যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া শব্দকোশ (শ – হ)

শংকর, স্বামী: আচার্য শংকর যাঁকে আদি শংকরাচার্য নামেও অভিহিত করা হয়। স্বামী শংকরাচার্য হলেন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক। তাঁর আবির্ভাবকাল সম্বন্ধে সঠিকভাবে জানা যায় না। অনেক পণ্ডিতের মতে তিনি অষ্টম বা নবম শতাব্দীর গোড়ার দিকে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঈশ্বরকে নঞর্থক বিমূর্তরূপে ব্যাখ্যা করেননি, বরং তাঁকে সদর্থক, শাশ্বত, সর্বব্যাপী ও চিরনবীন আনন্দরূপে প্রচার করেছেন। স্বামী শংকরাচার্যই সুপ্রাচীন স্বামী সম্প্রদায়কে পুনর্গঠিত করেন এবং চারটি বিখ্যাত মঠ (সন্ন্যাসী পরিচালিত আধ্যাত্মিক শিক্ষাকেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা করেন। এই চার পীঠের ধর্মাধ্যক্ষগণ আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারসূত্রে ‘জগৎগুরু শ্ৰীশংকরাচার্য’ এই পদবী গ্রহণ করে থাকেন।

শক্তিসঞ্চার ব্যায়াম: একটা মাছকে চারদিক দিয়েই যেমন জল ঘিরে রাখে, মানুষকেও তেমনি চারপাশ দিয়ে মহাপ্রাণশক্তি ঘিরে রেখেছে। পরমহংস যোগানন্দের উদ্ভাবিত এই শক্তিসঞ্চার ব্যায়ামের মাধ্যমে যা যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ পাঠমালায় (দ্র) শেখানো হয়, মানুষ এই মহাপ্রাণের সাহায্য নিয়ে তার দেহকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারে।

শয়তান: হিব্রু ভাষায় এর আক্ষরিক অর্থ প্রতিপক্ষ। শয়তান হল এক চেতনাসম্পন্ন ও স্বাধীন বিশ্বজনীন শক্তি যা তার ঈশ্বরবিচ্ছিন্ন ও সসীম বৈষয়িক চেতনার প্রভাবে সকলকে এবং সবকিছুকেই মোহগ্রস্ত করে রাখে। তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য শয়তান মায়া ও অবিদ্যারূপী অস্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করে। মায়া দ্রষ্টব্য।

শিষ্য: অধ্যাত্মসত্যের জন্য আকুল কোনো ব্যক্তি যিনি ঈশ্বরদর্শনের আগ্রহ নিয়ে শ্রীগুরুর চরণপ্রান্তে এসে পৌঁছোন এবং সেই উদ্দেশ্যে গুরুদেবের সাথে এক চিরস্থায়ী আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত করেন। যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটিতে ক্রিয়াযোগে দীক্ষার মাধ্যমে গুরু-শিষ্য সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। গুরু এবং ক্রিয়াযোগ দ্রষ্টব্য।

শ্বাস: পরমহংস যোগানন্দ লিখেছেন, “শ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সূক্ষ্মশক্তির প্রবাহ অপর্যাপ্ত ধারায় মানবদেহে প্রবেশ করে তার মনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এইভাবে শ্বাসের মাধ্যমে পরিবর্তনশীল প্রাকৃতিক জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগ বজায় থাকে। দুঃখময় অনিত্যতার হাত থেকে মুক্তি পেতে এবং পরব্রহ্মের আনন্দময় ধামে প্রবেশের জন্য যোগীপুরুষ বিজ্ঞানসম্মত ধ্যানসাধনার মাধ্যমে শ্বাসকে শান্ত করেন।”

শ্রীযুক্তেশ্বর, স্বামী: স্বামী শ্ৰীযুক্তেশ্বর গিরি (১৮৫৫-১৯৩৬) ছিলেন ভারতের একজন ‘জ্ঞানাবতার’। তিনি হলেন পরমহংস যোগানন্দের গুরুদেব এবং যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার ক্রিয়াবান সদস্যদের পরমগুরু। শ্ৰীযুক্তেশ্বরজি ছিলেন লাহিড়ী মহাশয়ের শিষ্য। লাহিড়ী মহাশয়ের গুরুদেব, মহাবতার বাবাজি মহারাজের প্রেরণায় তিনি “দ্য হোলি সায়েন্স” (The Holy Science) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত যে ভাবগত ঐক্য রয়েছে, পুস্তকখানিতে তারই আলোচনা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ক্রিয়াযোগ (দ্র) প্রচারের কাজে পরমহংস যোগানন্দের উদ্দেশ্যকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য শ্ৰীযুক্তেশ্বরজি তাঁকে যথাযোগ্য শিক্ষাদান করেন। পরমহংসজি তাঁর যোগী-কথামৃত গ্রন্থে শ্ৰীযুক্তেশ্বরজির জীবনকাহিনি অত্যন্ত দরদি ভাষায় বর্ণনা করেছেন।

সৎ-চিৎ-আনন্দ: ঈশ্বরের সংস্কৃত পরিভাষা যা সত্য (সৎ) বা পরমাত্মার শাশ্বত সত্ত্বা, অসীম চেতনা (চিত), এবং চির নতুন পরমানন্দ (আনন্দ) প্রকাশ করে।

সৎ-তৎ-ওম: সৎ – পরম সত্য, পরব্রহ্ম, পরমানন্দ; তৎ – বিশ্বজনীন প্রজ্ঞা বা চৈতন্য; ওম – বোধযুক্ত ও সৃজনশীল বৈশ্বিক স্পন্দন; নাদরূপ ব্রহ্ম। (ওমত্রিত্ব দ্রষ্টব্য)

সনাতন ধর্ম: বৈদিক শিক্ষাবলি যা কালক্রমে হিন্দুধর্ম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, তাকেই সনাতন ধর্ম বলে। সিন্ধু নদের তীরবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীদের গ্রিসদেশীয়রা ইন্দু বা হিন্দু বলত। সেখান থেকেই হিন্দুধর্ম কথাটির উৎপত্তি। ধর্ম দ্রষ্টব্য।

সমাধি: মহর্ষি পতঞ্জলি (দ্র) নির্দেশিত যোগসাধনার অষ্টাঙ্গিক মার্গের সর্বোচ্চ স্তর। যখন ধ্যাতা, ধ্যান (মন যখন ইন্দ্রিয়চেতনা থেকে বিমুক্ত হয়ে অন্তর্মুখী হয়) এবং ধ্যেয় বস্তু (ঈশ্বর) মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তখনই সমাধির উপলব্ধি আসে। পরমহংস যোগানন্দজি বলেছেন, “সবিকল্প সমাধিতে ভক্তের চেতনা পরব্রহ্মে মিশে যায়; তার প্রাণশক্তি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় বলে দেহকে মৃত বা গতিহীন এবং কঠিন দেখায়। জীবনের বাহ্যিক লক্ষণাদি শূন্য নিজ দেহের বিষয়ে কিন্তু যোগী সম্পূর্ণ সচেতন থাকেন। তারপর সাধনক্ষেত্রে যখন তিনি আরও উচ্চাবস্থা প্রাপ্ত হন (নির্বিকল্প সমাধি), তখন দেহজ্ঞানশূন্য হয়েই তিনি ঈশ্বরসঙ্গ করেন। এমনকি কঠিন পার্থিব কর্মের মধ্যে থেকেও কিংবা সাধারণ জাগ্রত চেতনায় অবস্থান করেও, তিনি সেইভাবে বিভোর থাকেন।” উভয় প্রকার সমাধিতেই চিদানন্দের সঙ্গে একীভূত হওয়া গেলেও, ‘নির্বিকল্প সমাধি’র অভিজ্ঞতা কেবল অতি উচ্চকোটির সাধকদের পক্ষেই অনুভব করা সম্ভব।

সাধনা: আধ্যাত্মিক অনুশাসনের পথ। গুরু তাঁর শিষ্যদের জন্য যে বিশেষ নির্দেশ ও ধ্যানপদ্ধতি অনুশীলনের বিধান দিয়ে যান, সেসব বিশ্বস্তভাবে অনুশীলন করলে তারা শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরদর্শন লাভ করে থাকে।

সিদ্ধ: আক্ষরিক অর্থে “যে সাফল্য অর্জন করেছে।” যার আত্মানুভূতি লাভ হয়েছে, তাকেই সিদ্ধ বলে।

সুষুম্নাশীর্ষক: মস্তিষ্কের নিম্নদেশে অবস্থিত এই অংশটি (মেরুদন্ডের ওপর) দেহে প্রাণশক্তি প্রবেশ করার প্রধান পথ; এখানেই মস্তিষ্ক-মেরুদন্ডগত চক্রগুলির মধ্যে ষষ্ঠ চক্রটির অধিষ্ঠান যার কাজ দেহে আগত প্রাণশক্তির প্রবাহকে গ্রহণ ও চালিত করা। মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ অংশে অবস্থিত সপ্তম কেন্দ্রে (সহস্রার) প্রাণশক্তি সঞ্চিত হয়, যেখান থেকে প্রাণশক্তি সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে। সুষুম্নাশীর্ষকে স্থিত সূক্ষ্ম কেন্দ্রটি হচ্ছে সেই মুখ্য ‘সুইচ’ যা প্রাণশক্তির প্রবেশ, সঞ্চয় ও বিতরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।

সূক্ষ্ম দেহ: অ্যাস্ট্রাল দেহ হল মানুষের সূক্ষ্ম দেহ, যা আলো, প্রাণশক্তি বা ‘লাইফট্রন’ দ্বারা গঠিত। এটি আত্মাকে ঘিরে থাকা তিনটি আবরণের মধ্যে দ্বিতীয়টি—কারণ দেহ (causal body) (দ্র.), সূক্ষ্মদেহ এবং ভৌতিক দেহ। সূক্ষ্ম দেহের শক্তি ভৌতিক দেহকে জীবন্ত রাখে, যেমন বিদ্যুৎ একটি বাতিকে আলোকিত করে। এই দেহে মোট উনিশটি উপাদান রয়েছে: বুদ্ধি, অহং, অনুভূতি, এবং মন (যা ইন্দ্রিয় সচেতনতা প্রদান করে); পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় বা জ্ঞানের উপকরণ—যা দৃষ্টি, শ্রবণ, ঘ্রাণ, রুচি এবং স্পর্শের ভৌত ইন্দ্রিয়ের অভ্যন্তরে সূক্ষ্ম শক্তি হিসেবে কাজ করে; পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় বা কার্যক্ষমতা—যা প্রজনন, বর্জন, বাক, গমন এবং হস্তচালনার জন্য দায়ী; এবং পাঁচটি প্রাণশক্তির উপকরণ—যা রক্ত সঞ্চালন, পরিপাক, শোষণ, স্ফটিককরণ ও বর্জনের কাজ সম্পাদন করে।

সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ: মানুষের উপকারের জন্য ক্রিয়াযোগের আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ও ধ্যানপ্রক্রিয়ার বিশ্বব্যাপী প্রচারের উদ্দেশ্যে এবং জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল ধর্মের মধ্যে নিহিত সেই এক ও অদ্বিতীয় সত্যের মহান উপলব্ধির উদ্দেশ্যে ১৯২০-তে পরমহংস যোগানন্দ আমেরিকায় এই সংস্থা (সঙ্ঘ) প্রতিষ্ঠা করেন (১৯১৭-তে ভারতে প্রতিষ্ঠিত তাঁর সংস্থা যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া নামে পরিচিত)। সারা বিশ্বে, মানুষের মঙ্গল ও সেবার উদ্দেশ্যে, ‘ক্রিয়াযোগের’ আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ও ধ্যান-প্রক্রিয়াকে প্রচারের জন্যই এই সঙ্ঘ স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ প্রসঙ্গে পরমহংস যোগানন্দ বলেছেন, “সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ কথাটির অর্থ হল —আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে সখ্যস্থাপন (যোগাযোগস্থাপন, সম্পর্কস্থাপন) এবং সকল সত্যসন্ধানীর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা।”

সেল্ফ-রিয়লাইজেশন: পরমহংস যোগানন্দ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সংস্থা সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের সংক্ষিপ্ত রূপ যা তিনি তাঁর ঘরোয়া কথাবার্তায় প্রায়ই ব্যবহার করতেন, যেমন “দ্য সেল্ফ-রিয়লাইজেশন টিচিংস,” “সেল্ফ-রিয়লাইজেশন হেড কোয়াটার্স ইন লস অ্যাঞ্জেলস” ইত্যাদি।

স্বজ্ঞা: আত্মার সর্বজ্ঞতার ক্ষমতা যা মানুষকে ইন্দ্রিয়ের মধ্যস্থতা ছাড়াই সত্যের প্রত্যক্ষ অনুভূতি অর্জনে সাহায্য করে।

স্বামী: ভারতের অতি প্রাচীন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিগণ এই নামে পরিচিত হন। অষ্টম বা নবম শতাব্দীর গোড়ার দিকে শংকরাচার্য (দ্র) এই সম্প্রদায়কে পুনর্গঠিত করেন। এইরকম একজন সন্ন্যাসী আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রহ্মচর্যপালন এবং জাগতিক বন্ধন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করার শপথ গ্রহণ করে ধ্যানসাধনা ও অধ্যাত্ম চর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং মানবসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে বিভিন্ন পদবী যুক্ত দশটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা – গিরি, পুরী, ভারতী, তীর্থ, সরস্বতী প্রভৃতি। স্বামী শ্ৰীযুক্তেশ্বর (দ্র) এবং পরমহংস যোগানন্দ গিরি (পর্বত) সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। স্বামী – এই সংস্কৃত শব্দটির অর্থ হল “যিনি স্ব বা আত্মার সহিত অভিন্ন।”

হিন্দুত্ব: সনাতন ধর্ম দ্রষ্টব্য

এই শেয়ার করুন