঈশ্বরের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে কথোপকথন করতেন। ১৯২৫-এর অক্টোবরে তিনি এটিকে উৎসর্গ করেন।

লস অ্যাঞ্জেলস-এর মাউন্ট ওয়াশিংটনের উপরে অবস্থিত ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ সদর দপ্তর সর্বদাই শুধুমাত্র এক বৃহৎ সংস্থার প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়, তার থেকেও অনেক বেশি কিছু। একশ বছর আগে পরমহংস যোগানন্দ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে, মাদার সেন্টার (পরমহংসজির ভালোবেসে দেওয়া নাম) একটি আশ্রম, “জীবনের শিক্ষাকেন্দ্র,” বিশ্বজুড়ে অগণিত হাজার হাজার মানুষের তীর্থস্থান — এবং ঈশ্বরসন্ধানীদের একটি বৈচিত্র্যময় আধ্যাত্মিক পরিবার; জ্ঞানোদ্দীপ্ত গুরু এবং তাঁর ক্রিয়াযোগ শিক্ষার একনিষ্ঠ শিষ্যদের আবাসস্থল।

১৯২৫-এ মাউন্ট ওয়াশিংটন সেন্টারের উৎসর্গের সময় পরমহংসজির অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্য এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রার্থনার কিছু উদ্ধৃতি এখানে দেওয়া হল। এই কথাগুলি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল “অ্যাট মাউন্ট ওয়াশিংটন উইথ দ্য মাস্টার অ্যান্ড হিজ ডিসাইপলস” প্রবন্ধে, যা যোগদা সৎসঙ্গ-এর “শরীর, মন ও আত্মার আরোগ্যকল্পে নিবেদিত পত্রিকা”-র ২০২৪-এর বার্ষিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৩৪-এ এসআরএফ আন্তর্জাতিক সদর দপ্তরের সামনে দণ্ডায়মান পরমহংস যোগানন্দের ডিজিটাল রঙিন ছবি (মূল কালো-সাদা ছবি থেকে ২০২৩-এ এসআরএফ দ্বারা নির্মিত)

মাদার সেন্টারের উৎসর্গ অনুষ্ঠানে পরমহংসজির বক্তৃতা:

আপনাদের স্বাগত জানাই আমাদের গৃহে, যেখানে সত্যের সার বিরাজ করবে। এখানে গোঁড়ামিকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই। এখানে কোনো গোঁড়ামিবাদের মতবাদ রাজত্ব করবে না। সত্য সমস্ত অন্ধকার এবং বিভেদ সৃষ্টিকারী সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামিকে দূর করে। সত্যের আলোকে, সহনশীলতার আলোকে, পারস্পরিক বোঝাপড়ার আলোকে, আমি আপনাদের সকলকে স্বাগত জানাই।

আমি বিশেষ করে তাদের সকলকে স্বাগত জানাই যারা এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলতে আমাকে সাহায্য করেছেন এবং আপনাদের সকলকে যারা আমাদের সাথে কর্মে, সদিচ্ছায়, এমনকি চিন্তাভাবনায় সহযোগিতা করেছেন। আমি আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই। আমি আমার ভূমিকা পালন করছি; এবার আপনাদের ভূমিকা পালন করার দায়িত্ব।

আসুন, আমরা এখানে এমন এক যুক্তিনিষ্ঠ শিক্ষার মানসিকতা পুষ্ট করতে পরস্পর সহযোগিতা করি, যা সমগ্র বিশ্বে আলোকপাত করবে — পৃথিবীর সকল জাতি থেকে অজ্ঞতাকে দূর করে নির্মূল করবে। সেই চেতনায় আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, হাতে হাত মিলাই, সহযোগিতা করি — কেবল বস্তুগতভাবে নয় বরং আত্মার ঐক্যবন্ধনে; আর সেই ভিত্তির ওপরেই এক প্রকৃত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হবে।

আমি এখন একটি প্রার্থনা করব — কোনো আনুষ্ঠানিক প্রার্থনা নয় বরং আমার আত্মা হতে স্বতঃস্ফূর্ত। দয়া করে সোজা হয়ে বসুন, আপনার শরীর এবং মনকে শিথিল করুন এবং আসুন আমরা মনে প্রাণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রার্থনা করি। আমার প্রার্থনাকালে মনে মনে পরম ভক্তিভরে, আমার সাথে যোগ দিন।

“হে পরমাত্মা! তুমি মহিমান্বিত উজ্জ্বল আলোক, এসো, এখানে অধিষ্ঠিত হও! তোমার সত্যের আলোকে আমাদের পরিপূর্ণ কর; তোমার চিরন্তন আলোকের দ্বারা আমাদের অন্তরের সকল অন্ধকার দূর কর!

“হে অদৃশ্য আলোক, যারা অন্ধকারের গভীরে ডুবে আছে তাদের কাছে দৃশ্যমান হও! এই পবিত্র অনুষ্ঠানে আমাদের সাহায্যের জন্য এসো। তোমার চিরন্তন দীপ্তিতে আমাদের দীপ্ত কর। শেখাও, সত্যের দিশারী আলোক ঊর্ধ্বে ধরে রাখতে, যা সমস্ত অন্ধকার দূর করবে! যেখানে তোমার আলোক, সেখানে অন্ধকার থাকতে পারে না।

“এসো, হে পরমাত্মা, এসো! তোমার সত্যের মশালে প্রতিটি আত্মাকে প্রজ্জ্বলিত করো, যাতে প্রত্যেকে খ্রিস্টের আত্মায় অনুপ্রাণিত হয় — যাতে প্রত্যেকে অনুভব করতে পারে যে খ্রিস্ট যেমন ঈশ্বরের সন্তান, আমরা প্রত্যেকেই সমভাবে ঈশ্বরের সন্তান! তোমার প্রকৃত সন্তানদের মতো আমাদেরও জীবন গড়তে শেখাও, ঠিক যেমন জিশু, কৃষ্ণ, বুদ্ধ! তারা তোমার এক সর্বজনীন সত্যের আদর্শ উদাহরণ।

“এসো, হে পরমাত্মা, এসো! আমাদের প্রতিটি কোশের বেদিতে নেমে এসো। আমাদের শোণিত তোমার শক্তিতে পরিপূর্ণ হোক! তোমার প্রাণময় উপস্থিতি আমাদের অনুভব করতে দাও!

“হে পরমাত্মা, আমাদের অমরত্বের শক্তি দিয়ে আবৃত কর! সেবার মনোভাবে আমাদের আবৃত কর! সকলের প্রতি সহনশীলতা এবং প্রেমপূর্ণ মনোভাবে আমাদের ভরিয়ে তোলো! এবং যারা আমাদের অমঙ্গল চিন্তা করে, তাদের সকলের প্রতি, তোমার সর্বশক্তিমান প্রেমের মাধ্যমে অন্তরের বিদ্বেষকে গ্রাস করতে শেখাও! অন্ধকারে নয়, হে পরমাত্মা, তোমার সর্বব্যাপী প্রেমের আলোকে যেন মনোনিবেশ করি!

“তোমার প্রেম আমার হৃদয়ে বিরাজিত। আমার আত্মা তোমার প্রেমে স্পন্দিত! আমার আত্মা পরিপূর্ণ তোমার প্রেমে! তোমার অমর সত্তা থেকে, আনন্দের চিরন্তন উৎস থেকে আমার আত্মা প্রস্ফুটিত!

“তোমার আলো আমাদের মধ্যে নিয়ে এসো; চিরউদ্যম জাগিয়ে তোলো। তোমার চেতনায় প্রতিটি দিনের যেন এক নতুন সূচনা হয়! আমাদের শেখাও তোমার উপস্থিতিকে প্রতিদিন নতুন ও মহিমান্বিত উপায়ে অনুভব করতে — নতুন আনন্দে! আমাদের মধ্যে তোমার প্রাণময় ঝর্ণার উন্মোচন কর, সেখান হতে যে কেউ পান করবে সেই জীবনকে আস্বাদ করবে!

“আমাদের আশীর্বাদ কর, হে পরমাত্মা! লস অ্যাঞ্জেলসকে আশীর্বাদ কর! আমার আমেরিকা, আমার ভারত, আমার পৃথিবীকে আশীর্বাদ কর!

“আমাদের আশীর্বাদ কর! আমাদের আশীর্বাদ কর! আমাদের আশীর্বাদ কর!”

[পরবর্তী অনুষ্ঠানে, পরমহংসজি মাউন্ট ওয়াশিংটন সেন্টার সম্পর্কে তাঁর মনোভাব এই কথায় প্রকাশ করেন:]

এর উদ্দেশ্য হল যথার্থ শিক্ষা, আধ্যাত্মিক শিক্ষা। যথার্থ শিক্ষা কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক বা শারীরিক শক্তি বিকাশই করে না বরং আপনার আত্মাকে সত্যের সুবাসে সুরভিত করে। এটি আপনার আত্মাকে আলোকিত করবে। এখানকার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির শিক্ষায় শারীরিক ও মানসিক দক্ষতার সঙ্গে আপনাকে শেখানো হবে বর্তমান সভ্যতার সাথে নিজেকে — আপনার আত্মাকে — মানিয়ে নেওয়ার নীতি।

১৯২৬-এ মাদার সেন্টারে প্রবেশ

এই প্রতিষ্ঠানটি আপনাদের অন্তর্মুখী হতে এবং সর্বত্র ঈশ্বরকে অনুভব করতে শেখাবে। অনেকেই মনে করেন ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে অরণ্যে বা পর্বতে পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমি সবসময় বলি যে, যদি অন্বেষণকারীরা শহর ছেড়ে অরণ্যে যায়, তাহলে আমাদের অরণ্যে শহর তৈরি করতে হবে! এখানে যে আধ্যাত্মিক শিক্ষা শেখানো হবে তা আপনাদের ঈশ্বরকে বলতে সক্ষম করবে, যেমন আমি করি:

“আমি ভেবেছিলাম তোমার উপস্থিতি নদীর ধারে,
অথবা অনেক দূরে উপত্যকা বা পাহাড়ের কোণে;
কিন্তু এখন আমি প্রতিটি বাতাসে তোমাকে দেখতে পাই,
আর শান্ত চাঁদের আলোয় তোমার উপস্থিতি অনুভব করি।

“তুমি সর্বত্রই বিরাজমান!
আর সবচেয়ে বেশি খুঁজে পাই তোমাকে আমার মাঝে।
আমি ভাবতাম তুমি অনেক দূরে,
কিন্তু যোগদার* উদয়ের সাথে সাথে আমি প্রতিদিন জানি,
তোমার শক্তি আমার অনুভূতির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তুমি আমার চিন্তায় আছ তুমি আমার মধ্যে বিরাজিত।
এবং সেখানে, অন্তরে, আমি তোমাকে খুঁজব, তোমাকে অনুভব করব, তোমার সঙ্গে সংযোগ করব!”

সর্বোপরি, সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক মানদণ্ড অনুযায়ী জীবনযাপন করার উপায় আপনাদের সামনে দৃষ্টান্তরূপে এই প্রতিষ্ঠান স্থাপন করবে। প্রত্যেককে “সম্যক জীবনযাপন” নীতির শিক্ষায় শিক্ষা দিতে হবে, যার দ্বারা তারা আপনা-আপনিই সুখী হবে। আধ্যাত্মিক হওয়াই সুখী হওয়া; আর যারা আধ্যাত্মিক নয়, তারা কখনোই স্থায়ী সুখ পায় না। তাই এই ভাবটিই সর্বদা স্পন্দিত করবে এই প্রতিষ্ঠান। আমার শরীর হয়তো চলে যাবে, কিন্তু আমার এই ইচ্ছা এখানে চিরকাল স্পন্দিত হবে — এক অদৃশ্য স্পন্দন অবিরাম সম্প্রচার করবে: “এসো! এসো! এসো, সবাই! যারা দুঃখী, যারা পীড়িত, যারা অন্ধকারে দিশাহারা — শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করো!”

* আমেরিকায় তাঁর মিশনের প্রাথমিক বছরগুলিতে, পরমহংস যোগানন্দ তাঁর শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশের শিক্ষার জন্য “যোগদা” শব্দটি একটি সাধারণ শব্দের মত ব্যবহার করেছিলেন; এবং তাঁর সংগঠনের নাম ছিল “যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ আমেরিকা”। ১৯৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি সোসাইটির নাম রাখলেন সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ। (ভারতে তাঁর কাজের জন্য পূর্বের নামটি এখনও ব্যবহৃত হয়, যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া।) সেই সময় থেকে, তিনি “এসআরএফ শিক্ষা” বা “সেল্ফ-রিয়লাইজেশন শিক্ষা” র মত “যোগদা শিক্ষা” (অথবা কেবল “যোগদা”) নামের উল্লেখ করেন।

যোগদা সৎসঙ্গ ম্যাগাজিনের ২০২৫-এর বার্ষিক সংখ্যায় সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ মাদার সেন্টারের প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপনের প্রবন্ধের একটি অংশ রয়েছে।

এই শেয়ার করুন