১৯২৫-এ পরমহংস যোগানন্দ সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের আন্তর্জাতিক সদর দপ্তর (এসআরএফ মাদার সেন্টার)-এর ভবনটি অধিগ্রহণ করেন এবং সেই বছরের ২৫শে অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উৎসর্গ করেন। মাদার সেন্টারের শত তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে, কয়েক বছর আগে মাদার সেন্টার উপাসনাগৃহে দেওয়া শ্রী দয়ামাতার একটি বক্তৃতার কিছু অংশ এখানে দেওয়া হল, যখন তিনি এই কেন্দ্রের প্রথম দিকের ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যেখান থেকে পরমহংস যোগানন্দের শিক্ষা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এই উদ্ধৃতাংশটি যোগদা সৎসঙ্গ পত্রিকার ২০০০-এর বার্ষিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
এই নিবন্ধে, শ্রী দয়ামাতা মাঝে মাঝে গুরু এবং ওয়াইএসএস/এসআরএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা পরমহংস যোগানন্দকে “মাস্টার” বলে উল্লেখ করেছেন, যা নিজের গুরু এবং এক আত্মজয়ী ব্যক্তির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সম্ভ্রমপূর্ণ একটি শব্দ; অথবা “গুরুজি” বলেও উল্লেখ করেছেন।
গুরুদেব পরমহংস যোগানন্দের বিশ্বব্যাপী মিশনের কাহিনী — এবং অবশ্যই মাউন্ট ওয়াশিংটনে আমাদের সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠার কাহিনী, এক প্রেমপূর্ণ ত্যাগ এবং ঈশ্বরের প্রতি অবিচল বিশ্বাসের কাহিনী।
আপনারা তাঁর যোগী-কথামৃততে যেমন পড়েছেন, ১৯২০-তে যেদিন ঈশ্বর তাঁকে সমাধি অবস্থায় দেখিয়েছিলেন যে তাঁকে আমেরিকায় আসতে হবে, ঠিক সেই দিনই তিনি রাঁচিতে তাঁর প্রিয় স্কুল এবং আশ্রম ত্যাগ করেন – ঈশ্বর তাঁকে যা করতে বলছেন তা কীভাবে সম্পন্ন করবেন তার কোনো প্রস্তুতি, কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই তখনই রওনা হয়ে গেলেন। এইটাই তাঁর ধরণ ছিল: ঈশ্বরে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। যখন তিনি এই দেশে প্রথম এসে পৌঁছোলেন, তখন এখানে কাউকেই চিনতেন না। কিন্তু তাঁর ছিল ঐশ্বরিক উৎসাহ এবং ঈশ্বরের প্রতি এক শিশুসুলভ আস্থা – এতটাই সম্পূর্ণ এবং এতটাই নির্মল এবং এক মহান আধ্যাত্মিক চৌম্বকশক্তি, যা তিনি যেখানেই যেতেন, আত্মাদের আকৃষ্ট করতেন।
দেবদূতদের শহরে আগমন
১৯২৪-এ, বোস্টন এবং অন্যান্য পূর্বতটীয় শহরগুলিতে সফলভাবে শিক্ষা প্রচারের পর তিনি তাঁর বহু আন্তর্মহাদেশীয় বক্তৃতা-সফরের প্রথম সফরটি শুরু করেন। এই সফরের সর্বশেষ গন্তব্য ছিল লস অ্যাঞ্জেলস যেখানে তিনি ১৯২৫-এর জানুয়ারিতে এসে পৌঁছেছিলেন।
বক্তৃতামালা শেষ হলে যে শিষ্যরা তাঁকে সাহায্য করছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজনকে গুরুদেব বলেন: “এসো, লস অ্যাঞ্জেলস-এ, দেবদূতদের শহরে, এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করি যেখানে আমরা একটি কেন্দ্র স্থাপন করতে পারব। আমি এখানে একটি অপূর্ব আধ্যাত্মিক স্পন্দন অনুভব করছি।” বহুকাল ধরে তিনি অনেকবার বলেছেন যে আধ্যাত্মিক সম্ভাবনার দিক থেকে লস অ্যাঞ্জেলস হল আমেরিকার বেনারস। ভারতের সেই পবিত্র শহরের সাথে তুলনা, এই শহরের জন্য এক বিরাট প্রশংসার কথা।
কেন্দ্র স্থাপনের উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করার জন্য কিছু প্রচেষ্টা করা হয়। গুরুদেব আর তাঁর কয়েকজন ছাত্র মিলে একদিন মাউন্ট ওয়াশিংটনের চূড়ায় যাওয়ার আঁকাবাঁকা পথ ধরে গাড়ি করে একটি বাড়ি দেখতে যান, যে বাড়িটি বিক্রি হচ্ছিল। এটি ছিল স্যান রাফায়েল অ্যাভিনিউয়ের ওপর একটি ছোট কাঠের ফ্রেমের বাড়ি (যেটি পরে স্থানীয় লাইব্রেরির শাখা হিসেবে ব্যবহৃত হত)। গুরুদেব সেই ছোট্ট বাড়িটির দিকে একবার নিরুৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেটিকে কোনো সম্ভাবনা থেকে সরাসরি বরখাস্ত করে দিলেন। তাঁর সঙ্গিসাথীরা বোঝাবার চেষ্টা করল যে এটি একদম ঠিক হবে, কিন্তু গুরুদেবের কাছে তাদের দৃষ্টিকোণ খুবই সীমিত মনে হয়েছিল। চিন্তাভাবনায় তিনি ছিলেন বিস্তৃত এবং দূরদর্শী; এছাড়াও, তিনি জানতেন যে ঈশ্বর এই কাজের জন্য আরও ভালো কিছু ভেবে রেখেছেন!
“এই স্থানটিই আমাদের মনে হচ্ছে!”
ফেরার পথে তাঁরা এই প্রাঙ্গনটি অতিক্রম করছিলেন যেটি ওপরে যাওয়ার সময়ই গুরুদেবের নজরে পড়েছিল। তিনি জোর দিয়ে বললেন যে গাড়ি থামানো হোক যাতে তিনি বাড়িটি দেখতে পারেন — এক বিশাল পুরোনো বাড়ি, যেটি একসময় “মাউন্ট ওয়াশিংটন হোটেল” নামে এক আভিজাত্যপূর্ণ হোটেল ছিল। (এটি প্রাক্তন কালের লস অ্যাঞ্জেলস-এ সুপরিচিত ছিল – একটি রিসর্ট যেখানে মানুষ ব্যস্ত নগরীর কোলাহল থেকে দূরে সরে আসত। মাউন্ট ওয়াশিংটন তখন প্রায় এক জনহীন এলাকা ছিল। লোকেরা এখানে ছুটি কাটাতে আসত, ঠিক যেমন তারা এখন মরুভূমিতে বা অন্য কোনো সুন্দর জায়গায় যায়। সেই সময়ের কিছু চ্যাম্পিয়ন টেনিস খেলোয়াড়েরা এখানে, মূল রাস্তা থেকে নীচে টেনিস কোর্টে, প্রদর্শনী টেনিস ম্যাচ খেলতেন।)
গুরুদেব বললেন, “ভিতরে যাওয়া যাক।” তাঁর সঙ্গের এক বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন শিষ্য বলে উঠল, “গুরুদেব, এত বড় বাড়ি বোধহয় ঠিক হবে না!”
তিনি কথাটা একেবারেই কানে তুললেন না। টেনিস কোর্টের ওপরে দাঁড়িয়ে, বাড়িটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তিনি বললেন, “এই জায়গাটা ঠিক আমাদের মনে হচ্ছে!”
শিষ্যটি এর বিরুদ্ধে অনেক যুক্তি দেবার চেষ্টা করল — এত বড় কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়; এত লোকের একসাথে থাকার সমস্যা, যেখানে প্রত্যেকে নিজ মত অনুযায়ী চলতে চায়। কিন্তু সমস্যা নয়, সম্ভাবনাকেই গুরুদেবের মনে দৃঢ় সংকল্প এবং সাহসে পূর্ণ করেছিল – আর ঈশ্বরের নির্দেশ মত এই কাজ করার জন্য সাহসেরই প্রয়োজন ছিল।
নির্দ্বিধায় তিনি এই বিশাল ভূসম্পত্তিটি কিনে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর কিছু উদার ছাত্রদের সহায়তা এবং গুরুদেবের নিজের কাঁধে দুটি বন্ধকের ভার নিয়ে, ১৯২৫-এ সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ মাদার সেন্টারের জন্ম হয়…।
প্রারম্ভিক সময়ের সংগ্রাম
এই অগ্রণী কাজটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গুরুদেবকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। আমার মনে আছে একবার মাউন্ট ওয়াশিংটনের বাড়িটির বন্ধকের কিস্তি জমা দেওয়ার সময় এসে গিয়েছিল কিন্তু আমাদের কাছে কোনো সংগতি ছিল না। সেই সময় মিলওয়াকি-র এক অত্যন্ত ধনী মানুষ এখানে থাকতেন। সাংসারিক মানুষ হলেও যোগ সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ ছিল, এবং এখানে তিনি শিখতে এসেছিলেন। তিনি জানতেন যে গুরুদেবের বন্ধক নিয়ে অসুবিধে ছিল, তাই তিনি একটি প্রস্তাব নিয়ে গুরুদেবের কাছে এসেছিলেন। প্রস্তাবটি ছিল এই যে তিনি বন্ধক শোধ করে দেবার সমস্ত টাকা দিয়ে দেবেন যদি গুরুদেব তাঁকে প্রাচ্যের এই অদ্বিতীয় শিক্ষাবলিকে ব্যবসায়িক দিক থেকে লাভজনক করে তোলার জন্য সামান্য কিছু পরিবর্তন করার অনুমতি দেন।
সেই প্রারম্ভিক সময়ে আমাদের কাছে একটিও বাড়তি পয়সা ছিল না। এমন অনেক দিন গেছে যখন আমাদের রাত্রের খাওয়া শুধু একটু লেটুস সুপ ছিল। এক নিম্নমানের গুরু হয়ত এই অতি প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য পাওয়ার জন্য এই প্রস্তাবটি মেনে নিতেন এবং পরে এই চুক্তি থেকে বেরোনোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু গুরুদেব নন। যে সন্ধ্যায় তিনি আমাদের কাছে এই লোকটির প্রস্তাব সম্বন্ধে বললেন, সেই সন্ধ্যাটি আমি কখনও ভুলব না। “এ হল জগন্মাতার প্রলোভন,” তিনি বলেছিলেন। “এই দেখ একজন আমাকে এই বন্ধকের ভার থেকে, আর এই বাড়ি আর এখানকার সব বাসিন্দাদের দেখাশোনা করার ভার থেকে মুক্ত করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে; এখানে ‘হ্যাঁ’ বলে দেওয়া খুবই সহজ হত। কিন্তু আমি আমার আদর্শের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে পারি না। অর্থের জন্য আমার আদর্শকে নীচে নামানোর থেকে আমার কাজের অন্ত হওয়া ভালো।” আর তিনি প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
জেমস জে. লিনের সাথে সাক্ষাৎ এবং বন্ধক পরিশোধের আনন্দ
এই অভিজ্ঞতার অনতিবিলম্বে, ১৯৩২-এর ফেব্রুয়ারিতে, গুরুদেব কানসাস সিটিতে একাধিক ক্লাস নিয়েছিলেন। যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মিঃ জেমস জে. লিন, একজন ধনী ব্যবসায়ী যিনি সত্যের গভীর জিজ্ঞাসুও ছিলেন। তাঁকে দেখামাত্র গুরুদেব চিনতে পেরেছিলেন যে ইনিই সেই ভক্ত যিনি বহু জন্ম ধরে তাঁর সাথে ছিলেন। ইনিই ছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য যিনি পরে রাজর্ষি জনকানন্দ নামে পরিচিত হন।
এই সময়ে, বন্ধকধারী কর্তৃক সদয়ভাবে সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া সত্ত্বেও বন্ধকের কিস্তি দিয়ে ওঠার কোনো উপায় গুরুদেব তখনও খুঁজে পাননি। রাজর্ষি জনকানন্দ তাঁর উদারতা এবং ভক্তির সঙ্গে, কেবলমাত্র এই একটি কিস্তির জন্যই গুরুদেবকে অর্থ দেননি, বরং মাউন্ট ওয়াশিংটনের সম্পত্তির সম্পূর্ণ বন্ধক শোধ করে দিয়েছিলেন। যেহেতু গুরুদেব এর আগে প্রলোভনকে প্রতিহত করেছিলেন এবং নিজের নীতিকে নীচে নামিয়ে আনেননি, যেমন মরুভূমিতে খ্রিস্ট প্রলোভনকে প্রতিহত করেছিলেন, জগন্মাতা তাঁকে তাঁর যা কিছু প্রয়োজন ছিল তার চেয়ে আরও বেশি করে সব দিয়েছিলেন।
বন্ধকের দলিলটি যখন গুরুদেবের হাতে তুলে দেওয়া হল, কি আনন্দই না হয়েছিল! আমরা “পর্ণ মন্দির”-এর পাশে একটি অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করে দলিলটি তার মধ্যে সমর্পণ করেছিলাম। অত্যন্ত ব্যবহারিক হওয়ায়, গুরুদেব রান্নাঘর থেকে অনেকগুলো আলু নিয়ে এসে কয়লার টুকরোগুলির নীচে দিয়ে দিয়েছিলেন। পরে আমরা সবাই আগুনের চারধারে বসে সুস্বাদু সেঁকা আলু খেলাম।
অগণিত জিজ্ঞাসুদের জন্য আধ্যাত্মিক আশ্রয় এবং মন্দির
গুরুদেবের প্রিয় মাউন্ট ওয়াশিংটনে কাটানো সেখানকার বছরগুলোর দিকে ফিরে তাকালে আমার হৃদয় অজস্র স্মৃতিতে প্লাবিত হয়ে ওঠে—যে স্থানটি প্রতিষ্ঠা করতে তিনি নিজেকে কতখানি উৎসর্গিত করেছিলেন; আর যেটি তীর্থস্বরূপ সংরক্ষণ করা আমাদের পরম পবিত্র সৌভাগ্য। এটি সারা বিশ্বের তাঁর অগণিত ভক্তদের আধ্যাত্মিক আবাস।
এই সমস্ত জায়গায় গুরুদেব ভাবাবেশে ধ্যান করতেন, প্রায়শই জগন্মাতা অথবা আমাদের মহান গুরুগণ বা অন্যান্য সন্তদের দিব্যদর্শনে কৃপাধন্য হতেন। মাউন্ট ওয়াশিংটনের উপাসনাগৃহে, আসিসির সেন্ট ফ্রান্সিসের এক দিব্যদর্শন থেকে তাঁর কবিতা “ঈশ্বর! ঈশ্বর! ঈশ্বর!” অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
এখানেও তিনি প্রতি বছর খ্রিস্টমাসের সময় খ্রিস্টের সাথে গভীর ও দীর্ঘ দিব্যসংযোগ স্থাপনের জন্য একটি সম্পূর্ণ দিন উৎসর্গ করার প্রথাটি চালু করেছিলেন, যা ১৯৩১-এ, আশ্রমে আমার প্রথম খ্রিস্টমাস থেকে শুরু হয় — এবং ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে এই প্রথা মাউন্ট ওয়াশিংটন থেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। প্রকৃতপক্ষে তাইই হয়েছে।
অন্যান্য সময়ে তিনি আমাদের দীর্ঘক্ষণ ধরে আনন্দময় ভক্তিপূর্ণ কীর্তনে নেতৃত্ব দিতেন, যে সময়ে কখনো কখনো আমাদের তাঁর রচিত নতুন ঈশ্বরপ্রেমের গান প্রথম শোনার সৌভাগ্য হত।
সত্যিই, তিনি এখানে যে দিব্য স্পন্দন রেখে গেছেন তা পূর্ব ও পশ্চিমে আমি যত তীর্থস্থান পরিদর্শন করেছি তার মধ্যে অনন্য। এই ভূমিতে প্রথম পদার্পণের এত বছর পরেও, আমি কখনও আনন্দের এক বিরাট রোমাঞ্চ অনুভব না করে এর দ্বার দিয়ে প্রবেশ করিনি।
আমরা আপনাকে এসআরএফ ওয়েবসাইটে সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের আন্তর্জাতিক সদর দপ্তরের একটি প্রতিবিম্বিত চিত্র দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। এই “প্রতিবিম্বিত চিত্রের তীর্থযাত্রা”-টি পরমহংস যোগানন্দের এসআরএফ প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে, ক্রিয়াযোগের শিক্ষা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ২০২০-তে প্রস্তুত করা হয়েছিল।



















