
সম্প্রতি যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ (ওয়াইএসএস/এসআরএফ)-এর অধ্যক্ষ ও আধ্যাত্মিক প্রধান শ্রীশ্রী স্বামী চিদানন্দ গিরি ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত পরিক্রমা করেছেন। সফরকালে স্বামীজি রাঁচি, নয়ডা ও দক্ষিণেশ্বর আশ্রম পরিভ্রমণ করেন এবং হায়দ্রাবাদে ওয়াইএসএস সঙ্গম ২০২৩-এরও সভাপতিত্ব করেন।
স্বামীজির ভারত ভ্রমণকালে গণমাধ্যম সমূহের প্রতিবেদনের কিছু অংশ এখানে দেওয়া হল।

স্বামী চিদানন্দজির সাথে একটি সাক্ষাৎকার — সংস্কার টিভি
সংস্কার টিভিতে সম্প্রতি সম্প্রচারিত ওয়াইএসএস/এসআরএফ-এর অধ্যক্ষ ও আধ্যাত্মিক প্রধান স্বামী চিদানন্দ গিরির সাথে এক প্রেরণাদায়ক সাক্ষাৎকার দেখতে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই। এই জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় স্বামী চিদানন্দজি যোগের সারমর্ম ও আমাদের ব্যস্ততম আধুনিক বিশ্বে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং আমাদের নিজেদের মধ্যে ঈশ্বরের উপলব্ধি ও সকলের মধ্যে তাঁকে অনুভব করতে ক্রিয়াযোগ ধ্যানের গভীর কার্যকারিতা প্রসঙ্গে বর্ণনা করেছেন।

দ্য পায়োনিয়ার-এ প্রকাশিত এক ধারাবাহিক আলোচনা — স্বামী চিদানন্দজির সাথে চিন্তন
ইংরেজি সংবাদপত্র“দ্য পায়োনিয়ার” পৃথিবী ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বামীজির এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। সব নিবন্ধই (নিম্নে বর্ণিত) দশ খন্ডে দ্য পায়োনিয়ার-এ প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন: স্বামীজি, ভারতে আমাদের রামায়ণ, গীতা আর উপনিষদের মত শাস্ত্র পাঠের পরম্পরা আছে। যারা যোগানন্দজির শিক্ষার পাঠক, ওইসকল জ্ঞান কি এই পাঠমালায় অন্তর্ভুক্ত? তাদের কি সেগুলোও পাঠ করা প্রয়োজন?
তাছাড়া, মাঝে মাঝে কেউ কেউ আমাদের কোনো কোনো বই পড়তে বা কোনো বিশেষ প্রেরণাদায়ী কথা শুনতে পরামর্শ দেন। অন্য মতবাদ সম্বন্ধে না ভাবা অথবা অন্যান্য আধ্যাত্মিক বই পড়তে অনাগ্রহ কি ভক্তের আত্মিক উন্নাসিকতা হবে?
স্বামী চিদানন্দজি: না! এটা আনুগত্য! আর এটা প্রকৃতপক্ষে নির্ভর করে একজন পথের কোন অবস্থানে আছে। এটা স্বাভাবিক যখন আপনি পথের সম্বন্ধে শুধুমাত্র অনুসন্ধান করছেন ও তুলনা করছেন, “ওহ! ওই বক্তৃতাটা শোনা যাক আর দেখা যাক ওটা বেশি অর্থবহ না এটা বেশি অর্থবহ।” তাহলে ঠিক আছে। তবে, গুরুদেবের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা সেইসব ক্রিয়াবান শিষ্যদের যোগানন্দজি বিশদে জানিয়েছেন অধ্যাত্ম শক্তি শুধুমাত্র একটি পথ ধরে আসে, আর সেই পথ হল তার ঈশ্বরদত্ত গুরুর পথ।
এবার, এমনকি এটা বোঝার জন্য তুল্যমূল্য ও সাধারণ বোধ দরকার। এটা এমন নয় যে আপনাকে সন্ত্রস্ত হতে হবে বা কিছু এড়িয়ে যেতে হবে। অন্যান্য অনেকের প্রেরণাদায়ী গল্পগুচ্ছ থেকে অনেক বিচিত্র প্রেরণা ও উৎসাহ আপনি পেতে পারেন অথবা বৈজ্ঞানিক তথ্য যা সত্যিই মনকে উদ্বুদ্ধ করতে সাহায্য করে আর আমাদের গুরুদেব যা শিখিয়েছেন তা সমর্থন করে। এটা আপনার নিজের গুরুদেবের সাধনা গ্রহণ করার পরে অন্যান্য অধ্যাত্ম নির্দেশ বা আধ্যাত্মিক পদ্ধতি গ্রহণ না করার বিষয় মাত্র।
প্রথমত, যোগানন্দজির ভক্ত হিসাবে ইতিমধ্যেই আপনি শাস্ত্র পড়ছেন — ‘গীতা’; আর পাশ্চাত্যের জন্য এগুলো খ্রিস্টের উপদেশাত্মক শিক্ষা। ওই দুটোই বিস্ময়কর শাস্ত্র। আমরা বলছি না,“আপনারা শাস্ত্র পাঠ করা ছেড়ে দিন।” কিন্তু সমস্ত শাস্ত্রপাঠ করা কি খুব জরুরি? না! কারণ, ভক্তের যা কিছু জরুরি গুরুদেব শাস্ত্র থেকে সেসব নির্যাস নিয়েছেন আর সাধনার ব্যবহারিক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অনেকে (আর বিশ্বের এমনই ধারা) কিছু শাস্ত্র পড়েন আর ভাবেন, “ঠিক আছে, আমি আমার কর্তব্য করেছি।” কিন্তু আপনার যা প্রয়োজন তা এভাবে পাবেন না। আপনি আত্মিক চৈতন্য চান, আপনি পরমপিতার সাথে সজীব প্রাণবন্ত সম্পর্কের চেতনা চান। বই পড়ে এমনকি শাস্ত্র পড়েও আপনি তা পেতে সক্ষম হবেন না।
সুতরাং, শাস্ত্রপাঠ দোষণীয় নয়। এগুলো অপূর্ব ঠিকই, এতে প্রচুর প্রেরণাদায়ক উপাদান আছে এবং সঠিক আচারের জন্য অনেক নিত্য উপযুক্ত নীতি আর অনেক অনেক গভীর আধ্যাত্মিক সত্য আছে। সুতরাং, আমি বলব একজন ভক্তের জন্যে ওয়াইএসএস পাঠমালার অধ্যয়ন ও ধ্যানের থেকে বেশি সময় এতে ব্যয় করে পড়া প্রয়োজনীয় নয়। গুরুদেব বলেছেন, আপনি একঘন্টা যদি পড়েন তবে তার দ্বিগুণ সময় আপনার ভাবনা লিখুন আর আরো বেশি সময় গভীরভাবে চিন্তা করুন। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল ধ্যান। বই পড়া আমাদের অবিরতভাবে প্রেরণা জোগাতে পারে, তবে অনুশীলনে ধরে না রাখতে পারলে প্রেরণার মূল্য সত্যিই খুব সীমিত।”
প্রশ্ন: যোগানন্দজি বলেছেন, “কখনই হার না মানা পাতকই একজন সাধক।” তবে, কখনও কখনও প্রথম আধ্যাত্মিক পথ চলা শুরু করা একজন মানুষের এমন অনুভূতিও হতে পারে তারা এর জন্য তৈরী নয়। আমাদের জাগতিক অভ্যাস আর পার্থিব ব্যবস্থায় আমরা এমনিই নিমগ্ন, যে কেউ আধ্যাত্মিক পথে নিরুৎসাহ হতে পারে হয়ত এমন ভেবে “এখানে এনারা সবাই সাধু আর আমি এক পাপী তাঁদের মাঝে বসে!”
স্বামী চিদানন্দজি: সব মানুষ, বিশেষভাবে আধ্যাত্মিক পথের মানুষরাও এই এক সর্বাত্মক ভ্রান্তির শিকার। আমাদের সবারই কিছুটা নিরহঙ্কারতা থাকে আর এই নিরহঙ্কারতা ভুলভাবে পরিচালিত হয়ে আত্মসম্মান কমিয়ে দেয় বা নিজেকে হীন ভাবায়।
তবে মনে করুন, অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি-তে সবথেকে প্রেরণাদায়ক কোনটি, যোগানন্দজিকে একজন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “আমার গুরুদেব শ্রীযুক্তেশ্বরজির এই কথা: ‘অতীতের কথা একদম ভুলে যাও। সব লোকেরই অতীত জীবন কোনো না কোনো লজ্জা বা গ্লানিতে কালিমা লিপ্ত হয়ে আছে। তুমি যদি এখন থেকেই আধ্যাত্মিক উন্নতির চেষ্টা শুরু করো, তাহলে ভবিষ্যতে তোমার সর্ব বিষয়েই উন্নতি লাভ হবে,তা জেনে রেখো।’” এটাই মনোনিবেশ করার এক সদর্থক উপায়।
শুনতে একটু কটু লাগলেও কোনো একটা সময়ে অনেকে নিজের সম্পর্কে যুক্তি খাড়া করে, “এপথে আর সবাই আমার থেকে বেশি এগিয়ে আছে, একমাত্র আমিই এখানে পুরোই ব্যর্থ”, পরে এটাই প্রচেষ্টা না করার একটা অজুহাত হয়ে দাঁড়ায়। নিজের মনে আসা এমন প্রবণতার মোকাবিলা করতে মনকে আদেশ দিন, “থামো! আমি তোমায় শুনছি না ! দূর হটো !” — ঠিক যেমন কোনো খ্যাপা লোক আপনার দরজায় দাঁড়িয়ে আপনাকে “ওহ, তুমি একটা সাংঘাতিক লোক, কোনো কাজের না” বললে আপনি যেমন করেন। কেন না ঠিক এমনটাই এক্ষেত্রেও হচ্ছে।
অহং-এর সাথে সংলগ্ন এই ভ্রম আপনার আছে আর এদের প্রধান উদ্দেশ্য আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা থেকে আপনাকে বিরত করা। সাধারণত নিজের সম্বন্ধে উদাসীনতা নিজেকে আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা থেকে নিবৃত রাখার সব থেকে বাস্তবিক উপায়। তাই, আপনাকে একজন “অধ্যাত্ম যোদ্ধা” হয়ে ওঠার জন্য একে প্রতিহত করতে হবে। পরমহংস যোগানন্দজি তাঁর ভগবদ গীতা-র (গড টকস উইথ অর্জুন) ১ম পরিচ্ছেদে লিখেছেন যে তারা কৌরব যোদ্ধা, আপনার চিন্তা-ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে ও আপনার বিজয়ী অধ্যাত্ম প্রকৃতির দাবি থেকে আপনাকে বিচ্যুত করে ঘুরে দাঁড়াতে বাধা দেয়।
এটা কিন্তু নিজের থেকে আসে না। এতে ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন হয়, দৃঢ়সংকল্প ও অন্তঃকরণের শক্তির প্রয়োজন হয়। তবে নিজে নিজে “আমার কোনো উন্নতি নেই, আর সবাই কত এগিয়ে যাচ্ছে” এমন ভাবা সবথেকে ক্ষতিকর। এমন ভাবনা একদম বাদ দিন আর গুরুদেবের লেখা বই যেমন “হোয়ার দেয়ার ইজ লাইট” বা“আধ্যাত্মিক ধ্যান” থেকে সদর্থক কিছু নিন। এইজন্যই গুরুদেব আমাদের সদর্থক সংকল্প দিয়ে বলেছেন, “আমি ঈশ্বরের সন্তান, ঈশ্বরের প্রতিরূপেই আমি সৃষ্টি হয়েছি”। নিজের সম্বন্ধে ভুল ধারণার এইরকম সব প্রবঞ্চনা উপড়ে ফেলতে এগুলো কাজে লাগে। আর ধ্যান ও সদর্থক সংকল্পের মাধ্যমেই এমন করা যায়।
প্রশ্ন: যোগানন্দজি বলেছেন, “প্রেমের পথই ঈশ্বরকে জানার সব থেকে সরল পথ”। ধ্যানের পথ কিভাবে “প্রেমের পথ” হবে? যোগ কি আমাদের “নিঃশর্ত” প্রেমের উপলব্ধি ও প্রকাশে পরিচালিত করতে পারে?
স্বামী চিদানন্দজি: হ্যাঁ ! হ্যাঁ ! অবশ্যই। কেননা ধ্যানে আমাদের নিজেদের মধ্যে ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করি, আর তারপর সেই চেতনা প্রসারিত হয়ে প্রথমে অবচেতনে বা সূক্ষ্ম স্তরে, আর পরে আরও প্রকট ও সচেতন মাত্রায় অন্যান্য মানুষের মধ্যে, প্রত্যক্ষ ভাবে সমস্ত সত্তার মাঝে ঈশ্বরের উপস্থিতি আমরা জানতে পারি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ঈশ্বরই পরমপ্রিয় সত্তা। সবাই যদি জানতে পারত ঈশ্বর কী……ঈশ্বরই সুন্দর ও আনন্দ, প্রসন্নতা ও সেবা-পূর্ণতা, আর স্বাভাবিকভাবে আমাদের শ্রদ্ধা ও অনুভূতির দাবি করা সেইসব অপরূপ গুণাবলি। দয়ামাতাজি যেমন বারবার বলেছেন নিজের মধ্যে সেই প্রেম উপলব্ধি করার চাবিকাঠি প্রেমের উৎসে যাওয়া। এটাই ছিল তাঁর সারা জীবনের মূল ভাব। তিনি বলেছেন, “আমি প্রেম চেয়েছিলাম, মানুষের অপূর্ণতাদুষ্ট নয় এমন প্রেমের উপলব্ধি চেয়েছিলাম”। তিনি বলেছেন, “আমি ঈশ্বরের প্রেম পেতে যাচ্ছি এটা প্রথম থেকেই মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম”। আর কিভাবে কেউ ঈশ্বরের কাছে যাবে? ধ্যানের মাধ্যমে! তাঁর লেখা বই “ওনলি লাভ” এই ব্যাপারে পরিপূর্ণ।
প্রশ্ন: স্বামীজি, কিভাবে আমরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ঘৃণা প্রতিরোধ করতে পারি?
স্বামী চিদানন্দজি: “আচ্ছা, এক নম্বর হল বিশ্বজনীনতা ও সহানুভূতিশীলতার প্রতিরূপ ও উদাহরণস্বরূপ হওয়া এবং অন্যান্য ধর্মীয় পরম্পরার প্রতি শ্রদ্ধা যেরকম আমাদের গুরুদেবের (যোগানন্দজির) পরম্পরা ও শিক্ষায় আমরা পাই।
“ভক্তদের জন্যে এটা মনে করা একটু বেশি আশাব্যঞ্জক অভিপ্রায় হয়ে যাবে যে তারা হঠাৎ করেই নিজের থেকে সাম্প্রদায়িক হিংসা বন্ধ করতে যাবেন। এটা একটা ক্রমবিকাশ জনিত বিষয়। তবে আমাদের প্রত্যেকেই অংশগ্রহণ করতে পারি – এক নম্বর হল, শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিশীলতার আদর্শের প্রতিরূপ এবং সমস্ত ধর্মের সাধারণত্বের ওপর সত্যসত্যই আলোকপাত করা আমাদের গুরুদেবের রচনা বা বইগুলি যথাসম্ভব মানুষের মধ্যে সহভাজন করে। উদাহরণস্বরূপ, গুরুদেবের বই: “ধর্ম বিজ্ঞান”, “মানুষের চিরন্তন অন্বেষণ”-এর কিছু অধ্যায় বা এরকম অন্যান্য বই, যাতে এইরকম আদর্শ আরো আরো বেশি করে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। আর তারপর অবশ্যই যখন একজন নিজেকে এমন পরিবেশে পাবে যেখানে কেউ অন্য পথের অনুসারীদের সম্বন্ধে অরুচিকর বা অবমাননাকর মন্তব্য করছে, আর যদি সেখানে সসম্মানে ও শান্তভাবে প্রতিবাদ করার সুযোগ থাকে, তবে শুধু বলুন যে দুনিয়াতে যথেষ্ট ঘৃণা ছড়িয়ে আছে যদিও এটা আর বাড়াতে সেভাবে কাজে লাগবে না। এ কিন্তু এমন নয় যে আমাদের সংশোধক হতে হবে অথবা অন্য মানুষদের নিয়মানুবর্তী করতে হবে, তবে আপনার আশপাশে কেউ সেরকম ব্যবহার করলে প্রতিবাদ করতে পারেন। তবে সবথেকে বড়ো কথা, প্রায় সবার জন্যই এই প্রশ্নের উত্তর যে ভক্তের জীবনযাপন করা আসলে বিশ্বজনীন মনোভাব নিয়ে জীবনযাপন করা যা আমরা ওয়াইএসএস পাঠমালা থেকে শিখতে পারি। আপনারা জানেন, সময়ের সাথে সাথে সমাজে পরিবর্তন আসবে। তবে আমি কোনো ভক্তকে প্রত্যক্ষভাবে বর্ণবৈষম্য প্রতিরোধে উৎসাহিত করব না যদি না তারা সক্ষম থাকেন।
প্রশ্ন: সম্প্রতি হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত ওয়াইএসএস পরিচালিত সঙ্গমে প্রায় ৩২০০ ভক্ত অংশগ্রহণ করেছিলেন। ভক্তরা সঙ্গম অনুষ্ঠানে প্রাপ্ত আশীর্বাদ কিভাবে সাথে নিয়ে ঘরে ফিরতে পারেন?
স্বামী চিদানন্দজি: আমি আপনাদের বলব কেন এব্যাপারে আমার উত্তর তিন বছর আগে যা হত তার থেকে আলাদা হবে। সৎসঙ্গের মূল নীতিকে ধরা যাক —আধ্যাত্মিক সঙ্গ।
এই ব্যাপারে পরমহংস যোগানন্দজির এমনই একটি মূলকথা ‘ইচ্ছাশক্তির থেকেও পরিবেশ শক্তিশালী’। আমরা যেরকম সঙ্গ করি সেরকমই হয়ে যাই। এমনকি যদি আমরা ব্যবসায় বা খেলাধূলায় অথবা যে কোনো ক্ষেত্রে সফল হতে চাই, আপনার সহযোগীরা যেরকম আপনিও সেরকম হয়ে যান। দলগত চেতনা আমাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ওপর প্রভাব ফেলে। ভক্তদের সপ্তাহে একবার বা দুবার সমবেত ধ্যানে আসা উচিত বলেই যোগানন্দজি একদম প্রথম থেকেই জোর দিয়েছেন। সৎসঙ্গে থাকার এটি একটি পথ।
দ্বিতীয় বিষয়টি সামনে আসে বিগত দুবছরে যখন কোভিড মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল আর ধ্যানকেন্দ্র ও আশ্রমগুলি লকডাউনে থাকাতে সবাইকে ঘরে থাকতে হয়েছিল। লকডাউনের মাত্র কয়েকমাস আগে ভক্তদের অনলাইনে একত্রিত হয়ে সমবেত ধ্যান ও সমবেত সৎসঙ্গ করার জন্য ভিডিও সম্মেলন করে আমরা অনলাইন ধ্যানকেন্দ্র উদ্বোধন করেছিলাম। এই তিন বছরের বিচ্ছিন্নতায় সেটাই সারা পৃথিবীর ভক্তদের জন্য এক সত্যিকারের জীবনরক্ষাকারী প্রতিপন্ন হয়েছে। এখন এমনকি আপনি বাড়ির বাইরে না বেরোতে চাইলেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার সৎসঙ্গের জন্য সঠিক পরিবেশ সৃষ্টিতে অসাধারণ সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে।
তৃতীয় বিষয়টি হল…….”ভক্তের প্রচেষ্টা সর্বদা পরমপিতার সাথে ভক্তের পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়া গুরুর সাহায্যে প্রবুদ্ধ হয় বলে আপনি একবার পরমহংস যোগানন্দের মতো জ্ঞানদীপ্ত পুরুষের সাথে আধ্যাত্মিক সংযোগ গড়ে তুললে কখনোই আর আপনাকে একা একা ধ্যান করতে হবে না। গুরুর সাথে সৎসঙ্গ — আমি ধ্যানকেন্দ্রে থাকি, কম্পিউটারের সামনে থাকি অথবা যে কোনো অবস্থায় — বাহ্যিক পরিবেশ নির্বিশেষে এটা আয়ত্তাধীন তাই একভাবে এটাই সৎসঙ্গের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় রূপ।”
“আমি সর্বদা এখানে (কূটস্থ নির্দেশ করে) এই নিশ্চিত আশ্রয়ে আছি, আত্মার এই নিভৃত আবাসে, ভক্ত এবং গুরুর মধ্যে যে সৎসঙ্গ বিদ্যমান তা কখনই এক মুহূর্তের জন্যও হারিয়ে যায় না। এটা সর্বদাই সেখানে বিদ্যমান।”
প্রশ্ন: স্বামীজি, যুবাদের প্রকৃত সাফল্য অর্জনে কিছু পরামর্শ দেবেন কি?
স্বামী চিদানন্দজি: “প্রথমত, অনুভব করুন আমার শরীর আছে, মন আছে, তবে আমিই আত্মা — অন্তর্নিহিত শক্তি। নিজের জীবন এবং নিজের প্রতিটি লক্ষ্য সুসংগঠিত করার জন্যে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়াই প্রকৃত সাফল্য। আপনি ঐহিকতাকে উপেক্ষা করতে পারেন না, আপনি বুদ্ধিগত ও শিক্ষাগত বিকাশকে উপেক্ষা করতে পারেন না, আর অবশ্যই আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশকেও উপেক্ষা করতে পারেন না।
“এদের প্রতিটিকে সময় দেওয়ার কোনো এক ধারাকে অবলম্বন করে জীবনে সাফল্য আসে। ঠিক এমনটিই আপনি যোগদা সৎসঙ্গ পাঠমালায় পাবেন। সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনের সম্পূর্ণ দিশা নির্দেশ: শারীরিক সুস্বাস্থ্য, মানসিক সক্ষমতা, শিক্ষা ও ধীশক্তির অনুশীলন এবং বিচারবুদ্ধির গুণাবলী সবই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
“তারপর ধ্যান শিখতে বেশ কিছুটা সময় দিন। হতেই পারে সকালে ১০ মিনিট আর সন্ধ্যায় ১০ মিনিট (এভাবে ঠিক হয়না কারণ একবার ১০ মিনিট করলে, ২০ মিনিট করতে চাইবে, আর একবার ২০ মিনিট করলে আরও বেশি সময় করতে চাইবে……এভাবে ধ্যান ঠিক কার্যকরি হয়!)
“তবে আসল কথা হল……সফল হতে গেলে আপনাকে জীবনের জন্য পরিকল্পনা রচনা করতে হবে……সফল হবার জন্য অপেক্ষা করে কেউ সফল হতে পারে না। আমাদের প্রত্যেকের হাতে থাকা দিনের ২৪ ঘন্টা সময়কে আপনার সাজিয়ে নিতে হবে। আপনাকে এটা দেখতে হবে আর সচেতনে আপনার সময়ের পরিচালনা করে সচেতনভাবে আপনার বাসনার জন্য সময়ের ব্যবহার করতে হবে।”
প্রশ্ন: আমাদের সন্তানদের কিভাবে পরমহংস যোগানন্দজির যোগ-ধ্যান শিক্ষায় কৌতুহলী করে তুলতে পারি? ওয়াইএসএস বা এসআরএফ-এর কি ধ্যানের সাথে ছোটোদের পরিচয় ঘটানোর মতো সাহিত্য আছে?
স্বামী চিদানন্দজি: “পিতামাতারা তাদের সন্তানদের মধ্যে যে গুণাবলি দেখতে চান, খুশি থাকার মাধ্যমে, পরিপূর্ণ থাকার মাধ্যমে, সেই গুণাবলির প্রতিরূপ হবার মাধ্যমে সেই শিক্ষার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন। আপনি সন্তানদের বলতে পারেন না যেমন বলছি সেরকম করো, আমি কি করছি সেরকম নয়। ‘ এটা কখনই কার্যকরী হয় না। আর অন্যভাবে, যিনি মুখে কিছুই বলেন না অথচ তার জীবনযাত্রায় অন্যদের প্রতি দয়া, মর্যাদা ও শ্রদ্ধা এবং আত্মসঙ্কল্প প্রকাশ পায়, ‘আমি যেমন হব, আমার জীবন তেমনিই হবে’, সন্তানদের ওপর তার প্রভাব ফেলে।
“…সন্তান সবসময়ই শেখার অবস্থায় থাকে, তাই পিতামাতাকে তাদের জন্য উদাহরণ হয়ে উঠতে হবে। প্রাথমিক বছরগুলিতে তাদের মস্তিস্ক ও স্নায়ু শেখার জন্য উচ্চমাত্রায় গতিশীল থাকে। শিশুর মন এতই নমনীয়, এতই শিক্ষণীয় হয় যে তাকে নেতিবাচক বা ইতিবাচক যে কোনো ছাঁচে ঢালা যায়। আজকের দুনিয়ায় পিতামাতাদের দায়িত্বের ওপর জোর দেওয়া হয় না বলে আমি এটা খুব দৃঢ়ভাবে অনুভব করি। আপনি যদি পৃথিবীতে সন্তান আনতে চান, আপনাকে দায়িত্বশীল হতে হবে। তার মানে এই নয় যে আপনাকে সব সর্বাধুনিক ভিডিও গেম, পোশাক-পরিচ্ছদ, এই বিশেষ চল বা ওই ধরনের গ্যাজেট আর এরকম সব কিনতে হবে। না, আপনাকে এমন একজন মানুষ হতে হবে যিনি সন্তানের জন্য আদর্শ হতে পারবেন।”
আজকের নারীরা এক পরিবর্তনশীল অবস্থায় আছেন
প্রশ্ন: ভারতে (খুব সম্ভবত বলা যায় সারা পৃথিবীতেই), পরিবারের কেন্দ্রে সাধারণত মা থাকেন – পরিবারের দেখভাল, গৃহস্থালির দায়িত্ব, কাজ আর সমস্ত ধরণের প্রত্যাশা পূরণে আটকে থাকেন। বহুবিধ দায়িত্ব কাটছাঁট না করে ও পরিবারিক সমন্বয় বিঘ্নিত না করে মহিলারা কিভাবে প্রতিদিন যোগানন্দজির নির্দেশমত দুবেলা ধ্যান করবেন?
স্বামী চিদানন্দজি: “এটা বেশ লম্বাচওড়া দায়িত্বের তালিকা, তাই না? এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। সারা বিশ্বে ভারত এবং অন্যান্য আরও উন্নত দেশে আজ যে পরিস্থিতিতে নারীরা আছেন, সেটা এক পরিবর্তনশীল অবস্থা। নারীদের শুধুমাত্র ‘শুধু ঘরে থাকো আর রান্নাবান্না ও ঘরকন্নার কাজ করো’ এমন খুবই শ্বাসরোধী ও বদ্ধ অবস্থার থেকে একটা প্রজন্মে এসে নারীদের এত কিছু করতে বলা হয়। ওইটি বর্বরোচিত আর আদিম ছিল। সেই সাথে, আমরা প্রায় এক মধ্যর্বর্তী পর্যায়ে আছি যখন নারীরা যথার্থভাবেই তাদের নিজেদের উন্নতির জন্য তাদের ব্যক্তিগত পছন্দসই পথ খুঁজে নিতে পারে। তবে, প্রকৃত আধ্যাত্মিক সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন গৃহে ও কর্মস্থানে পুরুষ ও নারীর সম্যক ভূমিকার কদর করে।
“আমি সবটাই বুঝি আর নারীরা কি ভাবে এমন সহ্য করে সেটা আমি জানি না। সাধারণভাবে নারী পুরুষের তুলনায় শক্তিশালী হয় কারণ তাদের অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাদের দু-তিনটে দুরন্ত কৃতি সন্তানসহ নামি সংস্থার অধিকারিক হতে হবে, দু-তিনটে সুন্দর আর বড় বাড়ি থাকতে হবে, থাকতে হবে নিখুঁত শরীর ও স্বাস্থ্য আর এরকম সব – নারীদের “স্বয়ংসম্পূর্ণা” হবার এমন ভাবনা পোষণের কোনো প্রয়োজন নেই। এগুলি শুধুই চাপের বোঝা, বেশিদিন টেঁকে না আর দুর্ভাগ্যবশত পুরো সমাজই এখনও সঠিক ভারসাম্যের সন্ধান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা এখনও জানি না কিভাবে সেখানে পৌঁছোন যাবে আর এই পরিস্থিতি যা আপনি বর্ণনা করলেন, কাটিয়ে না ওঠা পর্যন্ত সহ্য করতে হবে। তাড়াতাড়ি কাটিয়ে ওঠা গেলেই মঙ্গল।”
প্রশ্ন: স্বামীজি, বিশ্বজনীন অধ্যাত্ম সভ্যতার ক্রমবিকাশে ভারতের আধ্যাত্মিকতা কি ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন?
স্বামী চিদানন্দজি: “এটা আমাদের গুরুদেব পরমহংস যোগানন্দের মতো আমারও মর্মকথা আর মূল উদ্দেশ্যেগুলির মধ্যে অন্যতম যার সাধনে তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন। ভারতের আধ্যাত্মিকতার কথা বলতে গেলে, সভ্যতার সেই স্বর্ণময় যুগের দিকে তাকানো যাক যে সময় গীতা, যোগসূত্র আর উপনিষদ এসেছে। আপনি এখানে এই ধর্মের বা ওই ধর্মের অথবা কোনো একটা জাতিগত নয় এমন সার্বজনীন শিক্ষা দেখতে পাবেন, এটা সারা বিশ্বের মানুষের অবস্থার কথা বলে। সেজন্যই ‘সমস্ত পৃথিবী একটাই পরিবার’ [‘বসুধৈব কুটুম্বকম’], আর ‘সত্য একই, যদিও ঋষিগণ বিভিন্ন নামে সেটা বলেছেন’ [‘একম সদ, বিপ্র বহুধা বদন্তি’] এরকম সুন্দর বিবৃতি আপনি উপনিষদে পাবেন।
“আদর্শ ধর্ম হওয়া উচিত: ‘সকল প্রাণী সুখী হোক’, সকল প্রাণী দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত হোক, এমন কিন্তু বলেনা ‘সব ভারতীয়রা সুখী হোক’, বা ‘সব হিন্দুরা সুখী হোক, মুসলিমরা বা খ্রিস্টানরা নয়’ অথবা এরকম সব, কারণ আমরা সবাই, আমাদের প্রত্যেকেই সেই একই পরমপিতার অংশ। আমরা ক্রমবিকাশের একটা ধাপ দেখতে এসেছি: আমরা একে অপরকে ভাই-বোন বলে চিনতে পারছি নাকি একে অন্যকে ধ্বংস করছি আর সেই সঙ্গে পরিকল্পনা করছি।
“বিশ্ব ভারতকে খুব শ্রদ্ধার নজরে দেখে”
“ভারতের ভূমিকার দিক থেকে দেখলে, যেহেতু বিশ্ব ভারতকে খুব শ্রদ্ধার নজরে দেখে তাই ভারত তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার নিজের ঐশ্বরিক ও অমর ঐতিহ্যের আদর্শ ও দৃষ্টান্ত বিশ্বকে দিতে পারে। আপনি পাশ্চাত্যে না গিয়ে থাকলে হয়ত জানবেন না, তবে হয় অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি পড়ে না হয় ভারত থেকে আমেরিকায় আসা কোনো না কোনো অধ্যাত্ম গুরুর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে বিশ্বের এই প্রজন্মে বেড়ে ওঠা অনেক মানুষ ভারতকে জেনেছে আর এটা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার ও দক্ষিণ আমেরিকার জন্যেও সত্য। আধ্যাত্মিকভাবে বললে লক্ষ লক্ষ মানুষ মানবতার ক্ষেত্রে ভারতকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতো শ্রদ্ধা করে।
“নিঃসংশয়ে দুভাবে বিশ্ব অধ্যাত্ম সভ্যতায় উন্নত হচ্ছে — একটা হল বস্তুতান্ত্রিক উপায়ে — কারিগরিবিদ্যা, যোগাযোগ ও ভ্রমণের মাধ্যমে। কয়েকটা প্রজন্ম পিছনে যদি দেখেন, আমেরিকা থেকে ভারতে ভ্রমণ এক বিরাট ব্যাপার ছিল অনেক মানুষের জন্যেই সম্ভবপর ছিল না। আর এখন ব্যাঙ্গালোর বা শিকাগো ভ্রমণ করতে হলে প্লেনে চড়ে বসলেই হল। মানে, পৃথিবীটা ছোটো হয়ে গেছে। এটা এখন আর নানাবিধ স্বতন্ত্র দেশ ও সভ্যতার সংকলন নয়।
“ইন্টারনেট সত্যিই মানবসমাজের কাঠামোটাই বদলে দিয়েছে। এটা সত্যিই মানব পরিবারকে একটা শরীরের মতো করে সংযুক্ত করা স্নায়ুতন্ত্রের মতো হয়ে উঠেছে। কিহয়, আপনি যখন মানুষকে একে অন্যের সংযোগে আনেন, একে অপরের সাথে আরও সৌহার্দ্যপূর্ণ হন। যেন আপনি একই বাড়িতে বাস করা একই পরিবারের সদস্যদের মতো আছেন। দুর্ভাগ্যবশত, আপনি পরিবারের এমন সদস্যদেরও দেখে থাকবেন যারা একে অন্যের সাথে কামড়াকামড়ি করতে থাকছে। তা হোক, মনুষ্যসমাজে এমনটা হলেও এটা কয়েকটা প্রজন্মের বেশি স্থায়ী হবে না।
“আমাদের এখন ব্যাপক ধ্বংস করার প্রভূত ক্ষমতা আছে, এটা শতবছর আগেও ছিল না। প্রযুক্তিগত শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে আর দুনিয়া হাতের মুঠোয় চলে আসাতে স্মরণাতীত কালে আগের তুলনায় অনেক বেশিভাবে মুখ্যত আমরা একটা পরিবার হয়ে আছি। এখন আমাদের একইরকম ‘আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধন’ থাকতেই হবে, আত্মনিয়ন্ত্রণে থাকার মতো এক আধ্যাত্মিক পরিপক্কতা থাকতে হবে, পছন্দ না করলেও যেন কাউকে অবহেলা না করি। আমি যে সুখ ও নিরাপত্তা, শান্তি ও সাফল্যের খোঁজে চলেছি, সব মানুষেরই তা দরকার, এটা বোঝার মতো আমাদের সে আধ্যাত্মিক পরিপক্কতা অবশ্যই থাকতে হবে। আর পরিশেষে সে বুঝতে পারে ‘আমার চারপাশের মানুষ সুখী না হলে আমি ঠিক সুখী হতে পারব না।’ আপনি শুধুমাত্র এটা ওই দেশের ব্যাপার বা সেই দেশের ব্যাপার বলে এড়িয়ে যেতে পারেন না কারণ এটা সারা বিশ্বে প্রভাব ফেলে। দেখুন রাশিয়া আর ইউক্রেনে কি ঘটেছে। শত বৎসর আগের দুই প্রতিবেশী দেশ একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করত। আর এখন এদের মধ্যেকার সবাই প্রধানমন্ত্রী মোদী থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সবাই বলছেন একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা এরকম করতে পারি না। বস্তুতান্ত্রিক কারিগরিবিদ্যার সাথে সাথে সমান্তরালভাবে আধ্যাত্মিকতার বিকাশ ঘটাতেই হবে।
প্রশ্ন: ব্যস্ত জীবনে কিভাবে মানুষ ধ্যানের জন্য সময় বের করবে?
স্বামী চিদানন্দজি: “পৃথিবী যেমন আরও বেশি করে স্থূল ভোগসর্বস্বতায় পরিচালিত হয়ে ক্রমাগত জটিল হয়ে উঠছে — ধ্যান, অস্তিত্বের এক দক্ষতা বলে মানুষ উপলব্ধি করছে। অন্তর্জগতে শান্তির এইরকম কোনো উৎস বা ঝর্ণায় আপনার প্রবেশাধিকার না থাকলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবেন। এটাই ধ্যান আমাদেরকে এনে দেয়।
“মানুষকে কি প্রেরণা যোগাবে ও কিভাবে তারা সময় পাবে এই প্রসঙ্গে আপনি তাদের কাছে জানুন তারা কিভাবে ঘুমানোর সময় পায়, কিভাবে খাওয়ার সময় পায়, কিভাবে এসমস্ত কিছু করার সময় পায়? আপনি এগুলি প্রয়োজনীয় বলে মেনে নিয়েছেন তাই। সমাজ যত বেশি বেশি উন্মত্ত হয়ে উঠছে, পাশ্চাত্যের তত বেশি বেশি মানুষেরা উপলব্ধি করেছে: ইউরোপের, ইউএসের, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া আর অবশ্যই ভারতের মানুষ উপলব্ধি করছে ‘আমার মানবতা আর আমার সদ্বিবেচনা ধরে রাখতে হলে, আমাকে আত্মসচেতন হতে জানতেই হবে।'”
ধ্যান: সচেষ্ট হন আর তুলনা করুন!
প্রশ্ন: ইন্দ্রিয়সুখ জীবন উপভোগ করার একমাত্র উপায় বলে আজকের সমাজে তরুণদের শেখানো হয়, যেখানে ধ্যান ও যোগ বিপরীত শিক্ষা দেয় – আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও অন্তর্মুখীকরণ সুখী হবার উপায়। যোগানন্দজির শিক্ষা কি এই ধন্ধের সমাধান করতে পেরেছে?
স্বামী চিদানন্দজি: “পরমহংসজি সবসময় বলতেন, ‘সচেষ্ট হও আর তুলনা করো’। জন্ম-জন্মান্তর ধরে আত্মার বিবর্তন চলাকালীন, প্রতিটি মানুষ একটা সন্ধিক্ষণে পৌঁছে ভাবে: ‘আমি ইন্দ্রিয় নই, তাই ইন্দ্রিয়সুখ আমাকে অতৃপ্তই রাখবে’। আমরা সবাই এমন সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছি আর যারাই যৌনতা, মদ বা ধন-সম্পদ ইত্যাদির অন্বেষণে আছে, তাদের সমালোচনাও করছি না। তখনই কেউ ঐকান্তিক সংকল্পে আধ্যাত্মিকতার পথে প্রবৃত্ত হয়, যারা এমন সব করে দেখেছে পরিশেষে এসব তাদের খালিই করে গেছে।
“অন্যদিকে, এই পর্যায়ে যে পৌঁছোয়নি তাকে বোঝানো খুব কঠিন। আপনি কাউকে ধমকে বলতে পারেন না ‘অমন করবে না, এটা তোমার জন্য ক্ষতিকর।’ ঠিক যেমন আপনি বাচ্চা থাকাকালীন এরকমই কিছু আপনার মা আপনাকে বলতেন, আর যখনই তিনি ঘুরে যেতেন সেগুলোই আপনি করতে চাইতেন। ওভাবে কাজ হয় না। এটা হওয়া উচিত: ‘ধ্যানের জন্য সচেষ্ট হও আর তারপর তুলনা করো’।
আত্ম-উপলব্ধির সর্বোচ্চ অবস্থা
প্রশ্ন: কোথা থেকে শুরু করা যাবে?
স্বামী চিদানন্দজি: “আমরা তাদের পরমহংস যোগানন্দজির একটা বই — ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি’ অথবা ‘হোয়ার দেয়ার ইজ লাইট’ পড়তে বলি এগুলো তাদের শুরু করার জন্য একটা রাস্তা দেখায়। এরপর আমাদের গুরুদেব পরমহংস যোগানন্দজির রেখে যাওয়া উপহার অসাধারণ আত্মোপলব্ধির জন্য যোগদা সৎসঙ্গ পাঠমালার ভূমিকা পড়তে উৎসাহ দিই। এই ভূমিকাটিতে ‘আত্মোপলব্ধির সর্বোচ্চ অবস্থা’ বলা হয়। এমনকি এর শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘তুমি কি জীবনে কিছু করতে চাও? তাহলে, এদিকে তাকাও আর কি অনুভব করছ দেখো।’ ওয়াইএসএস পাঠমালা দৈনিক ধ্যানের নির্দেশ দেয় আর কয়েকমাস ধরে বিভিন্ন প্রক্রিয়া প্রদান করতে থাকে এবং নয় থেকে দশ মাস পরে প্রকৃত ধ্যানী হবার জন্য সবরকম সরঞ্জাম নিজের হাতেই থাকে।”
প্রশ্ন: স্বামীজি, যোগানন্দজি তাঁর শিক্ষায় কোনো ব্যক্তি অথবা যুবার সাফল্য অর্জনের জন্য মেনে চলতে হবে, এমন কোনো পথের বর্ণনা বা উল্লেখ করেছেন কি? এই শিক্ষা মানুষের সাফল্য অর্জনের কি ব্যাখ্যা দেয়? যুবসমাজের সাফল্য অর্জনের জন্য যোগানন্দজির শিক্ষা কি সাহায্য করতে পারে?
স্বামী চিদানন্দজি: “মনুষ্যরূপে সাফল্যের জন্য আমরা কঠোর পরিশ্রমী। তবে জানতে হবে কিভাবে ওই দক্ষতা, ওই সাহায্যকে কাজে লাগাতে হয়। তাঁর (পরমহংস যোগানন্দজির) শিক্ষা সেটাই আমাদের জানায়। সাম্যতার ধারণা এর মূল ভিত্তি, মানে, আমাদের প্রকৃতির প্রতি আমাদের এক বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে: আমাদের একটা শরীর আছে, একে আমাদের খাওয়াতে হয়, এ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাদের যত্ন নিতে হয়, সুস্থ করার উপায় খুঁজতে হয়……আর এসব কিছুই জীবনের বস্তুগত সমস্যা। তবে, মানবতার অনেক কিছু এতেই হারিয়ে যায় সেটাই একটা ব্যাপার।
“এমনকি আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমাদের সত্ত্বায় মনস্তত্ত্ব, বোধশক্তি এমনকি তার থেকেও উচ্চতর আধ্যাত্মিক পরিমাপ। তাই, তাঁর (পরমহংসজির) সাফল্যের পথে আপনি পাবেন বস্তুগত সাফল্য ও সমৃদ্ধি, মানসিক স্থৈর্য ও অন্তরের শান্তির নির্ভুল সাম্যতা, আর সর্বোপরি আধ্যাত্মিকতা — শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন নয়, শুধুমাত্র পরিবার ও সন্তান নয়, বরং আমার মৌলিক অভিপ্রায় আমার জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমি পরমাত্মার অংশবিশেষ, এই পার্থিব শরীরে বাস করা আমি আত্মা, এই উচ্চতর ভাবনার সম্পূর্ণ উপলব্ধি ও প্রকাশ — আপনার জীবন উচ্চতর আদর্শে পরিচালনা করতে আপনার আত্মজ্ঞান থাকবে।”
স্বামীজি আরও বলেন: “একবার এই প্রত্যয় আপনার হলে, সবরকম কুশলতা, কার্যক্ষমতা ও নৈপুণ্যের উপলব্ধিতে জীবন খুবই রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে, তবে প্রতিটি মানুষের প্রতিভার অংশ হলেও সচেতন পরিচর্যা ও সচেতন প্রচেষ্টায় জাগরিত হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণ সুপ্ত থাকে। আর এই শিক্ষাই যোগানন্দজি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ধ্যানের মাধ্যমে, ইচ্ছাশক্তির সম্প্রসারণে, মনঃসংযোগের বিকাশে, সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার এই সব গুণের বিকাশসাধনে আপনি সর্বোচ্চ বস্তুগত সাফল্য, মানসিক ও আবেগের সুস্থতা ও সামঞ্জস্য আর সর্বোপরি আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য আবিষ্কার করতে পারেন।
“১৯২০-র দশকে যে সময়ে তিনি ইউনাইটেড স্টেটস-এ এসেছিলেন, ইতিহাসে ইউএস-এর এই অধ্যায়কে ‘রোরিং টোয়েন্টিজ’ বলা হত, কারন ইউএস তখন পুরোপুরি ‘গাং হো’ ছিল আর তার পুঁজিবাদের দর্শন আঁকড়ে এগিয়ে চলছিল। তাঁর সাথে অনেক সফল ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোগী প্রভৃতির সাক্ষাৎ হয়েছিল আর তারা সকলেই স্বীকার করেছেন যে যোগানন্দজি তাদের জীবনে অনুপস্থিত থাকা একটি বিষয় নিয়ে এসেছেন।
“আপনাদের একটা মজার ছোটো ঘটনা বলি: ন্যু ইয়র্ক শহরে তাঁর বক্তৃতা চলাকালীন এক ব্যক্তি তাঁর সাক্ষাৎ করতে চান। তাঁর হোটেলের ঘরে গিয়ে যোগানন্দজি কিছু বলার আগেই আপত্তিজনক ভাবে ইনি বলেন, ‘আমি চরমভাবে সম্পদশালী, আমি চরমভাবে স্বাস্থ্যবান’, অর্থাৎ ‘আপনি এখানে কেন এসেছেন?’ আর যোগানন্দজি তৎক্ষণাৎ বলেন, ‘আচ্ছা, কিন্তু আপনি চরমভাবে সুখী কি?’
পরে ব্যক্তিটি বলেছিলেন, ‘উনি আমায় বুঝেছেন!’ আর বাকি জীবনের জন্য তিনি একজন ক্রিয়াযোগী হয়ে যান। বাইরে থেকে একজন কোটিপতি শিল্পপতি, ভিতর থেকে একজন উদ্দীপ্ত যোগী।”
প্রশ্ন: স্বামীজি, আপনার মতে, আজকের তরুণদের উপর পরমহংস যোগানন্দজির শিক্ষা কিরকম প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয়?
স্বামী চিদানন্দজি: “আপনি যখন বুঝতে পারেন মানুষ মূলত আত্মা, তখন ছোট্ট এক জন্মের ওপর মনোযোগী হতে পারবেন না। যাদের আমরা ‘তরুণ’ বলি তারাও প্রবীন আত্মা আর তারাও সব মানুষের অন্তর্নিহিত ব্যাকুল বাসনা — সুখ, নিরাপত্তা, প্রেম ইত্যাদি পূরনে সব ধরনের প্রয়াস ও আকাঙ্খার মধ্যে দিয়ে এসেছে। অবশেষে তারা তাই [পূর্ণতা] খুঁজে পেতে অনেক জন্ম অতিবাহিত করে এসেছে। আর আমাদের মধ্যে লক্ষ লক্ষ যারা জন্ম নিয়েছে তাদের অনেকেই অতীত জন্মের ক্রমবিকাশের পর্যায়ে আছে।
“ভগবদগীতায় কৃষ্ণ এই বিষয়ে বলেছেন। তিনি অর্জুনকে বলেন: ‘পরম লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার আগেই যদি ইহজন্মের অন্তিম লগ্নে পৌঁছে যাও, ভীত হয়ো না, কারণ যোগ ধ্যানের কোনো প্রচেষ্টাই বৃথা যায় না।’ সেই ভক্তের এমন পরিবেশে পুনর্জন্ম হয় যেখানে সে আবার তা ফিরে পায়। তাই, যাদেরকে ‘তরুণ’ ভাবছ, তারাও জ্ঞানী, হতে পারে সবরকম পরিস্থিতি পার হয়ে আসা ‘ওখানে ছিলাম, এমন করেছিলাম’ এইরকম চেতনা থাকা কিছুটা রণক্লান্ত আত্মা। অতঃপর তারা ফিরে এসেছে আর বলছে ‘আমি আর সময় নষ্ট করছি না, আমি আর কোনো জন্ম নষ্ট করছি না, আর আমার অন্তরের ঈশ্বরসংযোগের জন্য আমার সত্ত্বার সম্ভাবনা ও আকাঙ্খা যথাযথভাবে পূরণ করব।’
“সব জীবন যেমন ঊর্ধ্বমুখী ধারায় উন্নীত হয়, মানুষও তেমনই মৌলিক মানবিক প্রতিভা থেকে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হয় আর জন্ম জন্মান্তরে তাদের আরো সম্ভাবনাময় করে তোলে। মানবজাতি বিবর্তন ও অবক্ষয়ের চক্রে আবর্তিত হতে থাকে শাস্ত্রে যাকে যুগ বলা হয়েছে। তাদের উত্থান পতন থাকে; ঠিক এখন আমরা যে যুগে আছি তা ঊর্ধ্বগামী। অন্যভাবে বললে, যেসব আত্মা এখন পুনর্জন্মে আসছে তারা তাদের পিতামহ আর প্রপিতামহের তুলনায় বিবর্তনের উচ্চতর পর্যায়ে আসছে………..আজকের শিশুদের দেখুন; এই স্বাভাবিক উপলব্ধি এখানে আছে……..’না, আমি শুধুমাত্র কারোও গাত্রবর্ণের জন্য ঘৃণা পোষণ করব না’, তথা তাদের নানা ধরনের মানসিক অজ্ঞতার স্বাভাবিক বর্জন যেগুলো পৃথিবীজুড়ে দেশে দেশে পূর্ববর্তী প্রজন্মতে প্রোথিত ছিল।
“এটা প্রায় এমন যেন তারা এক উন্নীত প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে, আর তারা ক্রমবিকাশের আরোহনীতে আছে বলেই [পরমহংস যোগানন্দের দেওয়া] ধ্যানের ধারণার সান্নিধ্যে আসা মাত্রই তাদের সম্পূর্ণ উপলব্ধি হয় এই পথের ভিত্তি সার্বজনীন আধ্যাত্মিক আদর্শ, যেখানে ‘আমার ধর্ম তোমার ধর্মের বিরুদ্ধে’ এমন কিছুই নেই, বরং মানবজাতিকে বিভক্ত করার পরিবর্তে একত্রিত করার এক সার্বজনীন পথ। আমার মনে হয়, আমার বয়সে পৌঁছোলে সম্ভবত আপনারা আরো অনেক বেশি এটা বুঝতে পারবেন। পিছন ফিরে তাকিয়ে আপনি ভাববেন, ‘ওহ কিভাবে ওই প্রজন্মতে মানুষ এরকম হতে পারত?'”

দূরদর্শন ইন্ডিয়ার সাথে সাক্ষাৎকারে
আমরা ডিডি নিউজ-এর পরিচালনায় স্বামীজির সাথে সাক্ষাৎকার দেখতে আপনাকে আমন্ত্রণ জানাই যেখানে বিশ্ব যা কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে যাক না কেন প্রশান্তির সাথে এর সম্মুখীন হতে ধ্যান ও সার্বজনীন আধ্যাত্মিকতার অত্যাবশ্যকীয়তা এবং আমাদের নিজেদের দৈব গুণাবলির উদ্ঘাটনের ওপর আলোকপাত করেছেন।


আমরা ওয়াইএসএস-এর রাঁচি, নয়ডা ও দক্ষিণেশ্বর আশ্রমে স্বামী চিদানন্দজির ভ্রমণকালীন কিছু সংবাদ প্রতিবেদন আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই। এর সাথে, ওয়াইএসএস-এর ২০২৩ হায়দ্রাবাদ সঙ্গমে স্বামীজির পরিক্রমাও সংবাদে বিস্তৃতভাবে পরিবেশিত হয়েছিল।
রাঁচি
হায়দ্রাবাদ
ভারতের বিভিন্ন স্থানে স্বামীজির পরিক্রমার ফটো দেখার জন্য অনুগ্রহ করে এই নিচের বোতামে ক্লিক করুন।
